parbattanews

পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ও পরিচিতি

Untitled-1

(এক)

তবুও শান্তি হোক পাহাড়ের
কবিতা চাকমা

“জ্বলি ন উধিম কিত্তে ই!
[রুখে দাঁড়াবো না কেন!]যিয়ান পরানে কয় সিয়েন গরিবে-
[যা ইচ্ছে তাই করবে]বষততান বানের বিরানভূমি
[বসত বিরান ভূমি]ঝাড়ান বানেবে মরুভূমি,
[নিবিড় অরণ্য মরুভূমি]
অবহেলা অপমানে ক্রোধ
[অবহেলা অপমানে ক্রোধ]ভিদিরে তুবোল লোর স্রোত
[ধমনীতে তুমুল রক্তের স্রোত]পাথ্থর খুনি খুনি ভাঙে বিঘ্ন,
[আঘাতে আঘাতে ভাঙে বিঘ্ন]চেতনার সাগরত রণ তীক্ষ্ম।
[চেতনার সমুদ্র তারুণ্যে তীক্ষ্ম]-মর পরিপূরক গায় মুই-ই
[-আমার সম্পূরক একমাত্র আমিই]জ্বলি ন উধিম কিত্তেই!
[রুখে দাঁড়াবো না কেন!]”

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে পার্বত্য চট্টগ্রাম অবস্থিত। উত্তরে ও খাগড়াছড়ি জেলার পশ্চিমে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পূর্বে ভারতের মিজোরামের লুসাই পাহাড়পুঞ্জ ও মায়ানমার, দক্ষিণে মায়ানমার, পশ্চিমে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা।
 বাংলাদেশের প্রধান পার্বত্যাঞ্চল, সমতলভূমির থেকে এর রূপ সম্পূর্ণ ভিন্ন। পাহাড়পুঞ্জের মধ্যস্থলে রয়েছে উপত্যকা, যা অনেকটা সমতল; বনভূমিময় এবং রয়েছে ঝরনাধারা, যেগুলোকে বলা হয় ‘ছড়া’ বা ‘ছড়ি।’
আয়তন নিশ্চিতভাবে সম্ভব কেউ জানে না; একমতে, ৫০৯৩ বর্গমাইল, আরেক মতে, ৫১৩৮ বর্গমাইল বা ১৩০০০ বর্গ কিঃমিঃ; মোটামুটিভাবে বাংলাদেশের দশ ভাগের এক ভাগ।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়পুঞ্জ উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত। এগুলোকে দশটি ভাগে বিন্যাস্ত করা যায়: সুবলং, মায়ানি, কাসালং, সাজেক, হরিং, বরকল, রাইনখিয়াং, চিম্বুক, মিরিঞ্জা। পাহাড়গুলো সাধারণত ১০০ থেকে ৩০০০ ফুট উঁচু; সবচেয়ে উঁচু চুড়া কেওক্রাডং (২৯৬০ফুট)। সম্প্রতি কিছু তরুণ দাবী করে থাকেন এর চেয়ে উচ্চ কিছু পাহাড়ের অবস্থান তারা নির্ণয় করতে পেরেছেন।

পার্বত্য এলাকায় অভিবাসনের ইতিহাস বেশ পুরনো। সপ্তদশ শতক থেকে পার্বত্য এলাকায় অভিবাসন প্রক্রিয়া চলছে। ১৪১৮ খ্রীস্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল অধিবাসী কুকিরা; আরাকানী চাকমাদের আগ্রাসনে চাকমা রাজা মওয়ানৎসুনিপ আপার বার্মা অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হন এবং কক্সবাজারের রামু এবং টেকনাফ এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। ব্রহ্মযুদ্ধের সময় মগরা আরাকান থেকে বিতাড়িত করে চাকমাদের, তারা দলে দলে ঢোকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ও বসতি স্থাপন করে। জাতি হিসেবে তারা বিন্যস্ত হয় তিনভাগে; চাকমা, মারমা (মগ), তঞ্চগ্যানা আরাকানি; ত্রিপুরা (টিপরা), রিয়াং, ম্রোংরা ত্রিপুরী, পাংখু, বন, চক, খুমিয়া, ম্রোং, খিয়াংরা কুকি।
১৭৭৭ খ্রীস্টাব্দে রোনা খান-এর নেতৃত্বে কুকিরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে এক ব্যর্থ বিদ্রোহ সংঘটিত করে। পরবর্তী কিছুকাল বিচ্ছিন্নভাবে এ ধরনের বিদ্রোহাত্মক কাজ চলতে থাকে।
১৮৬০ খ্রীস্টাব্দে পার্বত্য এলাকাকে চট্টগ্রাম জেলা থেকে আলাদা করে একজন তত্ত্বাবধায়কের নেতৃত্বে স্বতন্ত্র জেলার মর্যাদা দেয়া হয়।
১৯০০ খ্রীস্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধি- ১৯০০ পাশ করা হয় এবং পার্বত্য এলাকাকে ‘স্বায়ত্তশাসিত’ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
১৯২০ খ্রীস্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রাম গভর্নর জেনারেলের বিশেষ তত্ত্বাবধানের আওতায় বিশেষ অঞ্চল হিসেবে ঘোষিত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান নদী সাতটি- চেঙ্গী, মায়ানি, কাসালং, কর্ণফুলি, রাইনখিয়াং, সাংগু, মাতামুহুরি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান হ্রদ কাপ্তাই; এটি একটি কৃত্রিম হ্রদ, যার আয়তন ২৬৫ বর্গমাইল। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যে কর্ণফুলি নদীতে বাঁধ (দৈর্ঘ্য ১৮০০ ফুট, উচ্চতা ১৫৩ ফুট) দেয়ার ফলে এটি সৃষ্টি হয়। এ হ্রদের জলে ডুবে যায় পুরনো রাঙ্গামাটি। নির্মিত হয় নতুন রাঙ্গামাটি শহর। এছাড়া আছে দু’টি প্রাকৃতিক হ্রদ- রাইনকিয়ানকাইন ও বোগাকাইন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা তিনটি: খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় থানা আছে ২৫টি। খাগড়াছড়িতে ৮টি: খাগড়াছড়ি, পানছড়ি, দিঘিনালা, মাটিরাঙ্গা, রামগড়, মানিকছড়ি, মহালছড়ি ও লক্ষ্মীছড়ি। সম্প্রতি গুইমারা নামে একটি নতুন থানা সৃষ্টির কাজ এগিয়ে চলছে।
রাঙ্গামাটিতে ১০টি: রাঙ্গামাটি, বাঘাইছড়ি, লংগুদু, বরকল, নানিয়রচর, কাউখালি, জুরাইছড়ি, কাপ্তাই, রাজস্থলি ও বিলাইছড়ি।
বান্দরবানে ৭টি: বান্দরবান, রোয়াংছড়ি, রুমা, লামা, থানচি, আলিকদম ও নাইক্ষংছড়ি।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৩টি উপজাতির বসবাস। এরা হলো- চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, তঞ্চগ্যা, বৌম, পাংখু, খুমি, লুসাই, খিয়াং, চাক, কুকি ও সাঁওতাল।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে জুম পদ্ধতিতে ও উপত্যকায় প্রচলিত কৃষিজ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হয়। তবে জুমই চাষের প্রধান পদ্ধতি। পাহাড় পুড়িয়ে তগল বা দা দিয়ে গর্ত খুঁড়ে একই গর্তে বোনা হয়, ধান, কার্পাস, ভুট্টা, শসা প্রভৃতির বীজ। সমতলভূমিতে উৎপাদন করা হয় ধান, সরষে, তামাক, মরিচ, বেগুন প্রভৃতি।
চাকমা, তঞ্চগ্যা ও মারমারা বৌদ্ধ, ত্রিপুরারা হিন্দু, লুসাইরা খ্রিস্টান; ম্রো, রিয়াং, খুমি, ম্রোং, বনজোগী, পাংখোলা সর্বাত্মবাদী। তবে এরাও বর্তমানে খ্রিস্টান হয়েছে ব্যাপকভাবে।

এখানকার প্রত্যেক উপজাতির রয়েছে নিজস্ব ভাষা; নিজেদের মধ্যে তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলেন; তবে ভিন্ন উপজাতির সাথে কথা বলেন বাংলায়। চাকমা, ত্রিপুরা ও মগদের প্রধান বার্ষিক উৎসব বৈসাবি  মেলা অনুষ্ঠিত হয় বাংলা বর্ষের শেষে। পুরুষরা ধূতি ও জামা পড়ে, মাথায় পরে ‘খরং’, নারীরা নিম্নাঙ্গে পরে ‘পিন্দম’, বক্ষে ‘খাদি’, তারা শাড়ি-ব্লাউজও পরে। নারীরা উৎকৃষ্ট বুননশিল্পী; তারা বুকে কারুকাজখচিত বস্ত্র, যার নাম ‘আলম।’ বাঁশের বাঁশি তাদের প্রধান বাদ্যযন্ত্র, যাতে তারা তোলে প্রেমাবেগের আকুলতা। তাদের প্রিয় ও প্রধান মহাকাব্যের বিষয় রাধামোহন ও ধনপতির বিরহবিধুর প্রেম।

ব্রিটিশ সরকার ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি সার্কেলে ভাগ করে। এদের মধ্যে বান্দরবান জেলা ও রাঙ্গামাটির কিছু অংশ নিয়ে বোমাং সার্কেল, খাগড়াছড়ি জেলাকে নিয়ে মং সার্কেল এবং রাঙ্গামাটির বেশিরভাগ এলাকা নিয়ে চাকমা সার্কেল গঠিত হয়। সার্কেল পরিচালনার জন্য একজন করে চিফ করা হয়। তাদের নাম দেয়া হয় সার্কেল চিফ। সার্কেল চিফরা নিজ সম্প্রদায়ের কাছে রাজা হিসাবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন।
রাজপূণ্যাহ অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য হচ্ছে, পার্বত্য এলাকার জুমচাষীদের সারা বছরের কাজকর্ম সেরে কিছু সময় রাজা দর্শন, বিনোদন এবং রাজকর প্রদান করা। প্রতিবছর জুম চাষের সব ফসল ঘরে তুলে ডিসেম্বর বা জানুয়ারির সুবিধামত সময়ে বান্দরবন পার্বত্য জেলায় বোমাং সার্কেলের রাজপুণ্যাহ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ১০৯টি মৌজা নিয়ে বোমাং সার্কেল গঠিত। একে বোমাং থংও বলা হয়ে থাকে। এর আয়তন ১ হাজার ৭০২ বর্গমাইল।

প্রায় তিনশ বছর আগে থেকে রাজকর আদায় অনুষ্ঠান হচ্ছে বলে বোমাং রাজপরিবার সূত্র জানালেও ১৯০০ সাল থেকে পার্বত্য শাসন বিধি চালু হওয়ার পরই রাজপূণ্যাহর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় বলে বিভিন্ন ইতিহাসে পাওয় যায়। রাজার অধীনে থাকে কারবারী, রোয়াজা ও ফাইংসিগন। প্রতি বছর বোমাং সার্কেলের রাজার আয়োজনে জাঁকজমকের সঙ্গে বান্দরবান রাজার মাঠে রাজপূণ্যাহ অনুষ্ঠিত হয়। পাঁচ থেকে সাত দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানে পার্বত্য জেলার উপজাতি, বাঙ্গালি, পার্শ্ববর্তী চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার লোকজন এবং বিদেশি পর্যটকরা ছুটে আসেন এই অনুষ্ঠান দেখতে। লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় রাজবাড়ি, রাজার মাঠ তথা বান্দরবান জেলা শহর।

রাজপুণ্যাহ মেলা পরিণত হয় গ্রাম্য লোকজ মেলায়। বোমাং তং-এর লোকজন নিয়ে বাড়ি ছেড়ে ছুটে আসে রাজদর্শনে। ইচ্ছে শুধু রাজাকে এক নজর দেখা ও আশীর্বাদ নেয়া এবং উপঢৌকন দেয়া।
বিউগলের সুর, পটকার আওয়াজ এবং তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে পুণ্যাহর প্রস্তুতি শুরু হয়। বোমার রাজা রাজকীয় পোষাক পরিধান করে রাজপ্রাসাদ থেকে ধীরে ধীরে রাজ দরবারের দিকে এগিয়ে আসেন। আসার সময় সামনে-পেছনে থাকে তলোয়ার, বন্দুক, বল্লমধারী সৈন্য সামন্ত, পাইক-পেয়াদা। আরো থাকে উজির-নাজির, দগইং, চগইং, জমাদার, হেডম্যান, কারবারী এবং আমন্ত্রিত অতিথি। লালগালিচা বিছানো পথ দিয়ে রাজা এগিয়ে যান রাজ দরবারের দিকে। উপজাতি তরুণ-তরুণীরা রাজাকে ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে অভ্যর্থনা জানায়। প্রজারা দাঁড়িয়ে সম্মান জানায়। আরেকদল ম্রো, যুবক-যুবতী প্রু হাতে নিজেদের পোষাক পরিধান করে রাজার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। রাজা বাহাদুর রাজ পোশাকে সজ্জিত হয়ে কোমরে সোনার তলোয়ার নিয়ে রাজ দরবারের সিংহখচিত রাজ আসনে গিয়ে বসেন। রাজার দুপাশে আমন্ত্রিত অতিথিরা বসেন। সবার দৃষ্টি থাকে রাজার দিকে। এ সময় রাজ দরবারে মানুষের ঢল নামে। প্রজাদের অন্তিম প্রার্থনা থাকে- দেবতুল্য রাজা যেন দীর্ঘজীবী হোন।

বোমাং রাজবংশ মিয়ানমারের আরাকান পেগু রাজবংশের উত্তরসূরি। কালের পরিক্রমায় ১৮২২ সালে বিভিন্ন কারণে তারা বান্দরবানে বসতি স্থাপন করেন। তৎকালীন রাজা ছিলেন সাক থাই প্রু বামাংগ্রী। তখন থেকে এ পর্যন্ত বংশানুক্রমিকভাবে এই রাজপ্রথা চালু রয়েছে। এক নজরে বোমাং রাজবংশের সদস্যগণ-
১.    মং চ পাই বোমাং ১৬১৪-১৬৩০ খ্রিষ্টাব্দ।
২.    মং গ্রই প্র“ বোমাং ১৬৩০-১৬৬৫ খ্রিষ্টাব্দ।
৩.    হেরি প্র“ বোমাং ১৬৬৫-১৬৮৭ খ্রিষ্টাব্দ।
৪.    হেরি ঞো বোমাংগ্রী ১৬৮৭-১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দ।
৫.    কং হা প্র“ বোমাংগ্রী ১৭২৭-১৮১১ খ্রিষ্টাব্দ।
৬.   সাক থাই প্র“ বোমাংগ্রী ১৮১১-১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দ।
৭.   কং হা ঞো বোমাংগ্রী ১৮৪০-১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দ।
০৮.   মং প্রু বোমাংগ্রী ১৮৬৬-১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দ।
০৯.    সাক হ্নাই ঞো বোমাংগ্রী ১৮৭৫-১৯০১ খ্রিষ্টাব্দ।
১০.    চ হা প্রু বোমাংগ্রী ১৯০১-১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দ।
১১.    মং সা ঞো বোমাংগ্রী ১৯১৬-১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ।
১২.    ক্যা জাই প্রু বোমাংগ্রী ১৯২৩-১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দ।
১৩.    ক্যা জ সাই বোমাংগ্রী ১৯৩৩-১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দ।
১৪.    মং শোয়ে প্রু বোমাংগ্রী ১৯৫৯-১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দ।
১৫.    বোমাংগ্রী অং শৈ প্রু চৌধুরী ১৯৯৭- ৮-৮২০১২।  

১৬. ক্য সাইন প্রু ২০-১১-২০১২ –  ৬-২-২০১৩।

১৭. উ চ্য প্রু ৪-৪- ২০১৩ থেকে চলমান

রাজপূণ্যাহতে প্রজারা রাজকর দিয়ে থাকেন। প্রথম শ্রেণীর ভূমির জন্য একরপ্রতি তিন টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণীর জন্য দুই টাকা এবং তৃতীয় শ্রেণীর জন্য এক টাকা হারে রাজকর দেয়া হয়। এছাড়া জুম চাষীরা পরিবার প্রতি ছয় টাকা হারে কর এবং ঐতিহ্যবাহী অইং (প্রথাগত) নজরানা রাজাকে দিয়ে থাকেন। অইংয়ের মধ্যে রয়েছে এক আরি চাল, একটি মোরগ, এক বোতল মদ, এক বোতল চিংরে এবং এক হাঁড়ি স্বাপাইট।
রাজার রাজ্য শাসন পদ্ধতি ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের আগে চালু ছিল। রাজপ্রাসাদ, রাজার জৌলুস, সৈন্য সামন্ত ইত্যাদির তৎকালীন সময়ে চালু থাকলেও ব্রিটিশ শাসনের পর থেকে এ দেশ থেকে তা উঠে যায়। ব্রিটেনের রাজা-রানীর মতো ক্ষমতাধর না হলেও প্রতীক হিসেবে হলেও বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলার রাজপ্রথা চালু রয়েছে।

বোমাং অর্থ সেনাপতি, তৎকালীন আরাকানের মোগল অনুগত শাসক মংখমং পর্তুগিজদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তার শ্যালক মংচ পাই-কে পাঠালে এক সফল অভিযানে পর্তুগিজদের বিতাড়ন করলে তার ভগ্নিপতি কর্তৃক বোমাং উপাধি লাভ করেন।
মাংখমংয়ের মৃত্যুর পর মংচপাই রাজ্যের উত্তরাধিকারী হন। তার মৃত্যুর পর দুই পুত্র চাইন্দা উইজাইয়াহ ও হেরিঞো পেগু রাজ্য পরিচালনা করেন। এ সময় চাইন্দা মোগল সরকারকে কর দিতে অস্বীকার করেন এবং ১৭১০ সালে অভিযান চালিয়ে চট্টগ্রামের কিছু অঞ্চল মোগল সরকার থেকে দখল করে নেন। এ সময় চাইন্দাকে তার ভাই হেরিঞো যুদ্ধে সহায়তা করেন। যুদ্ধে সহায়তার জন্য হেরিঞোকে চাইন্দা রাজা বোমাংগ্রী উপাধিতে ভূষিত করেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান পইংজা পোওয়ে (রাজপুণ্যাহ)। এটি একটি ঐতিহ্যবাহী রাজস্ব আদায়ী উৎসব। তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি উপজাতি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক ভাবগাম্ভীর্যসম্পন্ন এই অনুষ্ঠান সুদীর্ঘকাল ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে কর আদায়ের জন্য মূলত এই অনুষ্ঠান হতো। রাজ্য ও রাজদণ্ডহীন রাজা খাজনা আদায়কাজ ছাড়া সামাজিক বিভেদ মীমাংসা ও ভূমি বিরোধ বিষয়ে রিপোর্ট প্রদান করে থাকেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান বা সমাজপতি তিন রাজা- চাকমা, মং, ও বোমাং রাজা। রাজারা নিজ নিজ সার্কেল বা এলাকার প্রধান, সমাজ শাসনের ও কর আদায়ের দায়িত্ব তাদের। কর আদায়ের জন্য নিযুক্ত হতো দেওয়ানরা, যারা ছিল খুবই শক্তিমান। ১৯০০ সালে দেওয়ান পদটি লুপ্ত হয়। শাসনের জন্য প্রতিটি মৌজার জন্য আছে একজন করে ‘হেডম্যান’, আর পাড়া/গ্রামের জন্য ‘কারবারি।’ তারা অনেকটা পাহাড়ি যাযাবর; হেডম্যান বা কারবারির অনুমতি নিয়ে তারা বিশেষ পাহাড়ে বা ভূমিতে থাকতে ও চাষ করতে পারে। এক অর্থে তারা চিরউদ্বাস্তু। চাকমাদের বিচারপদ্ধতিকে বলা হয় ‘লাজের বাহার।’ প্রতিটি উপজাতি বিভক্ত কয়েকটি গোত্রে; যেমন, ম্রোংদের আছে পাঁচটি গোত্র, মগদের একুশটি, চাকমাদের চব্বিশটি।

Exit mobile version