parbattanews

পাহাড়ের রাজনীতিতে নয়া মেরুকরণ : জেএসএস’র নেতার সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ

Rangamati pic-2(Usaton Talukdar)
আলমগীর মানিক, রাঙামাটি : আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশের সবচে বড় জেলা রাঙ্গামাটি। ৬১১৬.১৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের পাহাড়ি এই জেলাটি সদর, বাঘাইছড়ি, লংগদু, জুরাছড়ি, বরকল, বিলাইছড়ি, কাপ্তাই, নানিয়ারচর, কাউখালী ও রাজস্থলি এই ১০টি উপজেলা নিয়ে গঠিত। জেলায় চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, মুরং, বোম, খুমি, খেয়াং, চাক, পাংখোয়া, লুসাই, সাওতাল, রাখাইন এবং বাঙালিসহ ১৪টি জাতির গোষ্ঠির বসবাস। ১৯৯১ সাল থেকে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরুর পর বিগত ৪টি সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে তিনবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও একবার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হয়।

কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে এবার আওয়ামী লীগের এ দুর্গে হানা দিয়েছে পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি (জেএসএস)। প্রায় ১৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে আ’লীগ সমর্থিত প্রার্থী দীপংকর তালুকদারকে পরাজিত করে সংসদে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেছে জেএসএস। এই জয়ের মধ্য দিয়ে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রতিষ্ঠা করা সংগঠনের পক্ষ থেকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধি হবার সুযোগ পেলো।

জেএসএস আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের সংগ্রামে পার্বত্যাঞ্চলে দীর্ঘদিন সশস্ত্র সংগ্রাম শেষে ১৯৯৭ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তির শর্ত হিসেবে গহীন অরণ্য ছেড়ে এসে অস্ত্র সমর্পণ করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নতুন  আন্দোলন শুরু করে সংগঠনটি। একই সাথে চুক্তির পর থেকে শুরু হয় নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত। ফলে বিপুল সংখ্যক কর্মী ও সাধারণ পাহাড়ি নারী-পুরুষের জীবনাবসান ঘটে, যা এখনও অব্যাহত আছে। এই অবস্থার মধ্যেও একসময় যে আওয়ামী লীগকে চুক্তিতে বাধ্য করেছিলো সেই দলটিকেই আবার রাজনীতির মাঠে বিপুল সংখ্যক ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে নিজেদের নতুন সামর্থ্যরে কথা জানান দিলো জেএসএস।

বড় ধরনের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই রাঙ্গামাটি সংসদীয় আসনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে পাহাড়ের এই দলটি তথা একজন গেরিলা নেতা উষাতন তালুকদার। সদালাপী এই পাহাড়ি নেতা নির্বাচনের শুরু থেকেই কারচুপির আশঙ্কা করে পাহাড়ের জনসাধারণকে ভোট কেন্দ্র পাহাড়া দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি দাবি করেছিলেন যে, প্রশাসনযন্ত্র তাকে হারিয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী তথা পার্বত্য প্রতিমন্ত্রীকে বিজয়ী করতে ষড়যন্ত্র করছে। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে অবশ্য জেএসএস’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, প্রশাসন ষড়যন্ত্র করলেও শেষ পর্যন্ত নিজেদের ঐক্য, আন্তরিকতার ফলে জনতার শক্তির জয় হয়েছে।

তবে দেশের প্রধান বিরোধী দলবিহীন একটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচনে এই জেলা থেকে তিন তিনবার নির্বাচিত এমপি দীপংকর তালুকদারের পরাজয় যেন পার্বত্য রাজনীতির প্রতি একটি আচমকা ধাক্কা। এই পরাজয় দলের, ব্যক্তির নাকি সম্প্রদায়ের সেই ব্যাখ্যা পেতে হয়তো আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মূলত দীপংকরের আত্মঅহংকারই শেষ পর্যন্ত তাকে পরাজিত করেছে। তৃণমূল পর্যায় থেকে রাজনীতির সাথে যুক্ত দীপংকর নিজ যোগ্যতার বলেই এতদূর উঠে এসেছেন। তবে নিন্দুকেরা বলে থাকেন, জনতা বারবার তাকে সেই যোগ্যতার পুরস্কার দিয়ে এমন এক উচ্চতায় তুলে দিয়েছে, যেখানে গিয়ে তিনি আর কর্মীদের সাথে সংযোগ রক্ষা করতে পারেননি। যে কারণে গত পাঁচ বছরে দলের ত্যাগী নেতা কর্মীরা নানাভাবে বঞ্চিত ও নিগৃহীত হয়ে দূরে সরে গেছেন।

দীপংকরের চারপাশে গত কয়েক বছর ছিল শুধু চাটুকার আর সুবিধাভুগীদের ভিড়। তিনি বিষয়টি বুঝেও না বোঝার ভান করেছেন, অথবা অন্য কোন কারণে এড়িয়ে গেছেন। এর ফলেই তাকে চরম মূল্য দিতে হলো। দীপংকরের এই হার হয়তো তার ব্যক্তি জীবনের জন্য তেমন ক্ষতিকরও নয়, কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় উপজাতীয় নেতাদের জন্য পুনর্বাসিত হওয়া একেবারে তুচ্ছ বিষয়। তাই নির্বাচনে পরাজিত হলেও তিনি হয়তো কোনো ভালো পদ পেয়ে যাবেন। কিন্তু তার এই হার পার্বত্য রাজনীতির জন্য কী ভবিষ্যত ডেকে আনছে তাই এখন দেখার বিষয়। কেননা যিনি এবার নির্বাচিত হলেন, তিনি একসময় সশস্ত্র আন্দোলন করেছেন, গেরিলা কমান্ডার ছিলেন। একজন গেরিলা থেকে নির্বাচিত হয়ে তিনি পরিস্থিতি কতটা মোকাবেলা করতে পারবেন তা হয়তো সময়ই বলে দিবে। কেননা একসময় যাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র চালিয়েছেন, এখন তাকে একজন নির্বাচিত নেতা হিসেবে সেই মানুষদেরও নেতা হিসেবে প্রমাণ করতে হবে, সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে। আর এটাই হবে তার মূল চ্যালেঞ্জ।

অন্যদিকে এই পরাজয়ের মাধ্যমে দীপংকর তার অতীতের ভুলগুলো উপলব্ধি করতে পারেন কিনা সেটাও পর্যবেক্ষণ করার সময় এখন। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিগত দিনে ক্ষমতার মসনদে থাকা এই প্রতিমন্ত্রী যেসব এলাকায় সর্বোচ্চ পরিমাণ বরাদ্দ প্রদান করেছিলেন সেইসব এলাকায় এবারের নির্বচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা আশানুরূপ হয়নি, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেসব এলাকার নিজ দলীয় নেতাকর্মীদের ভোট থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন তিনি। এটা হয়েছে মূলত সুবিধাভুগিদের কারণে। কেননা তিনি যাদের নামে যা কিছু বরাদ্দ দিয়েছেন, সেটা তার পকেটেই চলে গেছে। ত্যাগী নেতাকর্মীরা তেমন কিছু পায়নি। একই কারণে সাধারণ ভোটাররাও বিমুখ হয়েছেন তার দিক থেকে।

উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ- ২৪,৬০৪ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়, ১৯৯৬ সালে এই একই দল জয়ী হয় ২৪,৬৯২ ভোটের ব্যবধানে। ২০০১ সালে প্রায় ১৭,৭৪৪ ভোটের ব্যবধানে আ’লীগকে হারিয়ে পাহাড়ি এই জেলায় ক্ষমতায় আসে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র প্রার্থী। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীকে ৫৮,৫৮৩ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে ক্ষমতার মসনদে আবারো ফিরে আসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী বর্তমানে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার।

সর্বশেষ চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৯ নং রাঙামাটি আসনে প্রায় ১৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে আ’লীগ সমর্থিত প্রার্থী দীপংকর তালুকদারকে পরাজিত করে সংসদে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করলো সাবেক গেরিলা নেতা ও বর্তমানে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি।

 

Exit mobile version