parbattanews

পার্বত্য চট্টগ্রামই কি দ্বিতীয় ইসরাইল?

পার্বত্য ষড়যন্ত্র

শামসুদ্দিন মানিক

বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাংশের ১৩১৮৪ বর্গ কিলোমিটার পাহাড়ী এলাকা জুড়ে তিন জেলার (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) সমন্বয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থান। যেখানে বাঙালীসহ আনুমানিক ১৪টি ক্ষুদ্র নৃতাত্তিক উপজাতি বাস করে। জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাঙালী ও পাহাড়ী উপজাতিদের সংখ্যা প্রায় সমান। এই অঞ্চল নিয়ে এত আলোচনা, সমালোচনা, পর্যালোচনা সবকিছুর মূলে রয়েছে তার প্রাকৃতিক সম্পদ এবং ভারতীয় উপমহাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্ববহ সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত বলে। পার্বত্য এলাকায় বর্তমানে চলমান ভয়ংকর পরিস্থিতি আলোচনার আগে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্পদের প্রাচূর্যতা সম্বন্ধে ধারণা না দিলে তার প্রতি অবিচার করা হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পদ সম্ভাবনার এক বিপুল ভাণ্ডার। যেখানে ভূমি সম্পদের প্রাচূর্যতা, মূল্যবান ফলজ, বনজ এবং অনাবিস্কৃত খনিজ সম্পদের বিপুল সমাহার। এখানকার অব্যাহত পানি সম্পদকে ব্যবহার করে একদিকে যেমন বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের সিংহভাগ বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব তেমনি আরেক দিকে প্রায় ৪০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত কাপ্তাই হ্রদ থেকে বিপুল পরিমাণ মৎস সম্পদ আহরণ করা সম্ভব। এই হ্রদ থেকে বর্তমানে ১০০০০টন মাছ আহরণ করা হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে, বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে এখানে যদি মাছ চাষ করা হয় তবে এর চেয়ে ১০গুণ বেশি মাছ আহরণ করা সম্ভব। এছাড়া বনজ সম্পদ ও মূল্যবান ফলজ সম্পদের বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না।

পার্বত্য চট্টগ্রামের খনিজ সম্পদের প্রায় পুরোটাই এখন পর্যন্ত অনাবিস্কৃত রয়ে গেলেও এ অঞ্চলের বর্তমান ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থা ও পরিস্থিতি প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ তেল, চুনা পাথর, কঠিন শিলা প্রভৃতি মূল্যবান খনিজ সম্পদের সম্ভাবনাকে জানান দেয়। যে পরিমাণ খনিজ সম্পদ আছে তার পূর্ণ ব্যবহার করতে পারলে এবং পরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়নের মাধ্যমে পার্বত্য এলাকাকে একটি তাইপে, হংকং, কাতার এর মত সমৃদ্ধশালী অঞ্চলে পরিণত করা যাবে।

পর্যটন শিল্পের কথা যদি চিন্তা করি তবে বলতে হয়, পার্বত্য এলাকার এমন কোন জায়গা নেই যেটা পর্যটকদের আকর্ষণ করবে না। ঢেউ খেলানো পাহাড় সাথে ঝর্ণার মিশ্রণ, উচু হ্রদ, নিরিবিলি নৈসর্গিক পরিবেশ কার না মন টানে। আমরা দেখেছি পর্যটন শিল্পকে পূঁজি করে পৃথিবীর বিভিন্ন বড় বড় শহর যেমন ব্রাজিলের রাজধানীসহ প্রায় পুরো দেশটির বেশির ভাগ অঞ্চল আধুনিকতার সর্বোচ্চ মহিমায় গড়ে উঠেছে। বর্তমানে আর সবকিছু বাদ দিলেও শুধুমাত্র এ শিল্পকে কাজে লাগালে পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে তরান্বিত করা সম্ভব।

উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এই বিপুল সম্পদ রাশির সার্বিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন করে বিশ্বের দরবারে একটি অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সময়ের ব্যপার মাত্র। আর এই সম্ভাবনাকে সামনে রেখে যদি ছোট্ট অঞ্চলটিকে বাংলাদেশ থেকে আলাদা করা যায় তবে এই অঞ্চলই হয়ে উঠবে ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সুতিকাগার। একটু বিশ্লেষণ করলেই আমরা এর যথার্থ উত্তর খুজে পাব। একটি দেশকে দখল করতে হলে তার আভ্যন্তরীণ শৃংখলাকে ধ্বংস করতে হবে। এই থিওরীকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামে কার্যত বিদেশী এনজিওগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে।

বাঙালী ও পাহাড়ীদের মধ্যে নিত্য হানাহানি মূলত এই এনজিও গুলোর ষড়যন্ত্রের ফল। উপজাতিদের মধ্যে বিভিন্ন সচেতনতা মূলক প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের আড়ালে মূলত তাদেরকে বাঙালীদের বিরুদ্ধে উস্কে দিচ্ছে। বাঙালীদের সেটলার আখ্যা দিয়ে এই অঞ্চল থেকে তাদের উৎখাত করে পশ্চিমাদের পরিকল্পিত এজেন্ডা বাস্তবায়নই এনজিওগুলোর মূল লক্ষ্য। আর অন্যদিকে উপজাতি নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠিদের আদিবাসি স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে দেশে বিদেশে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ তারা আদিবাসি স্বীকৃতি পেলেই পশ্চিমারা অনায়াসে এখানে হস্তক্ষেপ করতে পারবে।

আসল কথা হচ্ছে, এনজিওগুলো চায় না এখানে না বাঙালী থাকুক না উপজাতি। এরা এখন উপজাতিদের দাবি আদায়ের কথা বললেও মূলত: খৃস্টান মিশনারীর কাজকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়দের তথ্য মতে, বান্দরবানের উপজাতিদের কয়েকটি গোষ্ঠির শতকরা প্রায় ৩০ভাগ লোককে খৃষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। এবং এই হার রাঙামাটিতে একটু কম হলেও এক্ষেত্রে খাগড়াছড়ি কোন অংশে পিছিয়ে নেই।

কেন এই ধর্মান্তকরণ? আমাদের সচেতন সুশীল সমাজ কি কখনো ভেবেছে? তাহলে কি আমরা ধরে নিতে পারি যে, এনজিওগুলো একদিকে বাঙালী ও পাহাড়ীদের মধ্যে নিত্য হানাহানি লাগিয়ে রেখেছে আর অপরদিকে ধর্মান্তরিত করার কাজ অব্যাহত রেখেছে। যেহেতু বাঙালীরা ধর্মান্তরিত হয় না তাই তারা তিন পার্বত্য জেলাকে জুম্মল্যান্ড নাম দিয়ে আলাদা ভূখন্ড ও স্বতন্ত্র পতাকা তৈরীর মাধ্যমে বাঙালী উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্রের বীজ বপন করে চলেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান অস্থিরতাকে আরো বেশি উস্কে দিয়েছে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের বিল পাশের মাধ্যমে। সংসদে এই বিল পাশ হওয়াতে পাহাড়ের পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে। এই বিলে মূলত বাঙালীদের অধিকারকেই অস্বীকার করা হয়েছে যা কিনা ঐ সকল এনজিও এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক কমিশন নামক সরকার কতৃক অননোমোদিত প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফসল।

এবার দেশের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল নিয়ে একটু পর্যালোচনা করতে হবে। বিদেশী এনজিওগুলো শুধু বাংলাদেশেই নয় পার্শ্ববর্তী ভারতের সেভেন সিস্টারস খ্যাত অঞ্চলগুলোতেও তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানেও মাওবাদী গেরিলা তৈরীর মাধ্যমে সরকার বিরোধী আন্দোলনে ইন্ধন জুগিয়ে আসছে এসব সংগঠন। মূলত তারা সেভেন সিস্টারসসহ বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকাকে যদি আলাদা ভূখণ্ড স্বীকৃত রাষ্টে রূপান্তরিত করতে পারে তবে এশিয়ার পরাশক্তি ভারত, পাকিস্তান ও চীনের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারবে। এই আশায় পশ্চিমা দেশগুলো এসব এনজিওর পেছনে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করে আসছে।

এই যুক্তির পেছনে অকাট্য প্রমাণ হচ্ছে, সন্তু লারমার শান্তিবাহিনী পার্বত্য এলাকায় অপারেশন পরিচালনার জন্য ভারতের অভ্যন্তরে (পাওয়া তথ্য মতে) ৪৩টি বা তারও অধিক সামরিক ক্যাম্প স্থাপন করে। এই ক্যাম্প গুলো সব অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়েছে। ৪৩টি ক্যাম্পকে ভাগ করা হয়েছে ৬টি জোনে। এসকল ক্যাম্প থেকে পরিচালনা করা হয় বাঙালীদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড, গুম, অপহরণ, লুন্ঠন, নির্যাতনসহ যাবতীয় অপারেশন।

মধ্যপ্রাচ্যের বুকে ছোট্ট ইসরাইলী ভূখণ্ড সৃষ্টির মাধ্যমে যেমন পশ্চিমাদের মাথা ব্যথার কারণ ইরান, ইরাক, মিশর, সিরিয়া, লেবাননসহ পুরো এলাকাকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে তেমনি উপমহাদেশের এই গুরুত্বপূর্ণ এলাকাকে খৃষ্টান রাষ্ট্রে পরিণত করার মাধ্যমে গোটা এশিয়াকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে পশ্চিমারা। আর না হলে কেন এই ধর্মান্তকরণ? আমি একজন অসহায় মানুষকে সাহায্য করতে পারি কিন্তু তার বদলে অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাকে ধর্মান্তরিত করতে পারি না। কিন্তু বাস্তবে পাহাড়ে এটাই হয়ে আসছে। মাঝে মাঝে এটাও শুনা যায় সরাসরি টাকার বিনিময়ে ধর্মন্তকরন। এতসব কিছুর পরেও কি আমাদের নেতৃবৃন্দ যারা দেশ নিয়ে চিন্তা করেন তাদের মনে একটুও দাগ কাটবে না? প্রাকৃতিক ভাবে সমৃদ্ধ পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে একটুও কি ভাবার নেই? যদি তাই হয় তবে বুঝতে হবে সংসদে বিল পাশের সাথে যারা জড়িত তাদের সাথে বিদেশীদের আতাঁত আছে। কারণ এই বিল কখনো পাহাড়ে বিভক্তি ছাড়া শান্তি ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারবে না।

এই বন্য পরিবেশে কোন মিডিয়া যেতে পারেনা বলে হয়তো আমরা শুনতে পাইনা কোন ধর্ষিতা কিশোরী বোনের কান্না, শিশু হারা পিতা মাতার আর্তনাদ, ভূমি হারা পরিবারের বেদনার সুর, দেখতে পাইনা ভাই হারা বোনের চোখের জল, সর্বসান্ত পরিবারের দু:খের জীবন। এই চিত্রতো আমরা কখনোই চাই নি।

এখানে বাঙালী ও পাহাড়ীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শান্তিতে সবাই একসাথে বসবাস করুক আমাদের মত সাধারণ জনগণের এটাই কামনা। কিন্তু যতদিন বিদেশী এনজিওগুলো এখানে অবাধ বিচরণ করবে ততদিন আমাদের এই স্বপ্ন কখনোই পূরণ হবার নয়। তাই সরকারের উচিৎ এখান থেকে সর্বপ্রথম এসকল এনজিওগুলোর কার্যক্রমকে বন্ধ করে দেয়া। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের মাধ্যমে সংসদে একচেটিয়া যে বিল পাশ করা হয়েছে সেটা প্রত্যাহার করে নেয়া, শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রত্যয়ে সেনা ক্যাম্প পূনর্বহাল করা, জেলার প্রশাসনে পাহাড়ীদের একক আধিপত্য না দিয়ে বাঙালী-পাহাড়ী সমান অধিকারের ব্যবস্থা করা এবং শিক্ষা- খাদ্য- চিকিৎসাসহ সকল খাতের বরাদ্ধ বৃদ্ধি করে অযৌক্তিক উপজাতি কোটা প্রত্যাহার করা, যোগাযোগ ও উন্নয়ন ব্যবস্থা সেনাবাহিনীর হাতে ন্যস্ত করার মাধ্যমে পাহাড়ে চলমান বিভিষিকাময় পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

পরিশেষে শুধু এতটুকু বলব আমরা আমাদের পার্বত্য অঞ্চলকে বিক্রি করে দিতে চাইনা। তার জন্য আমাদের সবটুকু হারাতেও প্রস্তুত। তাই এ এলাকাকে রক্ষায় দেশের সচেতন জনসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।

-কক্সবাজার থেকে

 

Exit mobile version