parbattanews

পাহাড়ে পানি পান করতেও চাঁদা দিতে হয়

পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি আনার জন্য চুক্তি করা হয়েছিল। সেই চুক্তির বয়স এখন ২২ বছর। কিন্তু এত বছরেও সেখানে শান্তি ফিরে আসেনি। স্থানীয়রা বলছে, ভূমির মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব, চাঁদাবাজি, অস্ত্রের ঝনঝনানি, আধিপত্য বিস্তার, জাতিগত ভেদাভেদ – এ সব কারণে শান্তি আসছে না। পাহাড়ে চাঁদাবাজির অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে পানি পান করতেও চাঁদা দিতে হয়।

আগামী ২ ডিসেম্বর চুক্তির ২২ বছর পূর্তি। গত কয়েক দিন খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পাহাড়ি ও বাঙালিদের সঙ্গে কথা বলে পাহাড়ে অশান্তির নানা তথ্য জানা গেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাত অবসানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদের তখনকার চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে সই করেছিলেন। রাজধানীতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় হওয়া ওই চুক্তির সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও উপস্থিত ছিলেন।

শান্তিচুক্তি নামে পরিচিত ওই চুক্তির মধ্য দিয়ে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র সমর্পণ করেন। এর মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে যবনিকাপাতের সূচনা হয় এবং অবারিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের দ্বার। কিন্তু দীর্ঘ ২২ বছরে পরিস্থিতির পুরোপুরি উন্নয়ন ঘটেনি। অনেক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড হলেও শান্তি এখনো অধরা।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), যারা শান্তিবাহিনী গঠন করে সশস্ত্র লড়াই শুরু করেছিল—তাদের কাছে থাকা সব অস্ত্র জমা দেওয়ার কথা। কিন্তু বেশির ভাগ অস্ত্র আজ পর্যন্ত জমা দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করে পাহাড়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ১৯৯৮ সালে গড়ে ওঠে আরেকটি আঞ্চলিক দল, যার নাম ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এ দুটি দলের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা ও অগণতান্ত্রিক আচরণের অভিযোগ তুলে পাহাড়ে জন্ম নিয়েছে গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ এবং জেএসএস সংস্কার (এম এন লারমা) নামের আরো দুটি আঞ্চলিক দল।

এখন পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যাচ্ছে। গত ২৩ মাসে পার্বত্য অঞ্চলে ৭২টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এগুলোর বেশির ভাগই ঘটেছে চাঁদাবাজি ও দলীয় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে এখন পর্যন্ত ৪৮টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। ৯টি ধারা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, পাহাড়ি সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত। তাদের চাঁদা না দিয়ে ওই সব অঞ্চলে কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য, ঠিকাদারি করতে পারে না।

রাঙামাটির সাজেক এলাকায় দেখা গেছে পানির প্রচণ্ড সংকট। স্থানীয় বাসিন্দাদের বহু দূরের একটি ঝরনা থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। এই প্রাকৃতিক পানির জন্যও চাঁদা দিতে হয়। অন্যথায় পানি মেলে না।

সেখানকার এক ব্যবসায়ী বলেন, চান্দের (জিপ) গাড়িতে করে তাঁরা বড় কনটেইনারে পানি নিয়ে আসেন। একেকটি কনটেইনারের জন্য ৮০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এ ছাড়া রিসোর্ট চালানোর জন্যও দিতে হচ্ছে চাঁদা। চাঁদাবাজির কারণে রিসোর্টে পর্যটকদের থাকা ও খাওয়া খরচও বেড়ে যাচ্ছে।

সাধারণ পাহাড়িরা বাঙালিদের সঙ্গে মিশতে আগ্রহী হলে নেতাদের তাতে ঘোর আপত্তি। এ বিষয়ে খাগড়াছড়ির দীঘিনালার বাসিন্দা সাধন চাকমা বলেন, তাঁরা বাঙালিদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে চান। কিন্তু নেতারা সেটা করতে দিতে চান না। সরকার যদি স্কুল-কলেজ, রাস্তা তৈরি করতে চায় তাতেও তাঁরা বাধা দেন। পাহাড়িদের সংগঠনগুলো গরিব জুম চাষিদের কাছ থেকেও নিয়মিত চাঁদা নেয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন অমল চাকমা। তিনি বলেন, ‘পাহাড়ে বড় সমস্যা হচ্ছে জাতিগত ভেদাভেদ। সমতলে মুসলিম-হিন্দু কোনো সমস্যা ছাড়াই পাশাপাশি বসবাস করতে পারছে। কিন্তু এখানকার পরিবেশ বৈরিতাপূর্ণ।’

সাজেকে গিয়ে কথা হয় হেডম্যান লাল থাঙ্গার সঙ্গে। জমির বিষয়ে তিনি বলেন, সাজেক এলাকার পাহাড়ে তাঁর ১০ একর জমি রয়েছে। সেই জমি তিনি চাইলে বিক্রি করতে পারেন। কিন্তু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বাইরে কারো কাছে জমি বিক্রি করার নিয়ম নেই। এ কারণে তিনি বাঙালিদের কাছে জমি বিক্রি করতে পারবেন না।

কথা হয় গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফের এক নেতার সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে তিনি জেএসএসের সশস্ত্র কর্মী ছিলেন। চুক্তির পর খাগড়াছড়িতে তিনি অস্ত্র জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু জেএসএস নেতৃত্বের একগুঁয়ে নীতির কারণে তিনি দল থেকে চলে গিয়ে গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর চাওয়া পাহাড়ে বাঙালি ও পাহাড়ি মিলেমিশে চলবে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো পাহাড়েও উন্নতি হবে।

সূত্র: কালের কণ্ঠ

Exit mobile version