পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙ্গালীরা শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের শিকার

ee

মো: শামীম উদ্দিন:

পার্বত্য চট্টগ্রামে স্মরণাতিতকাল যাবত বসবাসরত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী শিক্ষাক্ষেত্রে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। আবহমানকাল ধরে সরকারের উদাসীনতা, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের বৈরীতা, চরম শিক্ষা বৈষম্য, অসহনীয় দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত বাঙ্গালীরা উঠে আসতে পারছে না। অপরদিকে শিক্ষা সম্প্রসারণে সরকারের সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে উপজাতীয়রা। তাদের জন্য কোটা ব্যবস্থা চালু আছে এবং চাকুরী কর্মসংস্থান সৃষ্টির সকল পথ উন্মুক্ত করা হয়েছে। ফলে সব দিক থেকে উঠে আসছে শুধুমাত্র উপজাতীয়রা। মূল স্রোতধারার অধিবাসীদের পেছনে ফেলে বাংলাদেশ তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের অভিবাসী উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর এরূপ এগিয়ে যাওয়ার নজীর বিশ্বে বিরল।

 ৫০৯৩ বর্গমাইল আয়তনের পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, ও বান্দরবান এই তিনটি জেলা নিয়ে গঠিত । ৫২ ভাগ বাঙ্গালী ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ১৩টি উপজাতির সমন্বয়ে ৪৮ ভাগ উপজাতি জনসংখ্যা অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অপার সম্ভবনার এক ভূমি। এখানকার সবুজের আচ্ছাদন, টেউ তোলা পাহাড়, বহমান ঝর্ণা, পশুপাখির পদচারণায় মুখরিত বনবনানী, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জনপদে প্রায় ২০ লাখ শান্তিপ্রিয় এবং প্রকৃতির মত উদার জনগোষ্ঠির বসবাস সত্যিই সকলকে বিমুগ্ধ করে তোলে। এই পার্বত্য চট্টগ্রামের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে যে যার মত করে অনেকেই দূর, বহু দূর থেকে এদেশের ১০ ভাগের এক ভাগ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত পার্বত্য চট্টগ্রামে ছুটে এসেছে। কি দেশী, কি বিদেশী দেশ, দাতা সংস্থা, বেসরকারী সাহায্য সংস্থা, মানবাধিকার সংস্থা ও বিভিন্ন সংগঠন, জাতিসংঘ সকলেই দোলা দিয়েছে এবং দিচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উন্নয়ন, সেবা, সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে মানবতাবোধের পরিচয়ে পাহাড়ের মানুষকে ধন্য করেছে। তবে আশাহত হয়েছে একটি জনগোষ্ঠী। বিশেষ করে শিক্ষা এবং চাকুরী বৈষম্যে পিছিয়ে পড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিম জনগোষ্ঠী বাঙ্গালীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে।

 একই আলো বাতাসে বেড়ে উঠা পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্ধেকের বেশী (৫২%) বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী শিক্ষা এবং চাকুরী ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর এদেশের কোটি কোটি মানুষের দাবীকে উপেক্ষা করে সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি এই বৈষম্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এই চুক্তি বাস্তবায়নের দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে। চুক্তির পূর্ণবাস্তবায়ন হলে পাহাড়ের বঞ্চিত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী আরো চরম বৈষম্যের মুখোমুখি এমনকি অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশংকা রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙ্গালীরা শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে যে সব বৈষম্যের শিকার হয়েছে এবং হচ্ছে তা শান্তিচুক্তি ও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নীতির আলোকে বিশ্লেষণ করা হল:

 ১) চুক্তির ঘ অংশের ১০ অনুচ্ছেদে উপজাতীয় জনগোষ্ঠির জন্য চাকুরী ও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে যে সকল বিশেষ সুযোগ সুবিধা অতীতে সৃষ্টি করা হয়েছিল তা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অথচ বাঙ্গালীদের জন্য এইরকম কোন বিশেষ সুযোগ সুবিধা রাখা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সব বাঙ্গালী বসবাস করে তাদের শতকরা ৯৫ ভাগ রয়েছে দারিদ্র সীমার নীচে। লেখাপড়ার ক্ষেত্রে তারাই সবচেয়ে বেশি অনগ্রসর। বর্তমানে উপজাতীদের স্বাক্ষরতার হার ৮৭% আর বাঙ্গালীদের স্বাক্ষরতার হার ৪৭%।

b child

 ২) উপজাতীয় শিক্ষার্থীরা সরকারী বৃত্তি ছাড়াও সামান্যতম কৃতিত্বের কারণে অথবা দারিদ্রতার অজুহাতে কার্যক্ষেত্রে সঙ্গত কারণ ব্যতিত কেবল উপজাতীয় হবার সুবাদে পার্বত্য জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য মন্ত্রণালয়, উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসন, পৌরসভা সমূহ থেকে বৃত্তির মোটা অংকের অর্থ পেয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বাঙ্গালী শিক্ষার্থীরা তাদের থেকে যোগ্যতা সম্পন্ন ও দারিদ্রতার শিকার হয়েও উপেক্ষিত হচ্ছে।

 ৩) এম ফিল, পিএইচডি কোর্সে স্কালারশীপ, ফেলোশীপ উপজাতীয়দের জন্য খুবই সহজ, কিন্তু বাঙালীদের জন্য কষ্টসাধ্য।

 ৪) চুক্তির ১৮ নং ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রামে সকল সরকারী, আধা সরকারী, স্বায়ত্বশাসিত দপ্তরে সকলস্তরের কর্মকর্তা ও বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মচারী পদে উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হবে বলে আইন করা হয়। এক্ষেত্রে বাঙ্গালীদের অধিকার চরমভাবে খর্ব করা হয়েছে।

 ৫) উপজাতীয়রা সামান্যতম শিক্ষার বদৌলতে বিভিন্ন সরকারী, আধা সরকারী, স্বায়ত্বশাসিত দপ্তরে চাকুরী পাচ্ছে। কিন্তু বাঙালীদেরকে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।

 ৬) দেশী বিদেশী বিভিন্ন বেসরকারী সাহয্য সংস্থা (এনজিও ), বিদেশী সংস্থাগুলোতে ( জাতিসংঘ, ডানিডা ইত্যাদি ) উপজাতীয়দের একচেটিয়াভাবে চাকুরী, কর্মসংস্থানের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। তাদের মাঝেই শিক্ষা সম্প্রসারণে ব্যস্ততা পরিলক্ষিত হচ্ছে। উপজাতীয় এলাকাগুলোতে একের পর এক গড়ে উঠছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাঙ্গালী অধ্যুষিত এলাকায় এই সব শিক্ষা কার্যক্রম চোখে পড়ে না বললেই চলে।

 ৭) যেকোন চাকুরী ক্ষেত্রে উপজাতীয়দের বয়স সীমা বাঙ্গালীদের চেয়ে ৫/১০ বছর বাড়ানো হয়েছে।

 ৮) জনসংখ্যা ১% এর কম হলেও জাতীয় চাকুরীর ক্ষেত্রে উপজাতীয়দের জন্য ৫% আসন সংরক্ষিত। কিন্তু বাঙালীদের জন্য এই সুবিধা নেই। এ সকল সুযোগ সুবিধার ফলে ৮০’র দশকেই ২৩৪৫ জন উপজাতীয় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে চাকুরী পেয়েছে। ২০০৩ সালে চাকুরীরত উপজাতীয়দের সংখ্যা ৫ হাজারের বেশী ছিল বলে বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়। বর্তমানে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫ হাজারে। সে হারে বাঙ্গালীরা তেমন চাকুরী পায় না।

 ৯) সরকার পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে উপজাতীয় ছাত্রছাত্রীদের জন্য ১৩টি ছাত্রাবাস করে দিয়েছে অথছ বাঙ্গালীদের জন্য ০১টি (২০০৮ সালে স্থাপিত )।

 ১০) দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, বি আই টি, ক্যাডেট কলেজ, পলিটেকনিক কলেজসমূহসহ সকল উচ্চ প্রতিষ্ঠানে প্রতি বিষয়ে দুই থেকে পাঁচ জন ছাত্রছাত্রী উপজাতীয় কোটায় ভর্তির সুযোগ পায়, এক্ষেত্রে বাঙ্গালীদের অধিকার চরমভাবে খর্ব করা হয়েছে।

 ১১) বিসিএস পরীক্ষায় উপজাতীয় প্রার্থীদের জন্য ২৫% কোটা সংরক্ষণ করা হয়েছে এক্ষেত্রে বাঙ্গালী প্রার্থীদের বঞ্চিত করা হয়েছে।

 ১২) বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে হাজার হাজার উপজাতীয় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, সেনা অফিসার, প্রশাসনে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, শিক্ষক, ব্যাংকার, পুলিশ কর্মকর্তা, এনজিও কর্মকর্তা, বিদেশী সংস্থার কর্মকর্তা খুঁজে পাওয়া যাবে। বিপরীতে পার্বত্য অঞ্চলের বাঙ্গালীদের সংখ্যা হাজার তো দূরের কথা শতের কোটাও পার হতে পারেনি।

 সরকারের উচিত অতি দ্রুত পার্বত্য এলাকার বাঙ্গালীদের শিক্ষা, আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা, তার সাথে বৈষম্যমূলক শান্তিচুক্তি বাতিল করা তা না হলে সরকার অচিরেই পার্বত্য এলকার নিয়ন্ত্রণ হারাবে ।

♦ মাটিরাঙ্গা থেকে

 

 

 

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন