পার্বত্য চট্টগ্রামের ইউপি নির্বাচন ২০২১-২২ এর ফলাফল বিশ্লেষণ

fec-image

গত ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সপ্তম ধাপের ইউপি নির্বাচনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইউপি নির্বাচন সম্পন্ন হলো। এটি ছিল দলীয় প্রতীকে দ্বিতীয়বারের মতো ইউপি নির্বাচন। বিএনপি দলীয়ভাবে নির্বাচন বয়কট করায় সারাদেশে ইউপি চেয়ারম্যান পদে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী এবং একই দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে। এক্ষেত্রে পার্বত্য তিন জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ির প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানকার ইউনিয়নগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা এককভাবে প্রাধান্য বিস্তার করতে পারেনি। অধিকাংশ ইউনিয়নেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিপরীতে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে অনিবন্ধিত আঞ্চলিক সংগঠন জেএসএস (সন্তু), ইউপিডিএফ (প্রসীত) এবং জেএসএস (সংস্কার) সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রার্থীই দিতে পারেনি আওয়ামী লীগ। আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ভয়ে কেউ আওয়ামী লীগের প্রার্থিতা চাওয়ার আবেদন পর্যন্ত করার সাহস দেখায়নি।

রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবানে মোট ইউনিয়ন পরিষদ আছে ১১৯টি। এর মধ্যে ২০২১-২২ সালে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নৌকা প্রতীক নিয়ে জয় লাভ করেছেন ৬২টি, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয় পেয়েছেন ১১টি ইউপিতে, বিএনপি কেন্দ্রীয়ভাবে ইউপি নির্বাচন বয়কট করায় তাদের দলের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জয় পেয়েছেন ৪টি ইউপিতে, রাজনৈতিক দল হিসেবে অনিবন্ধিত আঞ্চলিক সংগঠন জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের প্রার্থীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জয় পেয়েছেন ১৫টি ইউপিতে, অনিবন্ধিত আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের প্রার্থীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জয় পেয়েছেন ১৩টি ইউপিতে, অনিবন্ধিত আঞ্চলিক সংগঠন জেএসএস (সংস্কার) গ্রুপের প্রার্থীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জয় পেয়েছেন ৬টি ইউপিতে এবং খাগড়াছড়ি সদরের ১টি ইউপিতে জয় পেয়েছেন একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী।

তিন পার্বত্য জেলায় এখন পর্যন্ত ১০টি ইউনিয়নে নির্বাচন স্থগিত আছে বা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। এর মধ্যে কোনো কোনো ইউনিয়ন পরিষদের মেয়াদ শেষ হয়নি, আবার কোনো কোনোটির নির্বাচন স্থগিত হয়েছে নির্বাচনী অনিয়ম বা সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির কারণে। আবার কোনো ইউনিয়ন দুর্গম হওয়ায় এবং আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় যথাসময়ে হেলিকপ্টারে করে প্রয়োজনীয় নির্বাচনী জনবল ও সরঞ্জাম পাঠাতে না পারার কারণেও নির্বাচন স্থগিত রয়েছে।

এবার অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে ১১টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন ১১ জন। এদের মধ্যে ১০ জন সরকার দলীয় আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এবং রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে জেএসএস (সংস্কার) গ্রুপের ১ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। রাঙ্গামাটিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন ৬ জন, খাগড়াছড়িতে ২ জন এবং বান্দরবানে ৩ জন।

এর আগে সারাদেশের ন্যায় তিন পার্বত্য জেলাতেও প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন হয় ২০১৬ সালে।

পাহাড়ি এবং বাঙালি চেয়ারম্যান

রাঙ্গামাটি জেলায় এবার ৫০টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪৫টি ইউনিয়নের নির্বাচনী ফলাফল নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর মধ্যে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির চেয়ারম্যান হয়েছেন ৩৭ জন এবং বাঙালি চেয়ারম্যান হয়েছেন ৮টি ইউনিয়নে। শতকরা হিসাবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির প্রতিনিধিরা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন ৮২.২২% এবং বাঙালি প্রতিনিধিরা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন ১৭.৭৮ %। খাগড়াছড়িতে ৩৫টি ইউপির মধ্যে নির্বাচনী ফলাফল নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৪টিতে। এর মধ্যে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির চেয়ারম্যান হয়েছেন ২১ জন এবং বাঙালি চেয়ারম্যান হয়েছেন ১৩টি ইউনিয়নে। শতকরা হিসাবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির প্রতিনিধিরা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন ৬১.৭৬% এবং বাঙালি প্রতিনিধিরা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন ৩৮.২৪ %। বান্দরবানে ৩৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ৩০টি ইউনিয়নের নির্বাচনী ফলাফল নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর মধ্যে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির চেয়ারম্যান হয়েছেন ২১ জন এবং বাঙালি চেয়ারম্যান হয়েছেন ৯টি ইউনিয়নে। শতকরা হিসাবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির প্রতিনিধিরা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন ৭০% এবং বাঙালি প্রতিনিধিরা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন ৩০ %।

আরও পড়ুন:

বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসমূহের আগমন ও আদিবাস

অঘোষিত নির্বাচনী সমঝোতা
কোনো দলের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে স্বীকার করা না হলেও পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, এবারের ইউপি নির্বাচনেও জাতীয় এবং আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর মধ্যে নানা মাত্রার সমঝোতার রসায়ন কাজ করেছে। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে জেএসএস (সংস্কার) গ্রুপের একটা বোঝাপড়া বা সমঝোতা লক্ষ করা গেছে। যার প্রতিফলন দেখা গেছে, রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর, বাঘাইছড়ি, লংগদু, কাউখালী, খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, মহালছড়ি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে। ব্যতিক্রম হিসেবে খাগড়াছড়ির গুইমারাতে ইউপিডিএফের একজনকে আওয়ামী লীগের প্রতীক দেয়া হয়েছে। অপরদিকে একসময়ের চরম বৈরী আঞ্চলিক সংগঠন জেএসএস (সন্তু) এবং ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের মধ্যেও নির্বাচনী সমঝোতা কাজ করেছে বলে ধারণা পাওয়া যায়। ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গ্রুপ সরাসরি নির্বাচনে অংশ না নিলেও তারা জেএসএস (সংস্কার) গ্রুপের প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করেছে।

এবারের নির্বাচনী সমঝোতার বহিপ্রকাশ ঘটেছে নানাভাবে, সরকার দলের পক্ষ থেকে কোথাও হয়তো নিজেদের প্রার্থী না দিয়ে সহযোগী সংগঠনের প্রার্থীকে সমর্থন করা হয়েছে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহযোগী সংগঠনের প্রার্থীকে দলের প্রতীক দেয়া হয়েছে কিংবা সহযোগী সংগঠনের শক্তিশালী প্রার্থীর বিরুদ্ধে নিজেদের কোনো দুর্বল প্রার্থীকে দাঁড় করানো হয়েছে। আঞ্চলিক সংগঠনগুলোও একই কায়দায় অন্য গ্রুপের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে। নিজস্ব প্রতীক না থাকায় এ ক্ষেত্রে তারা বরং সুবিধা পেয়েছেন কিছুটা বেশি। আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর মাঠপর্যায়ের অনেক নেতাকর্মী জাতীয় দলের ব্যানারে ছদ্মবেশে থাকার কারণে তাদের রাজতৈনিক পরিচয় নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। তবে স্থানীয় জনসাধারণ তাদের কর্মকাণ্ড থেকে সহজেই বুঝতে পারেন, আসলে তারা কে কোন দলের প্রার্থী বা কোন দলের সমর্থক। নির্বাচনী ফলাফলেও এর প্রভাব ছিল নিশ্চিতভাবেই।

আ’লীগ প্রার্থী দিতে পারেনি ৮টি ইউনিয়নে
রাঙ্গামাটি জেলার অন্তত ৮টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে কাউকে প্রার্থী দিতে পারেনি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। মূলত আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ভয়ে এসব ইউনিয়নে কেউ আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন নেয়নি। এমনকি আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাওয়ার পরও নিজের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার ঘটনাও ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মুছা মাতব্বর বলেন, মূলত সন্ত্রাসকবলিত এলাকাগুলোতে কেউ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিতে চায়নি। রাঙ্গামাটি জেলায় এমন অন্তত ১৫টি ইউনিয়ন আছে বলে তিনি জানান। তবে পার্বত্যনিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে. রাঙ্গামাটির যেসব ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে তার মধ্যে ৮টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার কোনো প্রার্থী ছিল না। ইউনিয়নগুলো হচ্ছে: নানিয়ারচর উপজেলার সাবেকক্ষ্যং, ঘিলাছড়ি, বাঘাইছড়ি উপজেলার বঙ্গলতলী, সারোয়াতলী, জুরাছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়ন, বনযোগীছড়া এবং বরকল উপজেলার বড় হরিণা ইউনিয়ন। বাঘাইছড়ি উপজেলার রূপকারী ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দিলেও পরে প্রত্যাহার করে নেয়।

নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র চর্চা
আঞ্চলিক সংগঠনগুলো তাদের নিজেদের প্রভাবাধীন এলাকায় সাধারণত অন্য কোনো দলের প্রার্থীকে নির্বাচন করতে দেয়ার স্বাধীনতায় বিশ^াস করে না। কাপ্তাইয়ের একটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে গুলি করে হত্যার অভিযোগও রয়েছে জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। অনেক ইউনিয়নে আঞ্চলিক সংগঠনের সন্ত্রাসীদের ভয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করার সাহসও দেখায়নি কেউ। তাছাড়া আঞ্চলিক সংগঠনগুলো তাদের নিজেদের প্রভাবাধীন এলাকা ব্যতিত অন্য কোথাও প্রার্থী দেয় না, যা বিগত নির্বাচনগুলোতেও দেখা গেছে।

তাদের মধ্যে আরো একটি বিষয় কাজ করে, সেটি হচ্ছে সংগঠনের সিদ্ধান্তের বাইরে নিজেদের দলেরও কেউ প্রার্থী হতে পারে না। তাছাড়া তারা সাধারণত একজন করে প্রার্থীই দিয়ে থাকে। তবে এবার ব্যতিক্রম ঘটেছে কয়েকটি স্থানে। রাঙ্গামাটির জুড়াছড়ি সদর এবং বনযোগীছড়া ইউপিতে জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের একাধিক নেতা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেছেন। অন্যদিকে খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার লোগাং, চেঙ্গী এবং লক্ষীছড়ি উপজেলার বার্মাছড়ি ইউনিয়নে ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের একাধিক নেতা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেছেন। এসব ইউনিয়নে নির্বাচিত এবং নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীও ছিলো তাদের প্রার্থীরা। এর মধ্যে লক্ষীছড়ির বার্মাছড়ি ইউনিয়নে বিজয়ী এবং নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান ছিল মাত্র ৪১। অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, এসব এলাকায় সংশ্লিষ্ট সংগঠনের একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে। তাই এসব এলাকায় অন্য কোনো দল বা সংগঠনের কারো নির্বাচিত হওয়ার কোনো সাহস বা সুযোগ নেই, তারা এটা নিশ্চিত হয়েই নিজেদের নেতাদের মধ্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ।

পানছড়ির চেঙ্গী ইউনিয়নে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী নৌকা প্রতীকে মাত্র ৯৬ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন, অপরদিকে ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের এক প্রার্থী ১৪৬০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন, একই গ্রুপের অপরজন ১২৮০ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন। লক্ষীছড়ির বার্মাছড়িতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী নৌকা প্রতীকে মাত্র ৩৪ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন। আর সেখানে ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের প্রার্থী ১২৫৭ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন একই দলের অপর জন ১২১৬ ভোট পেয়ে। ভোটের এই চিত্র দেখেও ধারণা করা যায়, আসলে এসব ইউনিয়নে কেন একই গ্রুপের একাধিক প্রার্থীকে নির্বাচন করতে দেয়া হয়েছে। বিষয়টিকে স্থানীয় পর্যবেক্ষকরা দেখছেন, আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র চর্চার উদাহরণ হিসেবে। পযবেক্ষকদের মতে, আঞ্চলিক সংগঠনগুলো নিজেদের একাধিক প্রার্থী দিয়ে দেখাতে চায় যে, তারাও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যেখানে অন্যদের কোনো প্রার্থীর নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ নেই, শুধুমাত্র সেই ক্ষেত্রেই তারা নিজেদের গণতান্ত্রিক মানসিকতা দেখাতে তারা রাজি হয়।

প্রথম নারী চেয়ারম্যান মাহমুদা বেগম লাকী
প্রথমবারের মতো এবার তিন পার্বত্য জেলা থেকে একজন নারী ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি হচ্ছেন খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহমুদা বেগম লাকী। দীঘিনালায় তৃতীয় ধাপে ২৮ নভেম্বর ২০২১ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীকে ১১৮০৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জেএসএস (সংস্কার) গ্রুপের হেমাব্রত চাকমা আনারস প্রতীকে পেয়েছেন ৯১৫০ ভোট। বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার আলেক্ষ্যং ইউনিয়নে আরেক নারী মাশৈখিং মারমা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে সাড়া জাগিয়েছেন। চতুর্থ ধাপে ২৬ ডিসেম্বর ২০২১ অনুষ্ঠিত রোয়াংছড়ির ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর সাথে লড়াই করে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজের শক্ত অবস্থানের কথা জানান দিয়েছেন। এই ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের প্রার্থী ১৯১৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। অপরদিকে মাশৈখিং মারমা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আনারস প্রতীকে ১৩২৫ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন। স্নাতক পড়ুয়া মাশৈখিং মারমা রোয়াংছড়ি উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান পুহ্লা অং মারমার মেয়ে।

খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার উল্টাছড়ি ইউনিয়নের ১, ২ ও ৩ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা মেম্বার পদে তৃতীয় লিঙ্গের একজন নারী সোনালী আক্তার পাখি প্রার্থী হয়ে সাড়া ফেলেছিলেন। কিন্তু তার বয়স ২৫ বছর পূর্ণ না হওয়ায় নির্বাচন কমিশন প্রার্থিতা বাতিল করে দেয়ায় তিনি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন করতে পারেননি।

পাঁচটি ধাপে অনুষ্ঠিত পাহাড়ের ইউপি নির্বাচন
এবার নির্বাচন কমিশন মোট আটটি ধাপে সারাদেশের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। এর মধ্যে তিন পার্বত্য জেলার ইউনিয়নগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম এবং সপ্তম ধাপে। ১১ নভেম্বর ২০২১ দ্বিতীয় ধাপে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার ৭টি, গুইমারার ৩টি, রাঙ্গামাটির বরকলের ৪টি, বিলাইছড়ির ৪টি (১টি ইউপিতে স্থগিত হয়ে যায়), কাপ্তাইয়ের ৪টি, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ৫টি এবং লামার ৮টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন হয়।

২৮ নভেম্বর ২০২১ তৃতীয় ধাপে খাগড়াছড়ির দীঘিনালার ৩টি, মহালছড়ির ৪টি, রাঙ্গামাটির রাজস্থলির ৩টি, কাউখালীর ৪টি, বান্দরবানের আলীকদমের ৪টি এবং রুমার ৪টি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

২৬ ডিসেম্বর ২০২১ চতুর্থ ধাপে খাগড়াছড়ির লক্ষীছড়ির ৩টি, মানিকছড়ির ৩টি, রামগড়ের ২টি, রাঙ্গামাটি সদরের ৬টি, নানিয়ারচরের ৪টি, বান্দরবানের রোয়াংছড়ির ৪টি এবং থানচির ৪টি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

৫ জানুয়ারি ২০২২ পঞ্চম ধাপে খাগড়াছড়ি সদরের ৫টি এবং বান্দরবান সদরের ৩টি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সপ্তম ধাপে রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলার ৭টি, বাঘাইছড়ির ৮টি, জুড়াছড়ির ৪টি (২টি ইউনিয়নের নির্বাচন পরে স্থগিত হয়ে যায়), খাগড়াছড়ির পানছড়ির ৫টি এবং বান্দরবান সদরের ৩টি ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

স্থগিত ১০টি ইউনিয়নের নির্বাচন
নানা কারণে এবার পার্বত্য তিন জেলার ১০টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন হয়নি। এর মধ্যে রাঙ্গামাটিতে ৫টি ইউনিয়নের নির্বাচন হয়নি। অপরদিকে খাগড়াছড়িতে ১টি এবং বান্দরবানে ৪টি ইউনিয়নের নির্বাচন স্থগিত আছে।

রাঙ্গামাটির বরকল উপজেলার ভূষণছড়া, কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা, বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলী এবং জুরাছড়ি উপজেলার দুমদুম্যা, মৈদং ইউনিয়ন এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, সদর, সোনাইছড়ি ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। অন্যদিকে খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের দুটি কেন্দ্রের নির্বাচন স্থগিত হওয়া এবং আলীকদম সদর ইউনিয়নের নির্বাচন নিয়ে মামলা হওয়ার কারণে এই দুই ইউনিয়নে নির্বাচনী ফলাফল অমীমাংসিত রয়েছে।

বিলাইছড়ি উপজেলার ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর বড়থলী ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও আবহাওয়াজনিত সমস্যার কারণে ৯ ডিসেম্বর সিইসি হঠাৎ করে নির্বাচন স্থগিত করে। এরপর থেকে বড়থলী ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। বড়থলী ইউনিয়নে মোট ভোটার সংখ্যা ২০১৬। বড়থলী ইউনিয়ন সৃষ্টির পর ২০১৫ সালের ২৬ আগস্ট প্রথম ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো।

বরকল উপজেলার ভূষণছড়া ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ২০১৬ সালের ৪ জুন। এ নির্বাচনে মামুনুর রশীদ মামুন বিজয়ী হয়েছিলেন। তবে এ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে পুনঃনির্বাচনের দাবিতে আদালতে রিট করেছিলেন পরাজিত প্রার্থী জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের প্রার্থী দিলীপ কুমার চাকমা। নির্বাচনের পর ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর ইউপি মেম্বারদের গেজেট প্রকাশ হলে ২৯ নভেম্বর ইউপি মেম্বাররা শপথ গ্রহণ করেন। এরপর একই বছরের ১২ ডিসেম্বর রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে শপথ গ্রহণ করেন নির্বাচনে জয়ী প্রার্থী মামুনুর রশীদ মামুন।

কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনার ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনী মেয়াদকাল শেষ না হওয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। বর্তমানে এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন আওয়ামী লীগের আনোয়ার হোসেন বেবী। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ইউনিয়নটিতে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালের ১২ নভেম্বর এ ইউনিয়টিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো।

জুরাছড়ি উপজেলার দুমদুম্যা এবং মৈদং ইউনিয়নের নির্বাচন ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ হঠাৎ স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন। ৭ ফেব্রুয়ারি সপ্তম ধাপে এই ইউনিয়ন দু’টিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো। তবে কী কারণে নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে সেই প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশন সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য প্রদান করেনি।

খাগড়াছড়ির পানছড়ি সদর ইউনিয়নে সপ্তম ধাপে ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ভোটগ্রহণে অনিয়মের অভিযোগে দুটি কেন্দ্রের নির্বাচন স্থগিত করে দেয় নির্বাচন কমিশন। অপরদিকে বান্দরবানের নাক্ষ্যংছড়ি সদর, ঘুমধুম, সোনাইছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের মেয়াদ পূর্ণ না হওয়ায় এবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। আলীকদম উপজেলার সদর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন ৩৩২১ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মো. আনোয়ার জিহাদ ৩০২২ ভোট পেয়ে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী এই ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা করার কারণে এই ইউনিয়নের নির্বাচনী ফলাফল স্থগিত রয়েছে।

নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত ২
এবারের ইউপি নির্বাচনী সহিসংতায় ২ জন নিহত হয়েছেন। নিহত ২ জনই রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার বাসিন্দা। দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে এই উপজেলার চিৎমরম ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। মনোনয়ন ফরম নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়ে ১৬ অক্টোবর ২০২১ চিৎমরমের নিজ বাড়িতে মায়ের দোয়া নিতে গেলে সেদিন রাতেই ৮/১০ জন সবুজ গেঞ্জি পরিহিত সন্ত্রাসীদের একটি গ্রুপ তাকে গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের সন্ত্রাসীদের দায়ী করে বিবৃতি দেয়া হয়। এ হত্যাকাণ্ডের পর ইউনিয়নটির নির্বাচন স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন। পরে নির্বাচন কমিশন পরবর্তী ধাপের সাথে এই ইউনিয়নের নির্বাচন ২৮ নভেম্বর ২০২১ সম্পন্ন করে। এতে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী ওয়েশ্মিমং চৌধুরী নির্বাচিত হন।

অপরদিকে আওয়ামী লীগের দলীয় আন্তকোন্দলের শিকার হয়ে কাপ্তাই ৪নং ইউপির ৫নং ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী সজিবুর রহমান সজিব নিহত হন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এই ওয়ার্ডের নির্বাচন স্থগিত রয়েছে।

২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনী ফলাফল

সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের আর্কাইভ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনী ফলাফলের জেলাওয়ারি হিসাবে, রাঙামাটি জেলার ৪৮ ইউপির মধ্যে ২৩টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) সমর্থিত প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছে। এছাড়া আওয়ামীলীগ (নৌকা) ১৩টি, বিএনপি (ধানের শীষ) ১টি, ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী ৯টি ও নির্দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী ২টি ইউপিতে নির্বাচিত হয়েছে।

খাগড়াছড়ি জেলার ৩২টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ১৭টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছে। অন্য ১৪টিতে স্বতন্ত্র এবং ১টিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছে।

বান্দরবানে ৬ উপজেলার ২৫টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ১৯টিতে, বিএনপি ৪টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ২টিতে বেসরকারিভাবে জয়লাভ করেছে।

২০১১ সালের ইউপি নির্বাচনের ফলাফল
সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের আর্কাইভ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, ২০১১ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনী ফলাফলের জেলাওয়ারি হিসাবে, রাঙামাটি জেলায় ৪৯টি ইউপির মধ্যে আওয়ামী লীগ ১১টি, বিএনপি ৬টি, ইউপিডিএফ ১৬টি, জেএসএস (মূল) ১২টি, জেএসএস (সংস্কার) ২টি, স্বতন্ত্র ২টি এবং বাঙালি সংগঠন ১টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করে। এ সময় ১টি আসনে নির্বাচন স্থগিত থাকে।

খাগড়াছড়ির ৩৪টি ইউনিয়নের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৩টি, বিএনপি ৩টি, ইউপিডিএফ ১৫টি, জেএসএস(সংস্কার) ৩টি ইউনিয়নে জয়লাভ করলেও জেএসএস (মূল) ও বাঙালি সংগঠনগুলো এ জেলায় কোনো ইউপিতে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়নি।

অন্যদিকে বান্দরবানের ৩১টি ইউপির মধ্যে ২৮টিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরমধ্যে আওয়ামী লীগ ১২টি, বিএনপি ১২টি, জেএসএস (মূল) ৩টি ও স্বতন্ত্র ১টি আসনে জয়লাভ করে। ইউপিডিএফ ও বাঙালি সংগঠন এ জেলায় কোনো ইউপিতে জয় পায়নি।

তিন পার্বত্য জেলার ১১৩টি ইউপি নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ ৩৬টি বিএনপি ২২টি, জেএসএস মূল ১৫টি, জেএসএস সংস্কার ৫টি, ইউপিডিএফ ৩১টি, বাঙালি সংগঠন ১টি, স্বতন্ত্র ৩টি আসনে নির্বাচিত হয়। এসময় ৬টি আসনে নির্বাচন স্থগিত থাকে।

ইউপি নির্বাচনের ফলাফল ও পার্বত্য রাজনীতি
সর্বশেষ তিনটি ইউপি নির্বাচনের ফলাফলের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে উল্লেখ করার মতো কয়েকটি বিষয় দৃষ্টিগোচর হয়। প্রায় সবগুলো নির্বাচনেই উপজাতীয় আঞ্চলিক সংগঠনগুলো উল্লেখযোগ্য ইউনিয়নে জয়ী হয়েছে। কিন্তু সে তুলনায় বাঙালি সংগঠনের প্রার্থী ও জয়লাভের সংখ্যা প্রায় শূন্য। এমনকি বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতেও বাঙালি সংগঠন জয়লাভ করতে পারেনি। এর পেছনে তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি সংগঠনগুলো তৃণমূলের মানুষের মধ্যে স্থান করে নিতে ব্যর্থ হয়েছে। দ্বিতীয়ত, জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য বাঙালি নেতৃত্বের প্রবল অভাব। সর্বশেষ, বাঙালি নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্য অংশ জাতীয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা।

অন্যদিকে পাহাড়ি সংগঠনগুলো বিপুল ইউপিতে জয়ী হলেও তা পুরোপুরি তাদের জনপ্রিয়তার মাপকাঠি নয়। অস্বীকার করা যাবে না যে, পাহাড়ি সংগঠনগুলো সাংগঠনিকভাবে বাঙালি সংগঠনের তুলনায় অনেক বেশি সংগঠিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষ তাদের খুশি মনে ভোট দেয় এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। কেননা, পাহাড়ি সংগঠনগুলো দলীয় স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামে খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, নির্যাতন, চাঁদাবাজীসহ যেভাবে অত্যাচার-নির্যাতন করে তার প্রধান শিকার উপজাতীয় নিরীহ জনগণ। কাজেই নির্যাতিত মানুষ নির্যাতকদের খুশি মনে ভোট দেয়ার কোনো কারণ নেই। তবু তারা ভোট দেয়, মূলত দিতে বাধ্য হয়। অস্ত্রের মুখে তাদের ভোট দিতে বাধ্য করা হয়। দুর্গম এলাকাগুলোতে যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা কম, সেখানেই এই সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য। এ ধরনের এলাকাগুলোতেই তারা জয়ী হয়।

২০১৬ সালের বান্দরবান জেলার ইউপি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা এবং বর্তমান নির্বাচনী ট্রেন্ড, বিশেষ করে সরকারি দলের বাইরে প্রার্থী দিয়ে জয়লাভ করার মৃদু সম্ভাবনা থাকায় সর্বশেষ নির্বাচনে জেএসএস ও ইউপিডিএফ মূল দল ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। এক্ষেত্রে তারা বছর দুয়েক আগে থেকেই পরিকল্পনা করে তাদের প্রভাবাধীন এলাকাগুলোর অনেক জায়গায় চিহ্নিত নেতাদের সরকারি দলে যোগ দিয়ে তাদের সরকার দলীয় প্রার্থী করা হয়। এভাবে তিন পার্বত্য জেলার বেশ কিছু ইউপিতে আঞ্চলিক সংগঠনগুলো সরকার দলীয় মার্কায় তাদের প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করিয়ে এনেছে। অবশ্য এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটো দিকই রয়েছে। নতুন যোগ দেয়া এসব প্রার্থী যদি মূল জাতীয় দলের সাথে ও তাদের কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হয়, তা পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি ও উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

কিন্তু দেখা যায়, বেশিরভাগ সময়ই আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর নেতারা জাতীয় রাজনৈতিক দলে যোগ দিলেও সেসব রাজনৈতিক দলের কার্যক্রমের চেয়ে পূর্বেও আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের মিশন বাস্তবায়নে বেশি তৎপর থাকে। মূলত তারা ঐসব আঞ্চলিক সংগঠনের স্লিপার সেলের সদস্যদের মতো জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করে তাদের উদ্দেশ্য সাধন করে থাকে। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তা পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি ও উন্নয়নের জন্য বিরাট হুমকি। কেননা, তৃণমূলে নেতৃত্ব গঠন, উন্নয়ন, সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা, নির্দেশ বাস্তবায়ন ও সরকারি সহায়তা বণ্টনে ইউনিয়ন পরিষদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। অতীতে দেখা গেছে, এসব আঞ্চলিক সংগঠনের নেতারা জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করে বা স্থানীয় পরিষদের বিভিন্ন ইউপিতে নির্বাচিত হয়ে সরকারি সুবিধা সাবেক দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে বেশি বিতরণ করে আঞ্চলিক সংগঠনকে সংগঠিত করার কাজ করে। কাজেই এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ও জাতীয় রাজনৈতিক দলের জেলা ও উপজেলা কমিটিকে এ বিষয়গুলো কঠোরভাবে মনিটরিং না করলে তা পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তার জন্য হুমকির সৃষ্টি করতে পারে।

[তথ্য সহায়তা: মুজিবুর রহমান ভুইয়া, মো. নজরুল ইসলাম টিটু, মঈন উদ্দীন বাপ্পী, শাহজাহান কবির সাজু, আব্দুর রহমান, আব্দুল মান্নান, দিদারুল আলম, মো. আক্তার হোসেন, শাহাদাত, নাজমুল হোসেন রনি]

লেখক: সৈয়দ ইবনে রহমত, সাংবাদিক, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক

[email protected]

 

আরও পড়ুন:

বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসমূহের আগমন ও আদিবাস

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন