parbattanews

পাহাড়ে উপজাতি নারীদের ৬ চ্যালেঞ্জ

উপজাতি নারী

কাজী সোহাগ, রাঙ্গামাটি থেকে |
তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে প্রায় ১০ লাখ নারী বাস করছেন ৬ চ্যালেঞ্জ নিয়ে। এগুলো হচ্ছে বৈষম্যমূলক আচরণ, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, বিবাহ বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব, ভরণপোষণ ও নির্যাতন। দিনের পর দিন এসব চ্যালেঞ্জ আরো কঠিন হয়ে পড়ায় উদ্বিগ্ন নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো। এ নিয়ে পার্বত্য জেলাগুলোতে নিয়মিত কর্মসূচি পালন করছেন তারা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রচলিত আইন আর প্রথাগত নিয়মের বিরোধ এর মূল কারণ। তাদের মতে এই দুই দ্বন্দ্বের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন কেবল উপজাতি নারীরা। সমতলের মুসলিম, হিন্দু এবং খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য নারীরা পিতা বা স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার, বিবাহ সংক্রান্ত প্রমাণপত্র এবং অন্যান্য সামাজিক অধিকার যথাযথভাবে পেলেও উপজাতী নারীরা তাদের এ জাতীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত।

এসব জনগোষ্ঠীর বসবাস বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে হলেও, তারা নারীদের অধিকারের বিষয়ে বাংলাদেশের সংবিধান, আইন-এর শাসন ইত্যাদি অনুসরণ না করে নিজেদের প্রথাগত রীতিনীতি এবং পদ্ধতিগত ঐতিহ্য অনুসরণ করেন।

এ প্রসঙ্গে পার্বত্য অঞ্চলের মানবাধিকার কর্মী এডভোকেট সুস্মিতা চাকমা বলেন, তিন পার্বত্য জেলায় যেভাবে উপজাতি মেয়েদের ওপর বৈষম্য বাড়ছে তাতে আমরা সত্যিই উদ্বিগ্ন। এখানে নারীরা ভীষণভাবে উপেক্ষিত। উত্তরাধিকার সূত্রে তারা সম্পত্তির মালিক হতে পারেন না। বাবা মারা গেলে ওই সম্পত্তির মালিক হচ্ছেন ছেলেরা। আবার কারও ছেলে সন্তান না থাকলে সম্পত্তি পাচ্ছেন ভাইয়ের ছেলেরা।

তিনি বলেন, পার্বত্য জেলাগুলোতে হেডম্যান ও কার্বারি সিস্টেম রয়েছে। তারা পারিবারিক আদালতের মতো বিচার-আচার করেন। এসব বিচারেও বেশিরভাগ নারী ন্যায় বিচার পাচ্ছেন না। সব মিলিয়ে উপজাতি নারীদের সামাজিক মর্যাদা নানাভাবে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে।

একই প্রসঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুপ্রভা চাকমা বলেন, উপজাতি নারীরা দীর্ঘদিন ধরে সহিংসতা ও উত্তরাধিকার নিয়ে আন্দোলন করে আসছে। জাতিগতভাবে এখানে রয়েছে নানা প্রথা। পাশাপাশি রয়েছে প্রচলিত আইন।

এদিকে ২০১১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৫ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় অবস্থিত ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী মোট ২২০ জন নারী ও শিশু ভিকটিম সেবা গ্রহণ করেছেন। এদের মধ্যে ৪৪ জন ধর্ষণের শিকার হলেও পারিবারিক সহিংসতার শিকার সেবাগ্রহণকারীর সংখ্যা ৭১ জন, যারা উপজাতি সম্প্রদায়ের প্রথাগত রীতিনীতির স্বীকার।

বর্তমানে পারিবারিক সহিংসতার শিকার সেবাগ্রহণকারীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এ কারণে নারীর প্রতি বৈষম্য প্রভৃতির ক্ষেত্রে বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার নারীদের জন্য উপজাতিভিত্তিক নারী সংগঠনগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

এদিকে উপজাতি নারীদের অধিকার ও বঞ্চনা নিয়ে কাজ করা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশিরভাগ উপজাতীয় সম্প্রদায়ের প্রথা অনুযায়ী নারীদের পিতা-মাতা ও স্বামীর সম্পদের মালিকানায় উত্তরাধিকারের কোনো পদ্ধতি নেই। এ কারণে উপজাতী নারীরা সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

বর্তমানে পার্বত্য ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনী পাস হওয়ায় উপজাতি নারীরা আদৌ তার সুফল ভোগ করতে পারবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রায় সকল উপজাতী সম্প্রদায়ের বিবাহ বন্ধনের ক্ষেত্রে নারীদের মতামতকে প্রাধান্য না দিয়ে শুধু অভিভাবকদের মতামতের ভিত্তিতে পাত্রস্থ করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবারের অভিভাবকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্য সম্প্রদায়ের যুবকের সঙ্গে কোনো মেয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে তাকে পরিবার ও সমাজচ্যুত করা হয়।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রেম বা অবৈধ সম্পর্কের বিষয়টি ধরা পড়লে সমাজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি শূকর/বন্য অথবা এর মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা করে, ছেলে এবং মেয়েকে জুতার মালা পরিয়ে জন সম্মুখে ঘুরানো হয়। যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে সচেতন সমাজে কোনো ক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়।

বিবাহের নিবন্ধন না থাকায় বর্তমান শিক্ষিত উপজাতি যুব সমাজের মধ্যে একাধিক বিবাহ করার প্রবণতার পাশাপাশি পূর্বের স্ত্রীকে অস্বীকার ও ভরণপোষণ সঠিকভাবে প্রদান না করার ঘটনা ঘটছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপজাতী নারীরা চরমভাবে অবমূল্যায়িত হলেও বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের আশ্রয় নিতে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাহস পান না। সমাজ তাদের একেবারেই সহযোগিতা করে না। তাই বাধ্য হয়ে তাদের সাম্প্রদায়িক প্রথা এবং সামাজিক রীতিনীতি অনুযায়ী স্থানীয় হেডম্যান ও কারবারির করা বিচারের রায় মাথা পেতে মেনে নিতে হয়।

আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আঞ্চলিক উপজাতি সংগঠনের চাপে উপজাতি মেয়ে সঠিক বিচার পাওয়া তো দূরের কথা বরং তাকে অপমানজনক নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়। এমনকি বিষয়টি যাতে চাপা থাকে সে জন্য মেয়ে এবং মেয়ের পরিবারের সদস্যদের নানাভাবে হুমকি প্রদর্শনও করা হয়। বাংলাদেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমতা, ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণি নির্বিশেষে সকলের সম অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র ও নারীর প্রতি সকল ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডো) স্বাক্ষর করেছে। ইতিমধ্যে সরকার নারী-পুরুষের সমানাধিকার, নারীর সুরক্ষা ও নারীর উন্নয়নে বেশকিছু নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নারীর সুরক্ষায় চলমান আইনের পাশাপাশি যৌতুক নিরোধ আইন-১৯৮০, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০, এসিড দমন আইন-২০১০, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইন-২০১৩ ইত্যাদি বিশেষ আইনও প্রণয়ন করেছে।

বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে অন্যান্য এলাকার স্থানীয় সরকার পর্যায়ে নারী সদস্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও উপজাতি জনগোষ্ঠীর সমাজ ব্যবস্থা এবং তাদের রীতিনীতি অনুযায়ী পুরুষতান্ত্রিকতার বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীরা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাই পার্বত্য অঞ্চলের নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার পাশাপাশি ভূমির অধিকার থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত রয়েছেন।

এতে বলা হয়েছে, পারিবারিক সহিংসতা নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক জরিপ না হলেও নির্যাতনের মাত্রা মোটেও কম নয়। পার্বত্য ভূমি কমিশন আইন-এর সংশোধনীতে নারীদের বিষয়টি আলাদাভাবে উল্লেখ না থাকায়, পার্বত্য এলাকার ভূমি উপজাতি জনগোষ্ঠীর সামাজিক ব্যবস্থায় ভোগ ও দখলের অধিকারের ক্ষেত্রে উপজাতি নারীগণ পুনরায় বঞ্চিত ও অবহেলিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান- সার্কেল চিফ, হেডম্যান, কার্বারি যাদের ওপর পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত উপজাতিদের সামাজিক বিচার, মৌজা সার্কেলের ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনাসহ খাজনা আদায়ের দায়িত্ব অর্পিত, এ প্রতিষ্ঠানগুলো পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত। এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করছে।

বিগত কয়েক বছর ধরে উইমেন রিসোর্স নেটওয়ার্ক, কাপেং ফাউন্ডেশন, মালেয়া ফাউন্ডেশন, হিল উইমেন ফেডারেশন, কেএমকেএস, অনন্য নারী কল্যাণ সংস্থা, বলিপাড়া নারী কল্যাণ সংস্থা, জাবারাং কল্যাণ সমিতি, প্রগেসিভ, বাংলাদেশ উপজাতি (আদিবাসী) নারী নেটওয়ার্ক, খাগড়াপুর মহিলা সমিতি, গর্জনতলী নারী কল্যাণ সমিতিসহ বিভিন্ন সংস্থা নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ এবং অধিকার আদায়ে নানা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে।

উপজাতি জনগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায় ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম পালন করে থাকেন। যেমন, চাকমা-বৌদ্ধ ধর্ম, মারমা-বৌদ্ধ ধর্ম, ত্রিপুরা-সনাতন ধর্ম, বর্ণ-খ্রিষ্টান ধর্ম, সাঁওতাল-সনাতন ধর্ম, ম্রো-বৌদ্ধ ধর্ম পালন করেন। উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলো তাদের নিজ নিজ ধর্মের নিয়মকানুন অনুসরণ করলেও তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি অনুযায়ী নারীদের অধিকার এবং নারীদের মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে তা অনুসরণ করেন না।

তারা তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের প্রথা অনুসরণ করে থাকেন। ধর্মীয়ভাবেও উপজাতি নারীরা ব্যক্তিগত জীবন, সামাজিক জীবন, বৈবাহিক জীবন এবং পিতা বা স্বামীর সম্পদের উত্তরাধিকারের বিষয়ে গুরুত্ব পাওয়ার কথা থাকলেও সাম্প্রদায়িক প্রথার কারণে তারা ব্যাপকভাবে অবমূল্যায়িত হন।

সূত্র: দৈনিক মানবজমিন

Exit mobile version