parbattanews

পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার জনসংহতি মুখোমুখি

 

ভূমি নিয়ে জটিলতা কাটেনি; আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে; পৃথক স্টেট করার পরিকল্পনা

শওকত ওসমান রচি: সরকারের শেষ সময়ে আদিবাসী দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে তৎপর বিভিন্ন সংগঠন। তাদের তৎপরতা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে পৌঁছেছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পাহাড়ি সম্প্রদায়কে নিয়ে বিপাকে সরকার। শুধু আদিবাসী অধিকার নয়, নিজস্ব ‘স্টেট’-এর অধিকারসহ বিভিন্ন দাবিতে এখন সরকার-জনসংহতি অনেকটাই মুখোমুখি। জনসংহতিসহ পাহাড়ি বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আন্দোলন তীব্রতর করার ডাক দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি তাদের পক্ষে রয়েছে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ। পাহাড়িদের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, আন্দোলনের মুখে এর আগে সরকার শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হয়েছে। এবারো প্রয়োজনে আন্দোলনের মাধ্যমে আদিবাসীর অধিকার আদায়সহ শান্তিচুক্তি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হবে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) মধ্যে শান্তিচুক্তির মধ্য দিয়ে ওই এলাকায় কয়েক দশকের সঙ্ঘাতের অবসান ঘটে। পিসিজেএসএস সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপিয় (সন্তু) লারমা সম্প্রতি বলেছেন, চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার ‘আন্তরিক’ নয়। ওদিকে ‘আদিবাসী’ দাবিতে পাহাড়িদের আন্দোলন সরকারকে বেশ ভাবনার মধ্যে ফেলেছে বলে জানিয়েছেন একাধিক সরকারি কর্মকর্তা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারের বিরুদ্ধে নালিশ জানাচ্ছে তারা। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং পাহাড়ি নেতৃবৃন্দ নিজেদের আদিবাসীতে পরিণত করতে দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তদ্বির চালিয়ে আসছেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে পাহাড়িদের এ দাবির বিরুদ্ধে পাল্টা প্রচারণা শুরু করলেও এখন অনেকটাই পিছিয়ে এসেছে সরকার। ‘আদিবাসী’ শব্দটি বিলোপ করে বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর আলোকে ‘ুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ শব্দটি প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে নিয়েছে সরকার। এ নিয়েও পাহাড়ি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাথে সরকারের বিরোধ এখন তুঙ্গে। বিষয়টির ব্যাপারে একটি নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ‘ুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ যে আদিবাসী নয় সেটা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচারণার উদ্যোগ নেয় সরকার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে প্রচারণায় বলা হয়, বাংলাদেশের জনসাধারণই আদিবাসী, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ‘ুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী আদিবাসী নয়। সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি জানান, জাতিসঙ্ঘে আদিবাসী ফোরামে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধিরা নিজেদের আদিবাসী পরিচয় দিচ্ছে। আদিবাসীদের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তি সরকার বাস্তবায়ন করছে না বলে তারা সেখানে অভিযোগ করছে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী তাদের লাঞ্ছিত করছে বলে অভিযোগ করে জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ না করার পক্ষে মতামত সৃষ্টির জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। ফলে বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক হয়ে উঠতে পারে।

সরকারের বিভিন্ন সংস্থার দেয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, আদিবাসী অধিকারের নামে পৃথক ‘স্টেট’ করার লক্ষ্যে এগোচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। এ বিষয়টি জানার পরপরই সরকার সতর্ক হয়েছে। সোমবারের আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের অনেক আগেই ভূমি কমিশন আইন সংশোধনের জন্য পরিষদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে কিছু দাবি তোলা হয় বিল আকারে। তবে ভূমি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এসব সংশোধনী না করার একটি সুপারিশ পাঠানো হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। কর্মকর্তারা জানান, পাহাড়িদের এ সংশোধনীর দাবি পূরণ হলে তিন পার্বত্য এলাকায় সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। তবে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সে সুপারিশ উপেক্ষিতই রয়ে গেছে বলে কর্মকর্তারা জানান। কর্মকর্তারা জানান, এ সংশোধনী প্রস্তাব সংসদে অনুমোদন হলে পুরো ফয়’স লেক পাহাড়িদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। হস্তান্তর করতে হবে রিজার্ভ ফরেস্ট। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্রের রেড ইন্ডিয়ানদের মতো আদিবাসীর অধিকার চাচ্ছে পাহাড়ি গোষ্ঠীগুলো। কর্মকর্তারা জানান, জাতিসঙ্ঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, কোনো আদিবাসী এলাকায় সেনা চলাচল করা যাবে না। এলাকার কোনো জমি সরকার ব্যবহার করতে পারবে না। অনুমোদন ছাড়া আদিবাসী এলাকায় প্রবেশও নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। এ ছাড়া আদিবাসী হলে অপরাধ করলেও তাদের রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনে কোনো বিচার বা গ্রেফতার করা যাবে না। তারা তাদের নিজস্ব আইনে অপরাধীদের বিচার করবে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে, বেশ কিছু তথ্য ও তত্ত্ব এবং বোমাং রাজা অং শু প্রু চৌধুরীর সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তারা আদিবাসী নন। তারা প্রায় ৩০০ বছর ধরে (১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে) বাংলাদেশে বসবাস করছেন।

ওদিকে পার্বত্য অঞ্চলের ভূমি নিয়ে জটিলতা এখনো কাটেনি। পাহাড়িদের বাধার মুখে পার্বত্য অঞ্চলে সরকারের ভূমি জরিপ দীর্ঘ দিন ধরে অনিশ্চিত হয়ে গেছে। এর ফলে ওই এলাকায় ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি হচ্ছিল না দীর্ঘ দিন ধরে। পার্বত্য এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পার্বত্য এলাকা থেকে বেশ কিছু শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। পরে তারা দেশে ফেরার পর সরকার তাদের পুনর্বাসন করে। পাহাড়ি নেতৃবৃন্দ সেটাকে ইস্যু করে জটিলতা সৃষ্টি করে চলেছে। তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এখনো শরণার্থীদের পুনর্বাসন করা হয়নি। কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ফলে তাদের কিছু লোক এখনো উদ্বাস্তু। পুনর্বাসন হয়নি বলে তাদের দাবি। এ অজুহাতে তারা ভূমি জরিপের কোনো বৈঠকেও অংশ নেননি। উদ্বাস্তু থাকলে তাদের তালিকা পাঠাতে বারবার অনুরোধ করেও সরকারি কর্মকর্তারা এ ধরনের কোনো তালিকা পাননি বলে জানান।

সৌজন্যে- দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২৪-৫-২০১৩।

Exit mobile version