parbattanews

পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধছে

 

পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের সংশোধনী

রফিকুল বাসার ও তরুণ ভট্টাচার্য

পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের সংশোধনীকে কেন্দ্র করে ভূমি নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। এতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল মানুষের মনে ক্ষোভ দানা বাঁধছে। পাহাড়ি-বাঙালি— সকলে এই সংশোধনীতে অসন্তুষ্ট।

সরকার বলছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের স্পর্শকাতর ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য গঠিত ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনকে কার্যকর করতে আইনের কিছু ধারায় সংশোধন আনা হচ্ছে; কিন্তু অন্যরা বলছেন, এতে সমস্যার সমাধান হবে না। বরং সমস্যা বাড়বে।

পাবর্ত্য শান্তি চুক্তির আলোকে ২০০১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন করা হয়। সেই আইনের কয়েকটি ধারায় সংশোধনী আনা হচ্ছে। জাতীয় সংসদে এই সংশোধনী বিল এখন পাসের অপেক্ষায়।

আইনের ৬(গ) ধারায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ ধারায় মূল আইনে উল্লেখ রয়েছে, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইনবহির্ভূতভাবে কোনো ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান করা হয়ে থাকলে তা বাতিলকরণ এবং উক্ত বন্দোবস্তজনিত কারণে কোনো বৈধ মালিক ভূমি হতে বেদখল হয়ে থাকলে তার দখল পুনর্বহাল করা হবে। তবে শর্ত থাকে যে, প্রযোজ্য আইনের অধীনে অধিগ্রহণকৃত ভূমি এবং রক্ষিত বনাঞ্চল, কাপ্তাই জলবিদ্যুত্ প্রকল্প এলাকা, বেতবুনিয়া ভূ-উপ-গ্রহ এলাকা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প কারখানা ও সরকার বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নামে রেকর্ডকৃত ভূমির ক্ষেত্রে এই উপ-ধারা প্রযোজ্য হবে না।’

সংশোধন প্রস্তাবে ওপরের দিকে ‘আইন’ শব্দের পরিবর্তে ‘আইন ও রীতি’ এবং ‘কোন ভূমি’ পরিবর্তে ‘জলেভাসা ভূমি’ শব্দ যোগ করা হয়েছে।

বাঙালি সংগঠনগুলোর নেতারা বলেছেন, সংসদে উত্তাপিত বিলে আইনের ৬(গ) ধারায় ভূমির পরিবর্তে ‘যে কোনো ভূমি’ শব্দগুলো জুড়ে দেয়ায় তিন পার্বত্য অঞ্চলের যে কোনো ভূমি/জমি পাহাড়িরা নিজের দাবি করে ভূমি কমিশনে আবেদন করতে পারবেন। এরপর কমিশন বৈঠকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে দাবি করা ভূমি উপ-জাতীয়দের নামে নাম জারি করতে পারবে। এতে একদিকে সরকারের এখতিয়ার যেমন খর্ব হবে তেমনি তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসরত বাঙালিরাও ভূমিহীন হতে বাধ্য হবে।

পার্বত্য ভূমি কমিশন আইনের ‘ঘ’ অনুচ্ছেদের ৪-এ বলা হয়েছে, ‘গঠিত ভূমি কমিশন পুনর্বাসিত শরণার্থীদের জায়গা-জমির বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করাসহ এ যাবত্ যেসব জমি ও পাহাড় অবৈধভাবে বন্দোবস্ত ও বেদখল হয়েছে, সেসব জমি ও পাহাড়ের মালিকানার স্বত্ব বাতিলে পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে।’ এখানে ১২ হাজার ২২২ পরিবার ভারত প্রত্যাগত পুনর্বাসিত শরণার্থীর ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কথা বলা হয়েছে। ফলে ভূমি কমিশন ত্রিপুরা থেকে ফিরে আসা এই সংখ্যক শরণার্থীর ভূমি বিরোধের আবেদন শুনানি করবে; কিন্তু যে কোনো ভূমি শব্দগুলো যোগ করে এ আইন কার্যকর করা হলে এই সংকট শিগগিরই কাটবে না বলে মনে করছেন অনেকে।

চুক্তিতে ‘এ যাবত্’ শব্দ উল্লেখ করার মাধ্যমে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত পার্বত্য তিন জেলায় যেসব জমি পাহাড়িদের হাত থেকে বেদখল হয়েছে বুঝাবে; কিন্তু এক্ষেত্রে সংশোধনীর ফলে শান্তি চুক্তির এই সময়সীমার বেষ্টনীও আর থাকবে না। ফলে চুক্তির পরও যেসব জমি পাহাড়িদের দখল থেকে হাতছাড়া হয়েছে বলে অভিযোগ আনা হবে তাও ভূমি কমিশন আমলে নিতে বাধ্য হবে।

সরকারের পক্ষ থেকে এবিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হচ্ছে, সংশোধনের এই ধারার এক স্থানে কোনো ভূমি আইন বহির্ভূতভাবে বন্দোবস্ত দেয়া হয়ে থাকলে তা ভূমি কমিশন বাতিল করে বৈধ মালিকের দখলে দিতে পারবে। তাই ‘কোনো ভূমি বা যে কোনো ভূমি’ যা-ই লেখা থাকুক না কেন সরকারি কোনো ভূমি বা সরকার যদি তার ভূমি বৈধভাবে কাউকে বন্দোবস্ত দিয়ে থাকে তাহলে কমিশন চাইলেও অন্য কাউকে তা বন্দোবস্ত দিতে পারবে না। কেননা, ভূমি কমিশনকে বিচারের সময় আইন ও রীতি সব কিছুই অনুসরণ করতে হবে। কমিশন আইন বহির্ভূতভাবে কোনো কিছুই করতে পারবে না।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রধান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা বলেছেন, ভূমি কমিশনের সংশোধিত আইন পাস হলে জনসংহতি সমিতি তা মেনে নেবে না। কেননা সমিতির কাছে সরকারের দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যে ১৩টি সংশোধনী আনার কথা ছিল তার মধ্যে ৩টি সংশোধনী সম্পূর্ণ বাদ দেয়া হয়েছে। এই সংশোধিত আইন দিয়ে বিদ্যমান ভূমি সমস্যার সমাধান কোনমতেই সম্ভব হবে না। ভূমি আইনের সংশোধনীতে সরকার পাহাড়ি জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা করে আঞ্চলিক পরিষদের ৫৪নং ধারা ভঙ্গ করে এ সংশোধনী আনা হয়েছে। এ আইনে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আইন প্রণয়ন ও আইনের সংশোধনের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিষদ পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের সুপারিশ নেয়ার কথা থাকলেও ভূমি আইনের সংশোধনের বেলায় তা করা হয়নি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার এম.পি বলেছেন, ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান থাকবেন একজন বাঙালি। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে তার মতামতের উপর। ফলে কোন পক্ষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। সংশোধনী কখনো মূল আইনের পরিপন্থি হয় না। মূল আইনের পক্ষে থাকলেও সংশোধনী বাতিলের দাবি অযৌক্তিক। পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষা করেই এই সংশোধিত আইন পাসের জন্য সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছে। একটি মহল পার্বত্য চট্টগ্রামে এবিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ও খাগড়াছড়ির সাবেক এমপি ওয়াদুদ ভুঁইয়া ভূমি কমিশন আইন সংশোধন নিয়ে বলেছেন, সরকার পার্বত্য ভূমি কমিশন আইন পাসের মাধ্যমে পাহাড়ের শান্তি নষ্টের ষড়যন্ত্র করছে। পার্বত্য পরিস্থিতিকে আরো অবনতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তিনি সরকারকে জাতীয় সংসদে ভূমি কমিশন আইন-২০১৩(সংশোধন) বিল পাস না করার আহ্বান জানান।

আইনে যে ১৩টি সংশোধনী আনা হয়েছে, তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, আইনের শিরোনাম সংশোধন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০১৩ রাখা হয়েছে। ২০০১ সালের ৫৩নং পার্বত্য ভূমি কমিশন আইনের প্রস্তাবনায় পার্বত্য জেলা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি শব্দগুলোর পরিবর্তে সংশোধন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি শব্দগুলো লেখা হয়েছে।

আইনের ৩-এর উপ-ধারা (২) তে উল্লেখিত সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফ, পদাধিকার বলে শব্দগুলো ও কমার (,) পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফ বা তাহার পক্ষে সভায় সিদ্ধান্ত প্রদানের মতো সহ তত্কর্তৃক মনোনীত একজন প্রতিনিধি’ শব্দগুলো হবে।

আইনের ৬ ধারা-এর উপ-ধারা (১) এ (ক) পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ এবং অবৈধ বন্দোবস্ত ও বেদখল হওয়া ভূমি বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা।

(খ) দফা ও (গ) দফা তে ????আইন শব্দটির পরিবর্তে আইন ও রীতি শব্দর পরিবর্তে আইন ও রীতি শব্দ এবং কোন ভূমি শব্দর পরিবর্তে জলেভাসা জমিসহ যে কোন ভূমি এবং বন্ধনী ( ) হবে।

আইনের ৭-এর (ক) উপ-ধারা (৪)-এর প্রান্তস্থিত দাড়ির (।) পরিবর্তে কোলন হবে এবং অতঃপর নিম্নরূপ শর্তাংশ সংযোজিত হবে যথা: ‘তবে শর্ত থাকে যে, উক্তরূপ বিবেচনা ও নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কমিশনের সকল সদস্যকে বৈঠকের পূর্বে নোটিস প্রদান করিতে হইবে।’

(খ) উপ-ধারা (৫)-এ উল্লেখিত ‘চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই কমিশনের সিদ্ধান্ত বলিয়া গণ্য হইবে’ কথাগুলোর পরিবর্তে চেয়ারম্যানসহ উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের গৃহীত সিদ্ধান্ত কমিশনের সিদ্ধান্ত বলিয়া গণ্য হইবে শব্দগুলো হবে।

ধারা-৯-এর সংশোধন (নিম্নরূপ নতুন ধারা সংযোজিত হইবে যথা: (২) আবেদন নিষ্পত্তির পূর্বে যে কোন পর্যায়ে ন্যায় বিচারের স্বার্থে কমিশনের অনুমতি সাপেক্ষে আবেদনকারী তাহার আবেদন একবার সংশোধন করিতে পারিবেন।

২০০১ সনের ৫৩নং আইনের ১৩ ধারা সংশোধন- উক্ত আইনের ধারা ১৩-এর উপ-ধারা (২)-এর পর নিম্নরূপ উপ-ধারা (৩) সংযোজিত হবে (৩) এই ধারার অধীন কমিশনের সচিব এবং অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে পার্বত্য জেলার উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার প্রদান করিতে হইবে।

এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সম-অধিকার আন্দোলন নামক সংগঠনের বাঙালি নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চুক্তির আলোকে গঠিত কমিশনের পরিবর্তন এনে বিচারিক কমিটিতে পাঁচ সদস্যের পরিবর্তে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে এতে বাঙালিদের পক্ষ থেকে কমপক্ষে দুই জন সদস্য অর্ন্তভুক্ত করার দাবি জানিয়েছে। পার্বত্য ভূমি কমিশনে নিয়োগের ক্ষেত্রে উপজাতি বা কোন জাতি-গোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার না দিয়ে পাহাড়ি-বাঙালি সমান সংখ্যক নিয়োগের দাবি তোলেন। এছাড়াও ভূমি সমস্যা সমাধানে প্রচলিত আইনের পাশাপাশি রীতি শব্দটি বাদ দেয়া, ফ্রিঞ্জ ল্যান্ড (জলেভাসা জমি) শব্দটি বাদ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন তারা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী সংগঠন ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ের ৮টি সংগঠন ভূমি কমিশন আইন সংশোধন প্রসঙ্গে এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেছে, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনে যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের আসল অধিবাসী প্রকৃত ভূমি মালিকদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দাবির প্রতিফলন না ঘটে এবং স্থায়ী বাসিন্দারা যদি তাদের হারানো বংশ পরম্পরার পৈতৃক জায়গা-জমি ফিরে না পায়, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আবার গণবিদ্রোহ দেখা দিতে বাধ্য।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙ্গালি সংগঠনগুলোর অভিযোগ, এই সংশোধনীর ফলে পার্বত্য জেলায় বসবাসরত বাঙালিরা ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। এতে দেওয়ানি আদালতের ক্ষমতা ও পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিদের সাংবিধানিক অধিকারও খর্ব হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের বিরোধাত্মক ধারা সংশোধনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে শুভ; কিন্তু ত্রুটিপূর্ণভাবে ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সুপারিশকে অবজ্ঞা করে বিল পাস করা হলে পাহাড়ের ভূমি বিরোধ যথাযথভাবে নিষ্পত্তি হবে না, তাছাড়া পাহাড়ের স্থায়ী অধিবাসীরা ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। এত পার্বত্যাঞ্চলে ভূমি সমস্যা অব্যাহত থাকবে। জাতীয় সংসদে উত্তাপন করা হলেও বিলটি এখনো সংশোধনের সুযোগ আছে।

সৌজন্যে: দৈনিক ইত্তেফাক

Exit mobile version