পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অস্থিরতা কেবল একটি স্থানীয় প্রশাসনিক সংকট নয়

fec-image

দীর্ঘদিন ধরে আমরা যে পাহাড়ের সমস্যাকে শুধুই ‘সামরিক সমস্যা’ হিসেবে দেখছি- এটা এক ধরনের কৌশলগত ভুল। বাস্তবে এটি একটি জ্বলজ্যান্ত রাজনৈতিক, সামাজিক ও ভূরাজনৈতিক সমস্যা। সামরিক পদক্ষেপ দিয়ে হয়ত বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহ দমানো যায়, কিন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিক অসন্তোষের সব কারণ কিন্তু মুছে ফেলা যায় না। এরফলে সমস্যাগুলো রয়েই যায় আর কিছুদিন পরপর বারবার ফিরে আসে নতুন নামে, নতুন রূপে।

ভারতের কুটিল ভূমিকা
একাধিক আন্তর্জাতিক রিপোর্টের সুত্র ধরে জানা যায় যে, ১৯৭০-এর দশক থেকেই বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তকে ‘স্ট্র্যাটেজিক প্রেশার পয়েন্ট’ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে ভারত এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলে তারা শান্তিবাহিনীকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও আশ্রয় দিত। এটি ছিল এক ধরনের ‘প্রক্সি/সফট লিভারেজ’- যা স্বাধীন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তকে অস্থির রাখত, অবশেষে ঢাকা সেখানে সেনা মোতায়েনে এবং সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখতে বাধ্য হয়।

আজও সীমান্তের ওপারে কিছু এনজিও ও আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক এই তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে—যা ‘ক্রস-বর্ডার হাইব্রিড ওয়ারফেয়ার’-এর আধুনিক রূপ। আমাদের সার্বভৌমত্বের এই “দুর্বল অংশ” নিয়ন্ত্রণ না করলে ভবিষ্যতে বড় বিপদ ডেকে আনবে।

১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তি : সাফল্য ও সীমাবদ্ধতা
আমরা এই শান্তিচুক্তিকে অগ্রগতির মাইলফলক হিসেবেই দেখি, কিন্তু এর বাস্তবায়ন ছিল অর্ধেক সফল। তাড়াহুড়ো করে চুক্তির খসড়া তৈরি, অস্পষ্ট ধারা ও দুর্বল তদারকি- এসবের কারণে প্রত্যাশিত ফল আসেনি।
ফলাফল হলো- ইউপিডিএফ ও পিসিজেএসএস-এর মধ্যে দ্বন্দ্ব; নতুন সশস্ত্র গ্রুপের উত্থান; এবং স্থায়ী শান্তির পরিবর্তে “নিম্ন-তীব্রতার অস্থিরতা”র ধারাবাহিকতা।

অশান্ত পাহাড় আজ জাতীয় নিরাপত্তার কেন্দ্রীয় ইস্যু
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল এখন কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমি। কারণ দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও নৌঘাঁটি; পূর্বে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ ও রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রবাহ; উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরাম- যেখানে এখনো উগ্রপন্থী নেটওয়ার্ক সক্রিয়।

এই ত্রিমুখী চাপের মধ্যে পাহাড়ের অস্থিরতা হয়ে উঠছে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য চরম দুর্বলতা (national security vulnerability)। এটি কেবল ভৌগোলিক হুমকি নয়, এটি আমাদের রাষ্ট্রীয় ‘সহনশীলতা’ (resilience)-এর প্রশ্ন।

জাতীয় ঐক্য ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি
আমরা পাহাড়কে “নিরাপত্তা সমস্যা” হিসেবে নয়, “জাতীয় সংহতির সুযোগ” হিসেবে দেখতে চাই। এই অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আমাদের জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের শিক্ষা, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য ও ভাষাগত মর্যাদা নিশ্চিত করা মানে শুধু উন্নয়ন নয়—এটি এক ধরনের সামাজিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ—তাদের সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষা করব, কিন্তু কোনো প্রকার বিভাজনমূলক বা বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতি বরদাস্ত করব না।

শান্তিচুক্তির পুনর্মূল্যায়ন ও সংস্কার অপরিহার্য
শান্তিচুক্তির পুনর্মূল্যায়ন ও সংস্কার এখন সময়ের দাবি। এই প্রক্রিয়াটি ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করতে হবে- স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনার ভিত্তিতে। স্বল্পমেয়াদে (১ বছরের মধ্যে) বিতর্কিত ভূমি হস্তান্তর স্থগিত রেখে স্যাটেলাইটভিত্তিক ভূমি জরিপ ও দাবি (ক্লেইম) সিস্টেম চালু করতে হবে, পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন ও নিরাপত্তা সংস্থার মধ্যে সমন্বিত টাস্কফোর্স গঠন জরুরি। মধ্যমেয়াদে (৩ বছরের মধ্যে) অংশগ্রহণমূলক ভূমি স্বত্ব (টাইটেল) প্রক্রিয়া চালু করে আইনগত সহায়তা ও ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে। আর দীর্ঘমেয়াদে (৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে) সংবিধানে নৃগোষ্ঠীর ভূমি অধিকারের নীতিগত স্বীকৃতি অন্তর্ভুক্ত করে সেটিকে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে কার্যকরভাবে সংযুক্ত করা প্রয়োজন।

আধুনিক নিরাপত্তা কৌশল ও নীতি সংস্কার
সিএইচটি-তে এখন একটি নতুন নিরাপত্তা নীতি প্রণয়ন দরকার—যেখানে থাকবে-
> সিএইচটি নিরাপত্তা মতবাদ ২০২৫ : স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক অপারেশনাল ট্রেনিং।
> সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা অঞ্চল : সীমান্ত নজরদারি ও গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান।
> কমিউনিটি ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক: স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে গোয়েন্দা সহযোগিতা।
> প্রযুক্তি-সক্ষম ইউনিট : ড্রোন, নাইট ভিশন, সেন্সর ও সাইবার মনিটরিং।
> সিএইচটি ভেটেরান্স ফোরাম: যারা অতীতে পাহাড়ে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষাগ্রহণ।

কূটনৈতিক ও তথ্যনিরাপত্তা উদ্যোগ
ভারতের সঙ্গে ‘ট্র্যাক-২ কূটনীতি’ জোরদার করে সীমান্তে এনজিও ও সশস্ত্র আশ্রয় রোধে পদক্ষেপ নিতে হবে। একইসঙ্গে, আন্তর্জাতিক পরিসরে “বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বার্তা” (Bangladesh’s sovereignty narrative) শক্তিশালী করতে হবে- যাতে কোনো বিদেশি সংস্থা পাহাড়ের অস্থিরতাকে অভ্যন্তরীণ নিপীড়ন হিসেবে ফ্রেম করতে না পারে।

পাহাড়ের শান্তি ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা একে অপরের পরিপূরক। আমরা সামরিক ও রাজনৈতিক উভয় দিকেই সমন্বিত কৌশল চাই। আজকের যুদ্ধ শুধু বন্দুকের নয়- তথ্য ও ন্যারেটিভের যুদ্ধও আমাদের লড়তে হবে।

আমাদের প্রস্তাব
“নীতিতে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বাস্তবায়নে সামরিক নির্ভুলতা এবং লক্ষ্যের জাতীয় ঐক্য।”

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক, এবং সামরিক কৌশল বিষয়ে গবেষক, মুখ্য সমন্বয়ক ও মুখপাত্র, জনতার দল।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: প্রবন্ধ, মেজর (অব.) ডেল এইচ খান
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন