parbattanews

পাহাড়ে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের এখনই সময়

মোয়াজ্জেমুল হক ॥

অবৈধ অস্ত্র ও দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা না গেলে সবুজের পাহাড়ে সাধারণ মানুষের জিম্মিদশার অবসান ঘটার কোন সম্ভাবনা নেই বলে ব্যাপকভাবে সব মহলে আলোচিত হচ্ছে। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যেমন জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে অনুরূপ নীতি পাহাড়কেন্দ্রিক জোরালো করা গেলে অস্ত্রের ঝনঝনানি ও রক্তের হোলিখেলা বহুলাংশে হ্রাস পেতে বাধ্য বলেও বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে।

এছাড়া যে দুটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন বর্তমানে চার ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে এবং এদের অন্তর্কোন্দলের নেপথ্যের নায়কদেরও কঠোরহস্তে দমনের দাবি উঠেছে। উল্লেখ করা যেতে পারে বেসরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী পাহাড়ে বর্তমানে বছরে শত কোটি টাকারও বেশি অবৈধ চাঁদা আদায় করছে পাহাড়ী দুর্বৃত্তরা। এলাকা কেন্দ্রিক এদের আধিপত্য ক্রমাগতভাবে বিস্তৃতি লাভ করায় পাহাড়ের বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশেষে সকলেই সার্বক্ষণিক নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে।

গত ১৮ ও ১৯ মার্চ দু’দিনে উপজেলা নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ৭ এবং এক আওয়ামী লীগ সভাপতিকে ব্রাশফায়ার ও মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যার সর্বশেষ ঘটনা গোটা পাহাড়কে যেমন আলোড়িত করেছে তেমনি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বিষয়টি ফলাও প্রচার হয়েছে। ফলে সরকার পক্ষেও বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ইতোমধ্যে কম্বিং অপারেশন শুরু হয়েছে।

১৮ মার্চ সোমবারের সাত হত্যাকা- অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে হয়েছে বলে ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সেনাবাহিনী সর্বোপরি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পক্ষ থেকে মত ব্যক্ত করা হয়েছে। ১৯ মার্চ বিলাইছড়ি আওয়ামী লীগ সভাপতি সুরেশ কুমার তঞ্চঙ্গ্যা হত্যাকা-ও অনুরূপ পরিকল্পনার একটি অংশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ইতোপূর্বে তিন পাহাড়ের মধ্যে বিশেষ করে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে এ ধরনের অসংখ্য হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে। ঝরে গেছে বহু নিরীহ প্রাণ।

অপরদিকে, বান্দরবানে বেশিরভাগ ঘটনা অপহরণের। বান্দরবানের গহিন অরণ্যে মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় অবৈধ অস্ত্রধারী দুর্বৃত্তদের উৎপাত থাকায় এরা বিভিন্ন সময়ে অপহরণের মাধ্যমে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদের, বাণিজ্যিক কর্মকা-ে জড়িতদের জিম্মি করে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করে আসছে। মোদ্দা কথা, অবৈধ অস্ত্রই দুর্বৃত্তদের বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত হয়ে চাঁদাবাজি, অপহরণের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায়ের পথকে সুগম করে রেখেছে।

অপরদিকে, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর জনসংহতি সমিতির প্রধান সন্তু লারমার সঙ্গে তারই সেকেন্ড ইন কমান্ড খ্যাত প্রসিত খিসার মতবিরোধের জের ধরে জন্ম হয় ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। একদিকে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে আছেন সন্তু লারমা। বিপরীতে প্রসিতের নেতৃত্বে ইউপিডিএফ। দীর্ঘ সময় জুড়ে এই দুই নেতা দু’গ্রুপের নেতৃত্বে দিতে গিয়ে ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষের অজস্র ঘটনা ঘটিয়েছে। একে অপরকে ঘায়েল করতে অবৈধ অস্ত্রে হত্যা করেছে একের পর এক বিপরীত গ্রুপের সদস্যদের।

বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, দুই মেরুর এই দু’নেতা এবারের উপজেলা নির্বাচনের আগে এক হয়ে নিজেদের কার্যক্রম ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় নেমেছেন। দু’জনের মধ্যে যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক ছিল তা এখন আর নেই। তবে জনসংহতি সমিতি যেমন দু’ভাগে বিভক্ত, তেমনি ইউপিডিএফও। এই দুই সংগঠনের চার গ্রুপের অধিকাংশ সদস্য পাহাড়ের অবৈধ অস্ত্রে চাঁদাবাজির আধিপত্য বিস্তার করে রাখতে সক্ষম হয়েছে।

জেলার আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভায় আলোচিত হয়েছে চাঁদাবাজির বিষয়টি। এতে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে জনসংহতি সমিতির দুই গ্রুপ এবং ইউপিডিএফকে পৃথক পৃথকভাবে ধার্য করে দেয়া বাৎসরিক চাঁদা প্রদান করতে হয় সাধারণ চাকরিজীবী থেকে ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্যোক্তাসহ বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগ কর্মকা-ে জড়িতদের। এছাড়া এমনকি সাপ্তাহিক হাট-বাজারে পণ্য বিক্রেতাদের কাছ থেকেও পণ্যভেদে চাঁদা আদায় করা হয়ে থাকে। জেলা প্রশাসনের আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, জনসংহতি সমিতির সন্তু ও সংস্কারপন্থী এবং ইউপিডিএফকে তিন ভাগে বাৎসরিক চাঁদা প্রদান করতে হয়। সভায় উল্লিখিত হয়েছে, বাস প্রতি জেএসএসের দুই গ্রুপকে ৫ হাজার টাকা হারে এবং ইউপিডিএফকে ৩ হাজার টাকা, ট্রাক প্রতি ৬ হাজার ও ৪ হাজার, চাঁদের গাড়ি (জীপ) ৩ হাজার ২ হাজার ও দেড় হাজার, মাইক্রোবাস ৩ হাজার ২ হাজার ও দেড় হাজার, সিএনজি ও মিনি ট্রাক ১ হাজার করে, টমটম ৬ হাজার ও ৫শ’ করে, ট্রাক্টর ৮শ’ করে, ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল ৫শ’, চাকরিজীবীদের মোটরসাইকেল প্রতি ৩শ’, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোকে ৩০ হাজার ২০ হাজার ও ১০ হাজার, মোবাইল অপারেটর রবিকে ৪ লাখ, সাড়ে ৪ লাখ ও সাড়ে ৩ লাখ, গ্রামীণফোনকে ৪ লাখ, সাড়ে ৩ লাখ ও ৩ লাখ, টেলিটককে ১ লাখ, ৮০ হাজার ও ৫০ হাজার, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানিকে ৫ লাখ, ৭ লাখ ও ৫ লাখ টাকা হারে চাঁদা প্রদান করতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও কাঁঠাল, আনার, কলার ছড়াসহ বিভিন্ন পণ্য এমনকি বাঁশ বিক্রি থেকেও চাঁদা আদায় হয়ে থাকে। গৃহপালিত পশু পাখি বিক্রিতেও চাঁদা দেয়া বাধ্যতামূলক। উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, রাস্তা, সেতু, কালভার্ট, বিল্ডিং নির্মাণেও চাঁদার পরিমাণ ধার্য রয়েছে। তিন পার্বত্য জেলার ২৫ উপজেলা ছাড়াও ইউনিয়ন গ্রামপর্যায়েও রয়েছে জনসংহতি সমিতির পক্ষে নিয়োজিত চাঁদার কালেক্টর। পাহাড়ি জুম চাষীরাও চাঁদা প্রদানের প্রক্রিয়া থেকে রেহাই পাচ্ছে না।

বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের মজুদ নিয়ে জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফের সদস্যরা বছর জুড়ে অবৈধ চাঁদার অর্থে বেপরোয়া যেমন হয়ে আছে, তেমনি সাধারণ মানুষের জিম্মিদশা মারাত্মক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। প্রতিবেশী দুটি দেশ থেকে ভারিসহ বিভিন্ন অস্ত্র ও গোলাবারুদের যোগান পাচ্ছে এসব পাহাড়ী দুর্বৃত্তরা। জনসংহতি সমিতি প্রধান সন্তু লারমা একদিকে গত প্রায় ১৯ বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান পদে আসীন রয়েছেন। প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা নিয়ে তিনি আর্থিকসহ রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে চলেছেন। শান্তি চুক্তির পর ১৯৯৮ সালে তিনি আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান পদে মনোনীত হন তিন বছর মেয়াদে। কিন্তু এরপর থেকে এ পর্যন্ত এ পরিষদের আর কোন নির্বাচন হয়নি। শুধু তাই নয়, জেলা পরিষদ নির্বাচনও অনুরূপভাবে আটকে রয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার আমলেই এতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তির অধিকাংশ ধারা ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে। অন্যতম প্রধান সমস্যা ভূমি বিরোধ নিয়ে জটিলতার অবসান এখনও করা যায়নি।

অপরদিকে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বিগত দুই মেয়াদের সরকার এবং একইদল নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ ব্যয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড রয়েছে পাহাড়ে উন্নয়নের মহাযজ্ঞে। এছাড়া সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন সরকারী সংস্থা একের পর এক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছে। সড়ক, ব্রিজ, কালভার্ট, একের পর এক নির্মিত হয়ে গোটা পাহাড় এবং উন্নয়নের মহাসড়কে। শুধু তাই নয়, শিক্ষা সংস্কৃতিসহ সব ক্ষেত্রে উন্নয়নে জোয়ার বয়ে চলেছে। শুধু রাঙ্গামাটি শহরেই হয়েছে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়, যার মধ্যে একটি কারিগরি ও অন্যটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া বান্দরবানে বেসরকারী উদ্যোগে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলেছে। পাহাড়ে ইতোপূর্বেকার সড়ক মহাসকে উন্নীত হয়েছে। জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুত ও সোলার সিস্টেমে বিদ্যুত পাহাড়ের গ্রামেম গ্রামে পৌঁছে দিচ্ছে। একাধিক প্রাথমিক ও হাইস্কুল সরকারীকরণ করা হয়েছে। পাহাড়কে পর্যটনের অন্যতম আধুনিক কেন্দ্রে পরিণত করতে চলছে নানামুখী প্রয়াসও।

কিন্তু এই পাহাড়ে পাহাড়ী দুর্বৃত্তরা অবৈধ অস্ত্রে যে রক্তের হালিখেলা অব্যাহত রয়েছে, তাতে প্রশ্ন উঠেছে, কোন রহস্যের কারণে এদের এই অবৈধ কর্মকা- পরিচালিত হচ্ছে এবং কারা এর নেপথ্যের নায়ক। জনসংহতি সমিতির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ সরকারী সুবিধা নিয়ে বিপরীতে তাদের কর্মী বাহিনী দিয়ে চাঁদাবাজির মহোৎসব ও অস্ত্রের হোলি খেলায় মেতে থাকার বিষয়টি সঙ্গত কারণে ভাবা প্রশ্নর উদ্রেক করে আছে। জনসংহতি সমিতি সরকারী স্বীকৃত। এ সমিতির সঙ্গে সরকারের শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। কিন্তু ইউপিডিএফ স্বীকৃত কোন আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল এটি স্বঘোষিত। এ দুটি সংগঠন চারভাগে বিভক্ত হয়ে নিজেদের হীন স্বাথ্য চরিতার্থে গোটা পাহাড়কে অস্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে গেছে। যা কখনও কাম্য হতে পারে না।

এ অবস্থায সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের পক্ষে দাবি উঠেছে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এখন সর্বাগ্রে প্রয়োজন। অবৈধ অস্ত্র ও উদ্ধার ও অস্ত্রবাজদের দমনে সরকার পক্ষে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে অভিযান পরিচালনা করা। ইতোমধ্যে বাঘাইছড়ির হত্যাকা-ের ঘটনার পর সেনাবাহিনী কম্বিং অপারেশন পরিচালনা করছে। এ ধরনের অপারেশন অতীতে বহুবার বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু এতে সাময়িক সফলতা আসলেও চূড়ান্ত সাফল্য অর্জিত হয়নি। সঙ্গ কারণে পাহাড় জুড়ে চাঁদাবাজ, অস্ত্রবাজও অবৈধ অস্ত্রের মজুদ কেন্দ্রগুলো চিরতরে গুঁড়িয়ে দেয়ার এখনই সময় বলে শান্তিকামী কমল মহলের পক্ষে দাবি উঠেছে।

সূত্র: জনকন্ঠ

Exit mobile version