পার্বত্য তিন জেলায় বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি উঠিয়ে নিলো সরকার

পার্বত্য চট্টগ্রাম

স্টাফ রিপোর্টার:

শেষ পর্যন্ত পার্বত্য তিন জেলায় বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি উঠিয়ে নিলো সরকার। এখন থেকে আগের নিয়মেই জেলা প্রশাসকদের অনুমতি নিয়ে পার্বত্য তিন জেলায় বিদেশিরা ভ্রমণ করতে পারবে। এর জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে না। তবে বিদেশি গবেষকদের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগবে। এই অনুমতির জন্য ২০ দিন আগে আবেদন করতে হবে।

গত ৫ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের এক সভায় তিন পার্বত্য জেলায় বিদেশীদের ভ্রমণের ক্ষেত্রে ১ মাস পূর্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুমতির আবেদনসহ ১১ দফা নির্দেশনা জারী করা হয়। এ নির্দেশনা জারীর পর দেশের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। দেশের একটি অংশ সরকারের এ সিদ্ধান্তে স্বাগত জানালেও পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি ও দেশের দেশী-বিদেশী সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষকরা এই সিদ্ধান্তের চরম বিরোধিতা করতে থাকে।

রবিবার সকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এক সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সকাল ১১টায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদির পাশাপাশি বিদেশি নাগরিকদের পার্বত্যাঞ্চলে ভ্রমণবিষয়ক নীতিমালা ও পরিপত্র প্রণয়নে সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রসচিব ড. মোজাম্মেল হক খান, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ, পুলিশ, র‌্যাব ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

সভা সূত্র জানায়, বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণের সময় নিরাপত্তার বিষয়টি সভায় ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা আশ্বস্ত করেন, ভ্রমণকালে বিদেশিদের যথাযথ নিরাপত্তা দেওয়া হবে।

সভায় উপস্থিত এক কর্মকর্তা জানান, পার্বত্য তিন জেলায় বিদেশিরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই আগের নিয়মে ভ্রমণ করতে পারবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া কোনো বিদেশি গবেষক যদি ওই এলাকায় যেতে চান তাহলে ২০ দিন আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুমতির জন্য আবেদন করতে হবে। প্রজ্ঞাপন জারির পর এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে বলে জানা গেছে।

এসব সিদ্ধান্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলে বিদেশিদের ভ্রমণ কিভাবে আরো সহজ করা যায় তা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটিতে বিদেশিদের যেতে হলে আগে থেকেই নিয়ম রয়েছে- জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে যেতে হবে। গত ৫ জানুয়ারি থেকে ২০ দলীয় জোটের অবরোধকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার ঘটনা ঘটতে থাকে। এ অবস্থায় ৭ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিভাগীয় কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠকে বিদেশিদের ভ্রমণের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। বলা হয়- বিদেশিদের ভ্রমণের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে। একই সঙ্গে নির্দেশনা জারি করা হয়, কূটনীতিক বাদে যেকোনো বিদেশি নাগরিককে তিন পার্বত্য জেলায় যাওয়ার এক মাস আগে অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হবে। কড়াকড়ি আরোপের পর থেকে যে কজন বিদেশি ভ্রমণ করতে গেছে তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে গেছে।

রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মো. শামসুল আরেফিন গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, ‘আমি এখানে নতুন এসেছি। আসার পর দেখেছি, যে কজন বিদেশি এসেছে তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে এসেছে।’

খাগড়াছড়ির সাবেক জেলা প্রশাসক মাসুদ করিম বলেন, ‘আমি গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছি। দায়িত্ব পালনকালে দেখেছি, সপ্তাহে সাত-আটজন বিদেশি আসতেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার সময়ে ইউরোপের লোকজনই বেশি আসতে দেখেছি।’

যেভাবে যায় বিদেশিরা : সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, কোনো বিদেশি নাগরিককে খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি যেতে হলে ৭২ ঘণ্টা আগে জেলা প্রশাসককে জানানোর নিয়ম রয়েছে। জেলা প্রশাসককে জানানোর পর সেটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের অবহিত করেন জেলা প্রশাসক।

এদিকে বিদেশী পর্যটকদের পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতির নির্দেশনা তুলে নিলেও নির্দেশনার অন্যান্য ধারা বহাল রয়েছে বলে জানা গেছে। ওই সভায় গৃহীত উল্লেখযোগ্য নির্দেশনাগুলো ছিলো:
বিগত ১০ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউএনডিপি কর্তৃক ১৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন অগ্রগতি ও ফলাফল প্রেরণের জন্য অনুরোধ করা হয়; শান্তিচুক্তি বিরোধী সশস্ত্র সংগঠন এবং স্থানীয় সন্ত্রাসী গ্রুপ কর্তৃক চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ, মাদকদ্রব্য ও অস্ত্র চোরাচালান রোধকল্পে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসারের সমন্বয়ে যৌথ অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়; কোন আইনগত ভিত্তি না থাকায় সিএইচটি কমিশনের নাম সংশোধন করে ‘কমিশন’ শব্দটি বাদ রেখে অন্য কোন নাম রাখার বিষয়ে অনুরোধ করা হয়; কূটনৈতিকগণ ছাড়া সাধারণ বিদেশী নাগরিকগণ পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমণ করতে চাইলে অন্তত একমাস পূর্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুমতির জন্য আবেদন করবেন; স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার ইতিবাচক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অনুমতি প্রদান করবে; অনুমতিপ্রাপ্ত বিদেশী নাগরিকগণ সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক/পুলিশ সুপারের নিকট তাদের উপস্থিতি/ভ্রমণসূচি দাখিল সাপেক্ষে ভ্রমণ করবেন; কূটনৈতিকগণ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অনুমতি গ্রহণ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমণ করবেন; কোন দেশী-বিদেশী ব্যক্তি/সংস্থা কর্তৃক পার্বত্যাঞ্চলে উপজাতীয়দের সাথে সাক্ষাত কিংবা বৈঠক করতে চাইলে স্থানীয় প্রশাসন এবং সেনাবাহিনী/বিজিবি’র উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে; পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ২৪ পদাতিক ডিভিশনের সাথে পারস্পরিক সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহ দায়িত্ব পালন করবে; ভারত ও বাংলাদেশের সাথে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের ৪৭৯ কিলোমিটার অরক্ষিত সীমান্তের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার নিমিত্তে ইতোমধ্যে গৃহীত/বাস্তবায়িত প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনাসহ আবশ্যকীয় স্থাপনা নির্মাণের প্রস্তাব বিজিবি প্রেরণ করবে; পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্যমান চেকপোস্টগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পুলিশ ও আনসার বাহিনীতে কর্মরত শান্তিবাহিনীর সাবেক সদস্যদের তিন পার্বত্য জেলা থেকে সরিয়ে অন্যত্র বদলীর সুপারিশ করা হয়েছে। এসব নির্দেশনার একটি বাদে আর বাকিগুলো বহাল রইলো।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

One Reply to “পার্বত্য তিন জেলায় বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমণের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি উঠিয়ে নিলো সরকার”

  1. এখন যদি কোন বিদেশী পর্যটক তিন পার্বত্য জেলায় যেতে চায় তাহলে কি তিন জেলা প্রশাসক থেকে আলাদা আলাদা অনুমতি পত্র নেয়া লাগবে???

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন