parbattanews

নির্বাচনী ইশতেহারে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি

মেহেদী হাসান পলাশ

আমরা সকলেই জানি আগামী ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেই হিসেবে নির্বাচনের আর মাত্র ৭ দিন বাকি।  এরই মধ্যে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলদগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছে।  সবার আগে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট- ১২ ডিসেম্বর। সবার পরে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছে ইসলামী ঐক্য আন্দোলন- ২১ ডিসেম্বর। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছে ৭টি রাজনৈতিক দল বা জোট।  এরা হলো, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ঐক্যফ্রন্ট, জাতীয় পার্টি, বাম গণতান্ত্রিক জোট, জাসদ ও ইসলামী ঐক্য আন্দোলন। এরপর আর কোনো জাতীয় রাজনৈতিক দল বা জোট নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করবে কিনা আমাদের জানা নেই।

নির্বাচনী ইশতেহার দেখে বা পড়ে এদেশের জনগণ বা ভোটাররা ভোট দেয় কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে।  তবুও নির্বাচন এলে অনেকটা প্রথাসিদ্ধ উপায়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের উদ্দেশ্যে একটি করে ইশতেহার প্রকাশ করে আসছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হয়। বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ কথা বলেন।  নির্বাচনের পরেও ক্ষমতাসীন সরকারের দায়িত্ব পালনকালে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে এ বিষয়ে সরকারকে মনে করিয়ে দেয়া হয়, জবাবদিহি চাওয়া হয়।  সে কারণেই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো, ইস্যুগুলোতে সুনির্দষ্টভাবে তাদের বক্তব্য তুলে ধরে থাকে নির্বাচনী ইশতেহারে।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলো প্রদত্ত ইশতেহারে পার্বত্য চট্টগ্রাম আলাদা গুরুত্ব পেয়েছে।  ইশতেহার দেয়ার প্রায় সকল রাজনৈতিক দলই তাদের ইশতেহারে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা গুরুত্ব দিয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব এসেছে বাম গণতান্ত্রিক জোটের ইশতেহারে।  অন্যদিকে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির ইশতেহারে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি।  ইসলামী ঐক্য আন্দোলন ও জাতীয় পার্টি বাদে সকল রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে পার্বত্য চট্টগ্রাম বা পাহাড় শব্দটি এসেছে।  আলাদা করে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলেছে আওয়ামী লীগ, জাসদ ও বাম গণতান্ত্রিক জোট।  বিএনপি, ঐক্যফ্রন্ট, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের ইশতেহারে এ বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি।

একইভাব ভূমি কমিশন কার্যকর করা বা ভূমি সমস্যার সমাধানের বিষয়টিও এসেছে আওয়ামী লীগ, জাসদ ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের ইশতেহারে।  কিন্তু বিএনপি, ঐক্যফ্রন্ট, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের ইশতেহারে এ বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি।  বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছে।  আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছে। অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে এ বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি।

ইশতেহারে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করেছে দুইটি রাজনৈতিক দল। জাসদ ও বাম গণতান্ত্রিক জোট।  অন্যকোনো রাজনৈতিক দল তাদের ইশতেহারে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করেনি। বিশেষ করে অতীতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইশতেহারে আদিবাসী শব্দটি থাকলেও এবারে তারা এ শব্দটি পরিহার করেছে।  বিএনপি এতোদিন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু শব্দটি অস্বীকার করে বলেছে, বাংলাদেশে কেউ সংখ্যালঘু নয়।  সকলেই সমান।  সাংবিধানিকভাবে সকলের সমান অধিকার দেয়া হয়েছে।  কিন্তু এবারে তারা সরাসরি সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে।

জাসদের ইশতেহারে একইসাথে আদিবাসী ও ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।  জাসদ(ইনু) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বাংলাদেশে আদিবাসী স্বীকৃতির দাবীতে সোচ্চার হলেও নির্বাচনী ইশতেহারে তিনি বলেছেন, “ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করার প্রচেষ্টা” চালাবে তার দল।  বাম গণতান্ত্রিক জোটের ইশতেহারে আদিবাসী ও বিভিন্ন জাতিসত্ত্বা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।  একমাত্র তারাই ‘আদিবাসী হিসেবে বিভিন্ন জাতিসত্তার স্বকীয়তার পূর্ণাঙ্গ সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান, জাতিসংঘের আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর প্রদান এবং সেই অনুসারে দেরি ও ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করেছে।  অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে এ বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি।

বাম গণতান্ত্রিক জোটের ইশতেহারে পর্যায়ক্রমে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার এবং পাহাড়ে রাজা হেডম্যান ও কার্বারীদের নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করার কথাও বলা হয়েছে।  কয়েকটি রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে জাতিগত বা ধর্মীয় ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।  এর সুবিধাও পাবে পাহাড়ে বসবাসকারী জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।

মোটামুটি সকল রাজনৈতিক দলের ইশতেহারেই ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার স্বীকৃতি, শিক্ষা, চাকুরী ও জীবনমানের উন্নয়নে তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার করা হয়েছে।  তবে আলাদা করে পার্বত্য বাঙালীদের বিষয়টি বলা হয়নি কোনো রাজনৈতিক দলের ইশতেহারেই।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে কোন রাজনৈতিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম ও এর অধিবাসীদের উন্নয়নে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা নিম্নে তুলে ধরা হলো:

আওয়ামী লীগ

শাসক দল আওয়ামী লীগ তাদের ইশতেহার প্রকাশ করেছে গত ১৮ ডিসেম্বর। এ ইশতেহারে ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও অনুন্নত সম্প্রদায় শিরোনামে তারা বলেছে, “পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির যেসব ধারা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি, সেগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভূমিতে প্রকৃত স্বত্বাধিকারীদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে। জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা হবে। সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক সকল প্রকার আইন ও ব্যবস্থার অবসান করা হবে।”

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল

গত ১৮ ডিসেম্বর প্রদত্ত ইশতেহারে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়’ শিরোনামে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বলেছে, “পাহাড়ি ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবন, সম্পদ, সম্ভ্রম ও মর্যাদা সুরক্ষা করা হবে। অনগ্রসর পাহাড়ি ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর চাকুরী ও শিক্ষাক্ষেত্রে সকল সুবিধা এবং পার্বত্য অঞ্চলের উন্নয়ন কার্যক্রম জোরদার করা হবে।  দল, মত, জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে ক্ষুদ্র-বৃহৎ সকল জাতি গোষ্ঠির সংবিধান প্রদত্ত সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মকর্মের অধিকার এবং জীবন, সম্ভ্রম ও সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা হবে। এই লক্ষ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। “

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট

গত ১৭ ডিসেম্বর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট প্রদত্ত ইশতেহারে এ সংক্রান্ত শিরোনাম ছিলো ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’। এ ইশতেহারে তারা জানিয়েছে, “সংখ্যালঘুদের মানবিক মর্যাদা অধিকার নিরাপত্তা এবং সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় ন্যূনতম ঘাটতি খুব গুরুত্বের সাথে নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সংখ্যালঘুদের ওপর যে কোনো রকম হামলার বিচার হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে।  পাহাড় এবং সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের সংস্কৃতি রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হবে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করা হবে।”

জাতীয় পার্টি

গত ১৪ ডিসেম্বর প্রদত্ত জাতীয় পার্টির নির্বাচনী ইশতেহারে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে সরাসরি কোন  কথা না বলা হলেও বাংলাদেশকে ৮ টি প্রদেশে বিভক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে অষ্টম প্রদেশের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে চট্টলা প্রদেশ। পার্বত্য চট্টগ্রামকে এই চট্টলা প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বাম গণতান্ত্রিক জোট

গত ১২ ডিসেম্বর বাম গণতান্ত্রিক জোটের ইশতেহারের শিরোনাম ‘বিভিন্ন জাতি সত্তা আদিবাসী  সমাজ ও দলিতদের যথাযথ স্বীকৃতি ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা’। এ ইশতেহারে তারা বলেছে, “আদিবাসী হিসেবে বিভিন্ন জাতিসত্তার স্বকীয়তার পূর্ণাঙ্গ সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে জাতিসংঘের আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর প্রদান এবং সেই অনুসারে দেরি ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা, পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য গঠিত ভূমি কমিশন সঠিকভাবে কার্যকর করার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জমি ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করা, চুক্তির সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করা, পর্যায়ক্রমে সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার করা, পাহাড়ি-বাঙালি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, পাহাড়ে রাজা, হেডম্যান, কার্বারীদের নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করা।

জাসদ

‘ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের অধিকার’ শিরোনামে গত ১৯ ডিসেম্বর প্রদত্ত জাসদের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, “ধর্মীয় ও জাতিগত কারণে নাগরিকদের মধ্যে সকল ধরণের বৈষম্যের অবসান করা, শত্রু সম্পত্তি আইন বাতিল করা, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি পূর্ণ পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করা, সমতলের আদিবাসী ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ভূমির ওপর ঐতিহ্যবাহী অধিকার নিশ্চিত করার জন্য ভূমি কমিশন গঠন করা, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করার প্রচেষ্টা চালাবে।” দলটি।

ইসলামী ঐক্য আন্দোলন

গত ২১ ডিসেম্বর প্রদত্ত ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের ইশতেহারে বলা হয়েছে, “সকল উপজাতীয় অধিবাসীর স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বার স্বীকৃতি দেয়া হবে এবং তাদের শিক্ষা সংস্কৃতি ও নিজস্ব ঐতিহ্যকে সুরক্ষা করা হবে। সকল অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীকে শিক্ষা, চাকুরি ও যাবতীয় নাগরিক সুবিধা প্রদানের বিশেষ ব্যবস্থা করা হবে।”

বাংলাদেশে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতির সাংবিধানিক সুযোগ না থাকায় পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় দুইটি আঞ্চলিক অনিবন্ধিত সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি(জেএসএস) ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ) সতন্ত্র হিসাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। তবে এখনো পর্যন্ত তারা কোনো নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছে বলে জানা যায়নি।

 লেখক: সম্পাদক, পার্বত্যনিউজ ডটকম, পাক্ষিক পার্বত্যনিউজ ও চেয়ারম্যান, সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন


পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বিষয়ে লেখকের অন্যান্য লেখা

Exit mobile version