parbattanews

পাহাড়ধস ও বন্যা আতঙ্কে রোহিঙ্গারা

উখিয়ার ময়নারঘোনা ক্যাম্পে এভাবে ধসে পড়েছে পাহাড়ের একাংশ।

কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয় শিবিরে অবস্থানকারী ২৫ হাজার পরিবারের প্রায় দেড়লাখ রোহিঙ্গা দিন কাটাচ্ছেন পাহাড়ধস ও বন্যার ঝুঁকি আতঙ্কে। গত পাঁচদিনে মৃত্যু হয়েছে শিশুসহ তিনজনের। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩ হাজারের বেশি বসতঘর।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম এর হিসাব মতে, পাঁচ দিনের ভারী বর্ষণ এবং ঝড়ো হাওয়ায় উখিয়া-টেকনাফে ভূমিধসে এক হাজার ১৮৬টি, বন্যায় ২১৬টি এবং ঝড়ো হাওয়ায় এক হাজার ৮৪০টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন ১৫ হাজার ৫৩৪ জন রোহিঙ্গা। এছাড়াও ক্যাম্পগুলোতে ৩৯১টি ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে এবং ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেছে ৫১ বার।

গত ৩ থেকে ৫ জুলাই পর্যন্ত সময়ে ৫১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে কুতুপালং মেঘা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। আরেকটি বড় ক্যাম্প, ‘ক্যাম্প ১৬তে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৫৩০ মিলিমিটার। পাঁচদিনের এই প্রবল বৃষ্টি এবং ঝড়ো হাওয়ার কারণে প্রায় তিন হাজার রোহিঙ্গা তাদের আশ্রয়স্থল হারিয়েছেন।

উখিয়া থানা পুলিশ জানায়, ভূমিধসে নিহতরা হলেন কুতুপালং ২ নম্বর ক্যাম্পের ব্লক ডি এর মৃত আবু বক্করের স্ত্রী মোস্তফা খাতুন (৫০), উখিয়া হাকিমপাড়া ক্যাম্পের মোহাম্মদ হামিম (৮) ও মধুরছড়া ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইব্রাহীম (৭)। তিনজনের মৃত্যু ছাড়াও বিভিন্নভাবে আহত হয়েছেন আরও অন্তত ২০ জন।

এসব তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের সেক্রেটারি ছৈয়দ উল্লাহ বলেন, প্রায় সবগুলো রোহিঙ্গা ক্যাম্পই পাহাড়ি এলাকায়। আর বেশিরভাগ বাড়ি-ঘর করা হয়েছে পাহাড় কেটে। যে কারণে বৃষ্টি শুরু হলেই রোহিঙ্গারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।

শরণার্থী শিবিরে ক্ষয়ক্ষতির কথা স্বীকার করে কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, গত বর্ষায় বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসরতদের মধ্যে থেকে আমরা এরইমধ্যে ১৫ হাজার পরিবারের ৫০ হাজার বাসিন্দাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছি। আরও প্রায় সাড়ে চার হাজার পরিবার আছে রাস্তাঘাটে চলাচল সমস্যা এবং পাহাড়ধসের অতিমাত্রায় ঝুঁকিতে রয়েছে। এদের তালিকা তৈরি এবং অন্যত্র সরানোর পরিকল্পনা চলছে।

তিনি বলেন, যেহেতু রোহিঙ্গা বসতিগুলো পাহাড়ি এলাকায়, তাই ভারী বর্ষণ হলেই সেখানে ভূমিধসের ঘটনা ঘটে। যে কারণে কিছুটা ঝুঁকি থাকেই। এ ধরনের সমস্যা থেকে শতভাগ উত্তরণ আসলেই সম্ভব নয়। তবে এই বর্ষায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

উখিয়ার কুতুপালং ৪ নম্বর ক্যাম্পের প্রধান মাঝি মো. আব্দুর রহিম বলেন, আমার আওতাধীন ৩ হাজার ২০০ পরিবার আছে। টানা বর্ষণের কারণে পাহাড়ধসে ১০টি ঘর সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। আরও অন্তত একশত পরিবার আছে পাহাড়ধস এবং বন্যার ঝুঁকিতে। তারা এখন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। বাকি সব বাড়িঘরের ত্রিপলের ছাউনি নষ্ট হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলেই পানিতে ঘর ভিজে যায়। যে কারণে সবাই কম বেশি দুর্ভোগে আছেন।

একই ক্যাম্পের সি ব্লকের মাহমুদুল হাসান বলেন, গত রোববার বৃষ্টির সময় পাহাড়ধসে আমার ঘর সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। এখন বউ-বাচ্চা নিয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছি।

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহ বলেন, মধুরছড়া, জামতলী, লম্বাশিয়া, বালুখালী, থাইনখালী, হাকিমপাড়া, ময়নারঘোনাসহ উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শুরু থেকে এই পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য প্রায় ২ লাখ ১৩ হাজার ঝুঁপড়ি ঘর তৈরি করা হয়েছে। এসবের মধ্যে ১৭ নম্বর ক্যাম্পের প্রায় সাতশত ঘর আছে ছনের ছাউনির। বৃষ্টিতে এগুলোর সবকটির ছাউনি নষ্ট হয়ে গেছে। আর বাকিসব ঘরের তিনভাগের দুইভাগ ঘরের ত্রিপলের ছাউনী নষ্ট হয়ে এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন এর বাসিন্দারা। বর্ষণে পানিতে তলিয়ে গেছে ঘুমধুম নো-ম্যানস ল্যান্ড শরণার্থী শিবির

টানা কয়েকদিনের বর্ষণে বৃষ্টির পানি এবং তুমব্রু খাল দিয়ে উপর থেকে নেমে আসা বানের পানিতে তলিয়ে গেছে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম কোণারপাড়ার শূণ্যরেখার শরণার্থী শিবির। ফলে এখানে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন প্রায় পাঁচ হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু।

কোণারপাড়া শরণার্থী শিবিরের মাঝি দিল মোহাম্মদ বলেন, প্রবল বৃষ্টির পানির সঙ্গে পাহাড়ি ঢল নেমে আসায় তুমব্রু কোণারপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরটি প্রায় এক সপ্তাহ ধরে পানিতে তলিয়ে আছে। ফলে বসবাসরত প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা চরম দুর্ভোগের মধ্যে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বর্তমানে এখানে খাদ্য এবং খাবার পানির সংকটও দেখা দিয়েছে।

ঘুমধুম ইউপি চেয়ারম্যান একে জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, এখানে প্রাণহানীর ঘটনা না ঘটলেও আবাসন নিয়ে রোহিঙ্গারা দুর্ভোগে পড়েছেন।

উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ভারী বর্ষণের কারণে পাহাড়ধস, ভূমিধসের ঘটনা ঘটতে পারে। এজন্য প্রতিটি ক্যাম্পে মাঝিদের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। আর যারা অতি ঝূঁকিপূর্ণভাবে এখনো বসবাস করছেন, মাঝিদের মাধ্যমে তাদের আপাতত নিরাপদ স্থানে এসে আশ্রয় নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ক্যাম্পের ভেতরে থাকা মসজিদ, সাইক্লোন শেল্টার, আশপাশের স্কুলের ভবন প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলেও তিনি জানান।

Exit mobile version