পাহাড়ে অপহরণ-মুক্তিপণ খেলা!

wadud bhuyan

ওয়াদুদ ভূইয়া

অবশেষে গতকাল ১৭ জুলাই ২০১৪ খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা থেকে অপহৃত চার শ্রমিক উদ্ধার। অপহরণের ১১ দিন পরে অপহরণকারীদের থেকে জেলার ব্যাঙমারা এলাকায় সেতু উন্নয়ন প্রকল্পের অপহৃত চার বাঙ্গালী শ্রমিককে উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী।

সিন্ধুকছড়ি জোনের আওতাধীন কংসীমুড়া প্রাক্তন সেনা ক্যাম্প এলাকা থেকে বৃহস্পতিবার রাত পৌন ৯টার দিকে তাদেরকে উদ্ধার করা হয় বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। উদ্ধারকৃতরা হলেন- বুলডোজার চালক রাজু মিয়া, বুলডোজারের হেলপার হাসান মিয়া, মো. ফারুক মিয়া ও লিয়াকত আলী।

এখানে পার্বত্য অঞ্চলের একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে সংশ্লিষ্ট ও দায়িত্বযুক্ত মহলের কাছে আমার বিনীত প্রশ্ন:

. পাহাড়ের এই গরিব মানুষগুলো অপহরণ করলো কারা, করে আসছে কারা? তাদের সাংগঠনিক বা সামাজিক পরিচয় কি বের করা হয়েছে? সরকার/প্রশাসন তা প্রকাশ করেছে? তাদের নামে কি কোন মামলা নেয়া হয়েছে? যদি এসব না করা হয়ে থাকে, তাহলে কেন করা হয়নি? ভাসুরর নাম নিতে বাধা কোথায়? নাকি ভাসুরপোকে মাঝে মাঝে নিজের পো মনে হয়? নাকি নিজের পো’র মত করে লালন পালন করা হয়?

আজ সময় এসেছে পার্বত্যবাসী তা জানতে চায় এবং পার্বত্যবাসী তা সন্দেহের দৃষ্টিপথে ভাবছে! যা বিগত ৪০ বছরও ভাবার বা অনুভবযোগ্য মনে করেনি! কিন্তু আজ কেন করবে তাও দায়িত্ববানদের বিবেচনায় নেয়া দরকার। কারণ সংবাদে বলা হয়েছে অপহৃতদের উদ্ধার করা হয়েছে ঘেরাও দিয়ে, আবার কেউ কেউ বলছে এদের উদ্ধারের পেছনে স্থানীয় সরকারী দলের লালিত এক মেয়রের মাধ্যমে অপহৃতদের প্রকল্প কোম্পানি থেকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে অপহৃতদের মুক্তি দিয়েছে অপহরণকারীরা।

এখন প্রশ্ন হলো কোনটি সত্য? অন্যদিকে কেউ বলছে অপহরণকারীরা ইউপিডিএফ, আবার কেউ বলছে জেএসএস। আমি জানতে পেরেছি অপহরণকারীরা হচ্ছে ‘জেএসএস (সংস্কার)। পাহাড়ে আগে অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, চাঁদা আদায়, হত্যাকারী ছিল শুধুমাত্র একটি আঞ্চলিক দল। আর এখন তা দাঁড়িয়েছে তিনগ্রুপে। এখন তিনগ্রুপই অপহরণ, চাঁদা আদায় ও সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। এই সন্ত্রাসের শিকার পাহাড়ের নিরীহ, নিরস্ত্র পাহাড়ি – বাঙ্গালী সবাই। জেএসএস-এর এক সময়ের ছাত্র সংগঠনের নেতার হাত ধরে, বর্তমানে ইউপিডিএফ শক্ত অবস্থান নিয়েছে। জেএসএস-এর শীর্ষ নেতাদের একসময়কার সহকর্মীরা ওয়ান-ইলেভেনে জাতীয় রাজনৈতিকদলগুলোর সংস্কারপন্থী গ্রুপের অনুকরণে এবং পার্বত্য অঞ্চলের ওই সময়কালের ক্ষমতাসীনদের অনুগ্রহবর্ষণে বা নির্দেশনায় জেএসএস (সংস্কার) নামে পাহাড়ে তৃতীয় আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।

বর্তমানে এই তিনটি আঞ্চলিক অস্ত্রধারী দল পাহাড়ে, আবার দেশের বাহিরে নিজেদেরকে গ্রুপভিত্তিক রাজনৈতিক দল হিসাবে পরিচয় দিয়েও অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘমেয়াদে। এই তিনগ্রুপের নির্যাতনের লক্ষ্যই হলো নিরস্ত্র বাঙ্গালী -পাহাড়ি বিশাল জনগোষ্ঠী। মনে হয় যেন, রাষ্ট্র এই জনগোষ্ঠীর সাথে নাই, বরং অনেকটা সহানুভূতিশীল অস্ত্রধারী ক্ষুদ্র গ্রুপগুলোর পক্ষে।

17.07.2014_Matiranga Labour Recover Pic-03

. অপহৃত চারজনকে উদ্ধার করা হলো, খুবই খুশির খবর। কিন্তু অপহরণকারীদের মধ্যে থেকে একজনও ধরা পড়লো না! অতীতে কি উল্লেখযোগ্য কোন অপহরকারী আটক হয়েছিল? হয়ে থাকলে তাদেরকে কি বিচারের আওতাভুক্ত রাখা হয়েছে? আমার জানামতে তেমন উল্লেখযোগ্য কেউ নেই। তাহলে কি কারনে অপরাধীদেরকে তাদের অপকর্ম সহজতর করে দেয়া হচ্ছে? এতে কি এই অপহরণ, গুম, হত্যা ইত্যাদি দীর্ঘপথে নিয়ে যেতে রাষ্ট্র সহায়ক ভূমিকা রাখছে না? কেউ কেউ মনে করে, রাখছে। নিকট আগামীতে রাষ্ট্রকেই এ আঘাতজনিত ব্যথাহত হতে হবে। এটা আমাদের সবাইকে ভেবে দেখা জরুরি।

. আমাদের জানতে ইচ্ছে করে প্রায় ৫-৬ মাস আগে খাগড়াছড়ি সদরের ভূয়াছড়ি থেকে অপহৃত শিশু শহিদুলকে কেন আজও উদ্ধার করা হলো না? বা উদ্ধারকাজ চলছে কিনা? কিন্তু ওই শিশু অপহরণের পর মহালছড়ি-রাংগামাটি সড়কে অপহৃত রাংগামাটির বিশিষ্ট শিল্পী ও দেশের বড় আমলার মেয়ের পাহাড়ি জামাই হওয়াতে তাকে দ্রুত উদ্ধার করা সম্ভব হল। কিন্তু বাঙ্গালী শিশুটি কি গরিব ঘরের সন্তান বা সরকার দলের কোন মদদপুষ্ট মেয়রের মাধ্যমে মোটা অংকের টাকার বিনিময় করতে পারেনি বলে শিশুটির ভাগ্যে কি ঘটেছে আজও তার মা-বাবা ও পার্বত্যবাসী জানতে পারছে না? তাহলে এখানে দায়িত্বশীলদের ভূমিকা কই? তাহলে কি শুধু অর্থ ও মুক্তিপনের বিনিময়েই আমাদের মুক্তি হবে,বছরের পর বছর?

. আজ পাহাড়ের সাধারণ নাগরিক তথা নিরস্ত্র পাহাড়ি -বাঙ্গালীরা জানতে চায়, কবে আর কতকাল পরে পাহাড়ে শান্তি স্থাপন হবে। হবে নাগরিকদের বসবাসযোগ্য একটু স্বাধীন ভূমি? আমার দীর্ঘদিন পাহাড়ে কাজ করে একটা বিষয়ে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, পাহাড়ের সাধারন নাগরিকরা সত্যিই শান্তিতে বসবাস করতে চায়, সমঝোতা ও সহাবস্থান চায়। চায় শান্তি ও উন্নয়ন এবং এই অস্ত্রহীন পাহাড়ি – বাঙ্গালীরা সত্যিকারভাবেই এই সন্ত্রাসী অস্ত্রধারী চাঁদাবাজদের পতন চায়। এখন দরকার সকল মহলের আন্তরিক ইচ্ছা, যা কিনা সাধারণ মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাবে, যা হলে এই চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে রুখে দেয়া খুব কঠিন নয়। এ অবস্থায় পাহাড়বাসীর পক্ষে এ বিষয়ে আমি সকলের শুভ ইচ্ছাময় ভূমিকা কামনা করছি।

লেখক: সাবেক সংসদ সদস্য, ও সাবেক চেয়ারম্যান, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: অপহরণ, ইউপিডিএফ, উপজাতি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন