parbattanews

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ গোষ্ঠির অতিআগ্রহ বন্ধ করতে হবে

মেহেদী হাসান পলাশ 

মেহেদী হাসান পলাশ:

গত ৪ সেপ্টেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্য শান্তিচুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনকারী বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে বলেন, অনেক লোক এখন পার্বত্য চট্টগ্রামে আসে এবং তাদের অভিভাবকত্ব দেখায়। তাদের কেউ কেউ পাহাড়ি লোকদের শুভাকাঙ্ক্ষী ও বন্ধুর ন্যায় আচরণ করে। তাদের নানা উপদেশ দেয়। তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমি বলতে চাই যে, এই পাহাড়িরা আমাদের নাগরিক, কেউ না চাইলেও আমরা তাদের ভালো-মন্দের দিকে খুব গভীরভাবে খেয়াল করবো।’ তিনি আরো বলেন, ‘পাহাড়িদের অত্যন্ত কঠিন সময়ে যখন ওই বন্ধুদের এখানে আসতে দেয়া হয়নি এবং ওই সময় তারা এর বিরুদ্ধে কোন কথাও বলেনি, তখন আমরা স্বেচ্ছায় ওই শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেছি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শান্তিচুক্তির সুবিধা নিয়ে এখন তারা এখানে আসে বন্ধুর মতো। কিন্তু তাদের অভিপ্রায় সম্পর্কে আমি স্পষ্ট নই। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার মাধ্যমে প্রতিটি নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করতে সর্বদা সজাগ রয়েছি। আমরা সকলে একসাথে মিলে কাজ করবো যাতে কেউ যেন জটিলতা সৃষ্টি করতে না পারে।’

পার্বত্য সংকটের জন্য ১৯৭৫ পরবর্তী সরকারকে দায়ী করে শেখ হাসিনা বলেন, “পঁচাত্তর পরবর্তী সরকার ওখানে কিছু লোক পাঠিয়ে সমস্যার সৃষ্টি করে, যা হওয়া উচিত ছিল না।”

প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে ‘কিছু লোক’ বলতে মূলত বাঙালীদেরকেই বুঝিয়েছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রাচীন বাংলার হরিকেল রাজ্যের অংশ হিসাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে আগে থেকেই বাঙালীর বসতি ছিল। অধুনাকালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি পুনর্বাসন শুরু হয়েছে পাকিস্তান আমল থেকে। স্বাধীন বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা প্রথম অনুভব ও ঘোষণা করেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিই বলেছিলেন, ‘তোরা সব বাঙালী হয়ে যা..’; ‘ প্রয়োজনে ৫/৭ লাখ বাঙালী পাঠিয়ে তোদের উচ্ছেদ করে দেবো’। তবে এ কথা ঠিক যে, ব্যাপকহারে বাঙালী পূনর্বাসন শুরু হয়েছে ’৭৫ পরবর্তী সরকারের আমলে যখন পাহাড়ীদের একাংশ স্বাধীন জুম্মল্যান্ড গঠনের নামে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুুলে নিয়ে যুদ্ধ শুরু করে এবং সরকার উন্নয়ন বোর্ড গঠন করে পার্বত্যাঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে।

বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়ে ‘সমস্যার সৃষ্টি’ করেনি বরং দেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা রক্ষা ও উন্নয়নের সহায়ক হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সরকারি নীতি, কার্যক্রম বাস্তবায়নের অংশীদারে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী রাঙামাটিতে যে মেডিক্যাল কলেজ ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাফলক উন্মোচন করে এসেছেন তার সরাসরি বিরোধিতায় নেমেছে সন্তু লারমা, তার দল ও চেতনার অনুসারীরা। আর প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করছে সেই ‘কিছু লোকেরা’ বা বাঙালিরা। এটাই বাস্তবতা। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর সন্দেহজনক ও প্রশ্নবিদ্ধ আগ্রহকে যথার্থই শনাক্ত করেছেন।

সম্পদ, সম্ভাবনা, প্রাচুর্য, বৈচিত্র্য, ভৌগলিক অবস্থান প্রভৃতি বিচারে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সেকারণে বাংলাদেশের এই অংশ নিয়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের লোলুপ দৃষ্টি দীর্ঘ দিনের। ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের চক্রান্ত বাস্তবায়নে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি দাতা সংস্থা, এনজিও ও মিশনারি গোষ্ঠীর সাহায্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রয়েছে। তাদের লক্ষ্য এই অঞ্চলকে ঘিরে একটি স্বাধীন খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
এই উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশের বিদায় ঘণ্টা বাজার পর শেষ মরণ-কামড় হিসেবে চেষ্টা হয়েছিল ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, আমাদের তিন পার্বত্য জেলা, চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের দক্ষিণাংশ এবং মিয়ানমারের সন্নিহিত অঞ্চল নিয়ে একটি ‘ক্রাউন কলোনি’ গঠন করার। প্রস্তাব করা হয়েছিল : এই অঞ্চলটি উপমহাদেশের স্বাধীনতার আলোচনার বাইরে থাকবে এবং সরাসরি ব্রিটিশ শাসনে থেকে যাবে। চল্লিশের দশকে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ে, ব্রিটিশ মন্ত্রিসভায়, ভাইসরয়ের দফতরে এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। ব্রিটিশ আমলা রিজিনাল্ড কুপল্যান্ড এই পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন। এজন্য একে ‘কুপল্যান্ড প্লান’ নামে অভিহিত করা হয়। তবে এর পেছনে আসল কুশীলব ছিল খ্রিস্টান চার্চ সম্প্রদায়। তাদের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ছিল এই অঞ্চলটিকে আরও কিছুকাল সরাসরি ব্রিটিশ শাসনে রেখে সেখানে খ্রিস্টীয়করণের কাজটি সম্পন্ন করা। অতঃপর সেখানে একটি ‘খ্রিস্টান রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করা। পার্বত্য চট্টগ্রামে সক্রিয় বিদেশি এনজিও, দাতা সংস্থা ও মিশনারিদের তৎপতায় এ কথা স্পষ্ট যে, তারা কুপল্যান্ড প্লান বাস্তবায়নে সক্রিয় এবং ক্ষেত্র প্রস্তুতে অনেকাংশে সফল। এ ক্ষেত্রে তাদের ইস্ট তিমুর ও সাউথ সুদানের সাফল্য উজ্জীবিত করেছে। অন্যদিকে ’৯০ দশকের শুরুর দিকে জার্মানীর এক সম্মেলনে ইউরোপের একজন সমর বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ভারতের সেভেনসিস্টার্সের ত্রিপুরা, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, অরুনাচল ও মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চল নিয়ে বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন ইসরাইলের মতো একটি খ্রিস্টান বাফার স্টেট তৈরির ধারণা প্রকাশ করেন- যে রাষ্ট্রটির আকার হবে সাপের মতো, যার একদিকে থাকবে বঙ্গোপসাগর এবং অন্যদিকে থাকবে চীন সীমান্ত।

পার্বত্য চট্টগ্রামকে একই পথে এগিয়ে নিতে তারা দুইটি প্রক্রিয়ার উপর জোর দিচ্ছে। এর একটি হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতীয়দের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি আদায় এবং অন্যটি তাদের খ্রিস্টানকরণ। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতীয়রা দীর্ঘদিন নিজেদের উপজাতীয় পরিচয়ে সন্তষ্ট থাকলেও সেখানে সক্রিয় বিদেশি সংস্থাগুলো তাদেরকে আদিবাসী পরিচয়ের স্বীকৃতি আদায়ে উদ্বুদ্ধ করে মাঠে নামিয়েছে। উদ্দেশ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি পেলে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক চার্টার অনুযায়ী সেখানকার উপজাতীয়রা রাজনৈতিক স্ট্যাটাস, সরকার, জাতীয়তা, সম্পদ, ভূমি প্রভৃতির উপর স্বাতন্ত্র্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে যাতে রাষ্ট্রও কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। ফলে তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সহজতর হবে- যা রক্ষায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী এগিয়ে আসবে ইস্ট তিমুর ও সাউথ সুদানের মতো। আবার পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা, মিজো, ত্রিপুরা উপজাতিরা আদিবাসী স্বীকৃতি পেলে তাদের মূল আদিবাস ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্য মিজোরাম, ত্রিপুরা, আসাম প্রভৃতি ও মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য আদিবাসী অধ্যুষিত রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতির দাবিদার হবে। ফলে কুপল্যান্ড প্লান বাস্তবায়ন সহজতর হবে।

কুপল্যান্ড প্লান বাস্তবায়নে তাদের দ্বিতীয় পরিকল্পনা হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি খ্রিস্টান অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা। এই লক্ষ্যে তিন পার্বত্য জেলা, কক্সবাজার ও সন্নিহিত চট্টগ্রামে কয়েকটি উপজেলায় বিভিন্ন দাতা দেশ, এনজিও এবং মিশনারি সংস্থার সহায়তায় ধর্মান্তরকরণ মিশন পরিচালিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর থেকে এই প্রক্রিয়া আরও জোরদার হয়েছে। এ লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে কয়েকশ’ এনজিও ও মিশনারি প্রতিষ্ঠান কর্মরত রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সক্রিয় এনজিওগুলো হচ্ছে সাস, ইমডো আশিকা, প্রশিকা, জুম্ম ফুল, প্রগোসিভ, এইচডিও, পার্বত্য সমাজসেবা ফাউন্ডেশন, ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন, বরগাঙ, হীমাওয়ামপিয়া, পার্বত্য বৌদ্ধ মিশন, এফপিএবি, ইপেক, ব্রাক (শিক্ষা), এডাব, ব্রাক (আরডিপি অ্যান্ড হেলথ), সিএইচটি এইচ আরও, এমএসএফ, হামারি, ব্রাফা, পরিবার পরিকল্পনা, হিল গ্রাস রুটস ওমেস, ঝুমভিউ ফাউন্ডেশন, এইচআরডিপি, কপোসেবা সংঘ, আশা, আইডিএফ, আরএলটি, কেয়ার, গ্রিনহিল, পাজুরিকো, মনোঘর শিশু সদন, আনন্দ, মিলনপুর মহিলা সমিতি, হিউম্যনিটি, জুমচাবা মেট্টা ফাউন্ডেশন, সাইনিংহিল, হিল ফ্লাওয়ার, পার্বত্য পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন, জুমবি মহিলা কল্যাণ সমিতি, তৃণমূল, আলো, জাবারং, কাবিদাং, টংগা, সংবি মহিলা কল্যাণ সমিতি, ডানিডার তৈমু, হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন, অন্যনা, কল্যাণ সংঘ, ইকো ডেভেলপমেন্ট ও হোপ ব্রিজ, হিলেহিলি, কাপেং ফাউন্ডেশন, সিএইচটি কমিশন, ওয়ার্ল্ড ভিশন, কারিতাস প্রভৃতি। অপরদিকে দাতা গোষ্ঠী ইউএনডিপির সহায়তায় রাঙ্গামাটিতে ৫টি এনজিও কাজ করছে। এগুলো হচ্ছে- সিআইপিডি, আরডিএ, টিভিও, ঝুম প্রহর, সিএইচটিডিএফ, সিএইচটিএনএফ ও এইচএইচপিএফ প্রভৃতি। এছাড়াও ইউএনডিপি, ডিএফআইডি, ডানিডা, এইচএমএফ, আক্সফামের মতো বেশ কিছু আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন উন্নয়ন সংস্থা পার্বত্য চট্টগ্রামে কাজ করছে।
মিশনারি সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে, এডভান্টিজ চার্চ অব বাংলাদেশ, খ্রিস্টান কমিশন ফর ডেভলপমেন্ট বাংলাদেশ (সিসিডিবি), ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টান চার্চ, শান্তিরানী ক্যাথলিক চার্চ, গসপেল এশিয়া, কুইন ফাতেমা ক্যাথলিক চার্চ, ট্রাইবাল ব্যাপ্টিস্ট চার্চ, বাংলাদেশ ব্যাপ্টিস্ট ফেডারেশন, বাংলাদেশ ইউনাইটেড ক্রিশ্চিয়ান এসোসিয়েশন, সেভেন্থ ডে এডভেন্টিস্ট চার্চ অব বাংলাদেশ, ক্যাথলিক চার্চ, ইয়ং উইমেন ক্রিশ্চিয়ান অ্যাসোসিয়েশন প্রভৃতি। এসব এনজিও, দাতা সংস্থা ও মিশনারিদের অনেকগুলোর বিরুদ্ধে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে ক্রিশ্চিয়ানাইজেশনের প্রমাণিত অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ইতোপূর্বে দুইটি সরেজমিন অনুসন্ধান পরিচালনা করা হয়েছে, যার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যাবলী নিয়ে তারা দুইটি গোপনীয় রিপোর্ট সরকারের উচ্চ পর্যায়ে প্রেরণ করেছে। এ দুইটি রিপোর্টই আমার দেখবার সুযোগ হয়েছে। এসব রিপোর্টে পার্বত্য চট্টগ্রামে সক্রিয় এনজিও, উন্নয়ন সংস্থা ও মিশনারি সংস্থাসমূহের বিরাট অংশের বিরুদ্ধে ক্রিশ্চিয়ানাইজেশনের কার্যক্রমে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট প্রমাণসহ অভিযোগ করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর অর্থে পরিচালিত মানবসেবার নামে গড়ে ওঠা এ এনজিওগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন উঠেছে। তাদের মিশন-ভিশন কি তাও জানা নেই কারো। বিস্ময়কর বিষয় হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে শত শত এনজিওর সাইনবোর্ড চোখে পড়লেও স্থানীয় প্রশাসনের কাছে তার কোন সঠিক তথ্য নেই। জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে এনজিওগুলোর কাজ করার কথা থাকলেও এনজিও কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে এ নীতিমালা ও নির্দেশনা মানছে না তারা।
অভিযোগে জানা যায়, এনজিও এবং দাতাসংস্থার ছদ্মাবরণে পার্বত্য চট্টগ্রামে চলছে বিদেশি নাগরিকদের গোপন সফর, পার্বত্য চট্টগ্রামে সার্বভৌমত্ববিরোধী তৎপরতা, সাম্প্রদায়িক উস্কানি, দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ লোপাট। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠী ও এনজিগুলো পার্বত্যাঞ্চলে প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা ব্যয় করলেও এ উন্নয়ন সুবিধা এবং কর্মকাণ্ডের সাহায্য সমভাবে বণ্টন হচ্ছে না। পার্বত্যাঞ্চলে এনজিওগুলোর সুবিধা থেকে বাঙালিসহ ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করে গোষ্ঠী বিশেষকে পুনর্বাসন ও ব্যাপক দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ লোপাট করা হচ্ছে। বলা হয়ে থাকে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদেশি দাতা সংস্থা ১০ ডলার ব্যয় করলে তার ৫ ডলার ব্যয় হয় কর্মকর্তাদের বেতন ও ব্যবস্থাপনা বাবদ, ৩ ডলার ব্যয় হয় স্থানীয় প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি, গণমাধ্যম ও সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিবর্গের উপহার প্রদান, বিদেশ ভ্রমণ বাবদ, বাকি ২ ডলার ব্যয় হয় টার্গেট জনগোষ্ঠীর জন্য। অথচ সমগ্র ১০ ডলারের ঋণ শোধ করতে হয় বাংলাদেশকে।

এসব এনজিও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো এনজিও কাজ করতে গেলে আঞ্চলিক পরিষদের অনুমোদন লাগে। এছাড়াও রয়েছে সিএইচটি এনজিও ফোরাম বা সিএইচটিএনএফ-পার্বত্য চট্টগ্রামে কাজ পেতে গেলে তাদেরও অনুমোদন নিতে হয়। জানা গেছে, বাঙালিদের কোনো এনজিও বা বাঙালি এলাকায় প্রকল্প করে কোনো এনজিও কাজ করতে চাইলে উল্লিখিত সংগঠনগুলো তাদের সিএইচটিতে কাজ করার অনুমতি দেয় না সাধারণত।

সূত্র জানায়, উল্লেখিত এনজিওগুলোর মাধ্যমে রাঙ্গামাটির বিভিন্ন উপজেলায় ২২৫টি প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৯টি ক্ষুদ্র প্রকল্প বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায়। এভাবে তিন পার্বত্য জেলায় ১৫০টি এনজিওর মাধ্যমে প্রায় কয়েক হাজার প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পের সুবিধা থেকে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে দেয়া হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে একাধিক এনজিও নানা ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও তাদের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, মিশন ও ভিশন নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। দাতা গোষ্ঠী ও এনজিওর উন্নয়ন সুবিধা এবং সাহায্য সমভাবে বণ্টন হচ্ছে না। সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন সুবিধার মতো বিদেশি সাহায্যপুষ্ট দাতাগোষ্ঠী এবং এনজিওর প্রকল্পের সুবিধা ও প্রকল্পে কর্মকর্তা-কর্মচারি নিয়োগেও একটি গোষ্ঠীকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব উন্নয়ন বৈষম্যের ফলে এ অঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে দিন দিন ক্ষোভ বাড়ছে।

এনজিও ও এই মিশনারিরা মিলে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের দারিদ্র্য বিমোচনের কথা বলে, উন্নত শিক্ষা, বিদেশ গমন, স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মসংস্থানের কথা বলে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত করছে। ইতোমধ্যে পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী চাকমা উপজাতির ৩০%, মারমাদের ৫০% এবং ত্রিপুরাদের ৭০% জনগোষ্ঠী খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। অন্যান্য ক্ষুদ্র পাঙ্খো, লুসাই, মুরং, চাক প্রভৃতি সম্প্রদায়ের প্রায় ১০০% খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে গেছে। বিস্ময়ের ব্যাপার উপজাতীয় জনগোষ্ঠীগুলো দ্রুত খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হলেও উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ- রাজা, হেডম্যান, সমাজপতি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে নীরব। পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ ও হিন্দুরাই মূলত দ্রুত ক্রিশ্চিয়ানাইজেশনের শিকার হচ্ছে। তা নিয়ে এই দুই ধর্মীয় নেতারাও রহস্যজনকভাবে নিরব। অতীতে জেএসএস নেতা সন্তু লারমা কিছু কথা বললেও বর্তমানে তিনিও নীরব। কেবল কোনো উপজাতি মুসলিম হলে তাকে নিয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠেন তারা। তাদের সমর্থন দেয় উল্লিখিত এনজিওগুলো। তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম বা দেশের যেখানে পালিয়ে যাক তাদের ধরে এনে পূর্বধর্মে প্রত্যাবর্তনে বাধ্য করা হয়।

উল্লিখিত রিপোর্ট দুইটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মিশনারি সংস্থাগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের অসহায়, দরিদ্র, অনগ্রসর শিশুদের ফ্রি শিক্ষা, খাবার প্রদানের কথা বলে তাদের স্কুলগুলোতে নিয়ে আসলেও সেখানে তাদের স্বধর্ম শিক্ষা ও চর্চার কোনো ব্যবস্থা নেই। বরং সেখানে বাধ্যতামূলকভাবে খ্রিস্ট ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ ও উপাসনায় শরীক হতে হয়। এছাড়াও বিনামূল্যে দেশি-বিদেশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাগ্রহণ, চাকরি প্রভৃতির প্রলোভনে তাদের ধর্মান্তর করা হয়। শুধু ধর্মান্তরকরণই নয়, এসব স্কুলে অসহায় মেয়েদের আপত্তিকর হয়রানির শিকারও হতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব ঘটনা বাইরে না এলেও গত ১৫ মার্চ ২০১৪ বান্দরবান জেলায় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। বান্দরবানের একটি চার্চ পরিচালিত আবাসিক গালর্স স্কুল থেকে এক রাতে ৬৫ জন ছাত্রী পলিয়ে যায়। স্কুলের শিক্ষকদের মেয়েদের আপত্তিকর কাজে বাধ্য করার কারণে তারা এমন সিদ্ধান্ত নেয় বলে জানা গিয়েছে।
শুধু বিদেশি বা বেসরকারি এনজিও, উন্নয়ন ও মিশনারি সংস্থা নয়, বাংলাদেশের সরকারি অর্থেও পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্রিশ্চিয়ানাইজেশন হচ্ছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডও এমন কিছু এনজিও ও প্রকল্পে অর্থায়ন করছে যেসবের মাধ্যমে ক্রিশ্চিয়ানাইজেশন হচ্ছে। সিএইচটিডিবি উপজাতিকরণ করার ফলে এখানকার বিভিন্ন পদে আসীন কর্মকর্তারা এ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে।
পশ্চিমারা চায় বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ভারতের সেভেন সিস্টার্সের ত্রিপুরা, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, অরুনাচল ও মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চল নিয়ে বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন ইসরাইলের মতো একটি খ্রিস্টান বাফার স্টেট তৈরি করতে। কেননা এতে খ্রিস্টবাদী শক্তিগুলো ফিলিপাইনের পর এশিয়াতে দ্বিতীয় এবং দক্ষিণ এশিয়া ও চীনের মাঝে (বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চলে) একমাত্র খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ পাবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্রিশ্চিয়ান বাফার স্টেট প্রতিষ্ঠা রোধ করতে বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিয়ানমারকে একসাথে বসে সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। উল্লেখ্য, ভারতের সেভেনসিস্টার্সের কোন কোন রাজ্যের বাসিন্দারাও একইভাগে অনেকেই খ্রিস্টান হয়ে গেছে। দেশে ধর্ম প্রচারের অবাধ সুযোগ রয়েছে, তাই ধর্মান্তরকরণে সরাসরি বাধা দেয়ার কোনো উপায় নেই। কিন্তু যেসব সংস্থা সেবার নামে, নানা প্রলোভন দেখিয়ে মানুষকে ধর্মান্তর করছে বা ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করছে তাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে নিষিদ্ধ করতে হবে। বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে ওয়ার্ল্ড ভিশনকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিষিদ্ধ করেছে। এ প্রক্রিয়া আরো বিস্তৃত করতে হবে। বিদেশি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর ডাইরেক্ট এক্সিকিউশন (ডেক্স) অপারেশন পার্বত্য চট্টগ্রামে নিষিদ্ধ করে ন্যাশনাল এক্সিকিউশন (নেক্স) চালু করতে হবে। ভারত সেভেন সিস্টার্সে ইতোমধ্যে ডেক্স অপারেশন নিষিদ্ধ করেছে। যেসব এনজিও ও সংস্থা বাংলাদেশবিরোধী প্রচার ও অপতৎপরতায় লিপ্ত, বিশেষ করে আদিবাসী নামধারী সংগঠনগুলোর কার্যক্রম বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করতে হবে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশী উপজাতিদের আদিবাসী হিসেবে প্রতিষ্ঠার অনুকূলে যেকোনো প্রচার, কর্মতৎপরতা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। এর সাথে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব, অখ-তার স্বার্থ জড়িত। এক্ষেত্রে কোনোপ্রকার কালক্ষেপণ, শৈথিল্য কাম্য হতে পারে না।
Email: palash74@gmail.com

লেখকের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আরো কিছু লেখা

Exit mobile version