parbattanews

পাহাড়ের চূড়ায় ৪ তরুণের স্বপ্নের স্কুল

ছোট্ট জিংপ্রিং ম্রো। সকাল হলেই বাড়ে তার ছোটাছুটি। কোনো রকম নাওয়া খাওয়া শেষ করে বই-খাতা নিয়ে বেড়িয়ে পরে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলে। রাস্তায় দেখা হয় বন্ধুদের সঙ্গে। তখন আনন্দ বেড়ে দ্বিগুণ।

ওয়াংনিম কিয়াং পাহাড়ে ম্রো সম্প্রদায়ের শিশুদের জন্য নির্মিত বিনা বেতনের স্কুল। পাহাড়প্রেমী স্বপ্নবাজ ৪ তরুণ মিলে প্রতিষ্ঠা করেছেন ওয়াংনিম কিয়াং।
আদুই পাড়াতে সকাল হলেই শিশুদের এমন দুরন্তপনা চোখে পড়ে। জিংপ্রিং ম্রোর মতো মেনতাম ম্রো, সংপ্রং ম্রো, যাংরু ম্রোসহ আরও অনেক শিশুদের বাধ ভাঙা উচ্ছ্বাস যেন আর থামে না। ওদের সবার গন্তব্য ওয়াংনিম কিয়াংয়ে।

পাহাড়ে ম্রো সম্প্রদায়ের শিশুদের জন্য নির্মিত বিনা বেতনের স্কুল ওয়াংনিম কিয়াং। পাহাড়প্রেমী স্বপ্নবাজ ৪ তরুণ মিলে প্রতিষ্ঠা করেছেন স্কুলটি।

বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার ৪ নম্বর কুরুকপাতা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের দুর্গম আদুই পাড়াতে এই স্কুলের অবস্থান। স্কুলের নামটাও ম্রো ভাষায়। ওয়াংনিম অর্থ মেঘ আর কিয়াং অর্থ পবিত্র ঘর। যা এখানে স্কুল অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলা, ইংরেজি ও ক্রামা (ম্রো ভাষা), তিন ভাষার বর্ণমালাই শেখানো হয় স্কুলটিতে। যেহেতু মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ শিশুদের মৌলিক অধিকার, তাই শুরুতে ম্রো বর্ণমালাতে জোর দেওয়া হচ্ছে।

ভোরে সূর্যের আলোতে পাহাড় আলোকিত হলেও অন্ধকার যেন কখনোই কাটে না সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬০০ ফিট ওপরের আদুই পাড়াতে। কেননা, এখানে সাক্ষরতার হার শূন্যের কোঠায়। এই পাড়ার সবচেয়ে কাছের স্কুলটিতে যেতে আসতে কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা সময় লাগে। তাই প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্বেও এই পাড়ার শিশুরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত।

স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা ৪ তরুণের একজন সিফাত আমিন আদিল। তাদের স্বপ্নের স্কুল নিয়ে বলেন, ‘পাহাড়ে শিক্ষায় দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে পরা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ম্রো । অন্যদিকে, পাহাড়ে স্কুল না থাকার কারণে ম্রো শিশুরা বছরের পর বছর শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। তাদের নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন অনেক দিনের। সেই কাজকে গতিময় করতেই আমি, মুহিত ভাই, তানভীর সাইতা ভাই ও পেয়ারে আলম ভাই মিলে এক বছরের প্রচেষ্টায় এবং স্থানীয়দের অক্লান্ত সহযোগিতায় তৈরি করেছি ওয়াংনিম কিয়াং। ম্রো ভাষা এবং প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের লক্ষেই আমাদের পথ চলা।’

ভোরে সূর্যের আলোতে পাহাড় আলোকিত হলেও অন্ধকার যেন কখনোই কাটে না সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬০০ ফিট ওপরের আদুই পাড়াতে। কেননা, এখানে সাক্ষরতার হার শূন্যের কোঠায়। এই পাড়ার সবচেয়ে কাছের স্কুলটিতে যেতে আসতে কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা সময় লাগে। তাই প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্বেও এই পাড়ার শিশুরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত।
সিফাত আমিন আদিল জানান, বর্তমানে ৪ জন প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের পাশাপাশি প্রায় ৩০ জন স্থায়ী সদস্যের নিয়ে আমাদের ওয়াংনিম কিয়াং পরিবার। প্রতি মাসে চাঁদা তুলে চলছে স্কুল। বেতন দিয়ে রাখা হয়েছে স্থানীয় ম্রো শিক্ষক। এছাড়া রয়েছে স্কুল পরিচালনা কমিটি।

‘ভবিষ্যতে পাহাড়ে ম্রোদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ওয়াংনিম কিয়াং বটবৃক্ষের মতন কাজ করবে। আমরা ক্লাস ৩ পর্যন্ত বাচ্চাদের এখানে সম্পূর্ণ ফ্রি পড়াব এবং পরবর্তীতে তাদেরকে শহরে আবাসিক স্কুলে নিয়ে যাব। ক্লাস ৪-৫ পর্যন্ত তারা শহরের আবাসিক স্কুলে পড়বে। শিশুদের পড়ার খরচ অর্ধেক দেবে ওয়াংনিম কিয়াং।’ বলছিলেন পাহাড়ি এই স্কুলের আরেক উদ্যোক্তা মহিউদ্দিন আল মুহিত।

বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে যেতে খুব ভালো লাগে। স্কুলে সবাই একসঙ্গে শিখি। বন্ধুদের সঙ্গে খেলি, শিখি। স্কুলের মজাই আলাদা। বড় হয়ে আমার এই স্কুলের শিক্ষকের মতো পড়াতে চাই।
সাংরাও ম্রো, শিক্ষার্থী

ওয়াংনিম কিয়াংয়ের আরেক উদ্যোক্তা তানভীর সাইতা বলেন, ‘বছর খানেক আগে শত উৎকণ্ঠা নিয়ে পাহাড়ে ম্রোদের জন্য একটা স্কুল করার পরিকল্পনা করেছিলাম। হাঁটি হাঁটি পা পা করে সেই স্কুল আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। এই খুশি বলে বোঝানো সম্ভব না। স্বপ্নও আস্তে আস্তে ডালপালা ছড়াচ্ছে। এক সময় এই ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়বে পাহাড় থেকে পাহাড়ে, পাড়া থেকে পাড়ায় এবং জীবন থেকে জীবনে।’

শিক্ষার্থী সাংরাও ম্রো বলে, ‘বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে যেতে খুব ভালো লাগে। স্কুলে সবাই একসঙ্গে শিখি। বন্ধুদের সঙ্গে খেলি, শিখি। স্কুলের মজাই আলাদা। বড় হয়ে আমার এই স্কুলের শিক্ষকের মতো পড়াতে চাই।’

এই স্কুলে এখন ২৩ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। আনন্দের খবর এই যে, বছরের প্রথম ২ মাসেই ২৩ বাচ্চার মধ্যে ২০ জনই বর্ণমালা শিখে ফেলেছে। কিন্তু তাদের সবাইকে আমার একা পড়াতে হয়। যদি এই প্রতিষ্ঠানে আরও দুই একজন শিক্ষক থাকত তাহলে পাঠদান আরও ভালো হতো। মাংওয়াই, স্কুল শিক্ষক, ওয়াংনিম কিয়াং।

শিক্ষার্থী সংম্মং ম্রোর বাবা মেনলেং ম্রো বলেন, ‘আমরা তো পড়াশোনা করতে পারি নাই। তাই চাই ছেলেমেয়েরা যেন লেখাপড়া করতে পারে। এখন তারা এখন স্কুলে যায়। ভালো লাগে। কয়েক মাস আগেও এখানে স্কুল ছিল না। সেখানেই আজ বাচ্চারা লেখাপড়া করছে মনের আনন্দে। এর থেকে সুন্দর দৃশ্য আর কি হতে পারে?’

ওয়াংনিম কিয়াং স্কুলের শিক্ষক মাংওয়াই বলেন, ‘এই স্কুলে আপাতত ২৩ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। আনন্দের খবর এই যে, বছরের প্রথম ২ মাসেই ২৩ বাচ্চার মধ্যে ২০ জনই বর্ণমালা শিখে ফেলেছে। কিন্তু তাদের সবাইকে আমার একা পড়াতে হয়। যদি এই প্রতিষ্ঠানে আরও দুই একজন শিক্ষক থাকতো তাহলে পাঠদান আরও ভালো হতো।’

ওয়াংনিম কিয়াং স্কুল কমিটির সভাপতি সদস্য মেনওই বলেন, আমার গ্রামের শিশুরা লেখাপড়া করতে খুব আগ্রহী। কিন্তু দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়াতে কাছের সরকারি স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করা তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব। এজন্য এলাকার স্কুলটি আমাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। এখন আমাদের ছেলেমেয়েরা বিনা পয়সাতে লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। খুব ভালো লাগে। একদিন আমাদের এই স্কুলের শাখা ছড়িয়ে পরবে প্রতিটি ম্রো পাড়ায়। আধার কালো মেঘ কাটিয়ে, মেঘ শিশুরা আলো নিয়ে আসবেই।

সূত্র: ঢাকা মেইল

Exit mobile version