‘পাহাড়ে প্রত্যাহারকৃত সেনাক্যাম্পে পুলিশ বসানো যাবেনা এ তথ্য শান্তিচুক্তির কোথাও নেই’

fec-image

জাতীয় সংসদে রাঙামাটির সংসদ সদস্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার বলেছেন , ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পরিত্যাক্ত ক্যাম্পগুলোতে পুলিশ বসানো যাবেনা, এমন তথ্য পার্বত্য শান্তি চুক্তির কোথাও লেখা নেই। এখন অনেকেই বলছেন যে এটা নাকি শান্তি চুক্তির বরখেলাপ। এটা নাকি শান্তিচুক্তির লঙ্ঘন।’

সরকার পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নিরাপত্তা ভীতি দূর করার লক্ষ্যেস্থানীয় জনগণের চাহিদার প্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিত্যক্ত সেনা ক্যাম্পগুলোতে এপিবিএন ব্যাটালিয়ন বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ।

আমরা পরিস্কারভাবে বলতে চাই পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা অবৈধ অস্ত্রধারী, অবৈধভাবে যারা চাঁদা আদায় করছেন, এসব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে এবং অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। তবেই শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে এবং স্বাচ্ছন্দ্য হবে। অতএব এই এপি ব্যাটালিয়ন সরকার বসাচ্ছে জনগণের চাহিদার ভিত্তিতে।

সুতরাং আমাদের এই ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে আমাদেরকে সচেতন থাকতে হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) একাদশ জাতীয় সংসদের ১৮তম অধিবেশনের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা ও উত্তর-টেবিলে উপস্থাপন এবং ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বাজেট সম্পর্কে সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে রাঙামাটির সংসদ সদস্য বক্তব্য প্রদান করেন।

নিন্মে তার বক্তব্যের পুরোটা হুবহু তুলে ধরা হলো।

রাঙামাটির মহকুমার সাবডিভিশনাল অফিসার ছিলেন বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ফূফা জনাব সৈয়দ হোসেন। আমাদের বর্তমান নেত্রী তখনকার হাসিনা আপা রাঙামাটি বেড়াতে গিয়েছিলেন। তার খুব ইচ্ছে ছিলো আগ্রহ ছিলো সাজেক যাওয়ার। কিন্তু তখনো সাজেক যাওয়ার কোনো পথ ছিলোনা। হাতির পিঠে করে নিয়ে সাজেক যেতে হতো। তিনি রাঙামাটি থেকে বাঘাইছড়ি পর্যন্ত গিয়েছেন। কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকার কারনে তার সাজেক যাওয়া হয় নাই। সেই কথাটা তিনি মনে রেখেছেন।

২১ বছর পর জনগণের মেন্ডেড পেয়ে তিনি যখন সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন তখন তিনি রাঙামাটিতে প্রথম যে কাজটি করেছিলেন, সেটি হলো সাজেকে যাওয়ার রাস্তা নির্মাণের নির্দেশ দিয়ে। মনে রাখবেন ১৯৬৯ সাল এবং ১৯৯৬ এই ক টা বছরে ২৮/২৯ বছরে সাজেক যাওয়ার কোনো রাস্তা তখনো নির্মাণ হয়নাই। সেই শুরু। এই যে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা টা বাংলাদেশের অন্যতম পিছিয়ে পড়া একটা এলাকা। সেখান থেকে আজকে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন ক্ষেত্র হয়েছে সাজেক। পাহাড়ে মাইলের পর মাইল রাস্তা হয়েছে। স্কুল কলেজ, হাসপাতাল এগুলো দালান হয়েছে।

২৬টি উপজেলায় কাছাকাছি সব জায়গায় ইলেকট্রিসিটি গেছে। যেখানে ১০/১৫ বছরেও ইলেকট্রিসিটি যাওয়া সম্ভব নয় সেখানে সোলারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ দেওয়া হচেছ। পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো এলাকাকে জাতীয় সংহতি অর্থাৎ জাতীয় রাজনীতির মূল স্রোতে টানার জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকা থেকে নির্বাচিত আমি। সুতরাং এই বাজেটে কিছু সুপারিশ আমি করতে চাই।

ঠেগামুখ স্থলবন্দর বাস্তবায়ন কার্যক্রম ও ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা দ্রুত চালুকরণ প্রসঙ্গেঃ

প্রথমত হলো রাঙামাটি জেলার বরকল উপজেলার ঠেগামুখে একটি এলসি ল্যান্ড স্টেশন করার জন্য ভারত এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে একটি এমওইউ স্বাক্ষর হয়েছিলো বেশ কয়েক বছর আগে। এখানে যদি ল্যান্ড এলসি স্টেশন হয় তাহলে পরে এই লাকায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রাণ সঞ্চারিত হবে আমরা রাজস্ব পাবো। একই সঙ্গে যদি এখানে একটা ইমিগ্রেশন পয়েন্ট হয় তাহলে পরে অতি সহজে ওখান থেকে মানু যাতায়াত করতে পারবে। সুতরাং এই এলসিল্যান্ড স্টেশন কাজটিকে ত্বরান্বিত করার জন্য আমি জোর সুপারিশ করছি।

স্বল্পপুঁজির ঠিকাদারদের জন্য ৩ কোটি টাকার নীচের টেন্ডারগুলো এলটিএম’করনের দাবিঃ

রাঙামাটিতে স্বচ্ছল বেশি পূজি আছে এইরকম ঠিকাদারের সংখ্যা খুবই কম। সেই জন্য সেখানে একটি সরকারি সিদ্ধান্ত মতে তিন পার্বত্য জেলায় তিন কোটি টাকার নীচে যেসমস্থ কাজগুলো আছে সেকাজ ওটিএম নয় এলটিএম করার একটা নির্দেশ রয়েছে। কারন ওটিএমে করলে পয়েন্ট হিসেবে রাঙামাটি-বান্দরবান, খাগড়াছড়ির কোনো কন্ট্রাকটার কোনো টেন্ডারে এটেন্ড করতে পারেনা। সেজন্য এলটিএম করে নিয়ে সবাই ৫% লেস দেবে যারা লটারিতে কাজ পাবে তারা কাজটি করবে। কিন্তু এটা এই নির্দেশ যথাযতভাবে পালিত হচ্ছেনা বলে নিয়ে স্বল্প পূজির ঠিকাদাররা খুব অর্থনৈতিক কষ্টের মধ্যে আছেন।

রাঙামাটির ১৪২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করনের দাবিঃ

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি চিটাগাং হিল ট্রাক্সে প্রথম ধাপে ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছিলেন, এর দ্বিতীয়ধাপে ২৭টি, তৃতীয়ধাপে ১৪টি এবং বিশেষ বিবেচনায় আপনি শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামে আরো ২১০টি প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরমধ্যে ১৪২টি জাতীয়করণের জন্য উপযুক্ত এমন স্কুল বাদ পড়েছে। সুতরাং এই স্কুলগুলো জাতীয়করণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা খুবই জরুরি।

পাহাড়ের পর্যটন সম্ভাবনায় কমপ্রেইনসিভ প্রকল্প গ্রহণের সুপারিশঃ

পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনের সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। সুতরাং এখানে যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করবে তারা যেন সহজেই বুঝতে পারে তারা একটা পর্যটন শহরে প্রবেশ করছে। এই ধরনের পার্বত্য তিন জেলাকে সাজানো দরকার। আর সাজাতে গেলে এখানে সংশ্লিষ্ট্য সকল কর্তৃপক্ষ সকল মন্ত্রণালয়কে একটা কমপ্রেইনসিভ প্রকল্প দিতে হবে এবং সেই প্রকল্পটা বাস্তবায়নের প্রয়োজন।

জেলা প্রশাসক কর্তৃক বাজার ফান্ডের বন্দোবস্তি অনাপত্তি পত্র না দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিঃ

মাননীয় স্পিকার পার্বত্য চট্টগ্রামে বাজার ফান্ড নামের একটা প্রশাসন আছে। এই প্রশাসনের লিজপ্রাপ্ত এক ব্যক্তির মামলার কারনে যারা স্থায়ী বন্দোবস্তি আছে তারাও এখন ব্যাংক থেকে লোন পাচ্ছেনা। এই মামলার কারনে ওখানকার জেলা প্রশাসন যে অনাপত্তি দিতে হয় সেটি দিচ্ছে না। আর এই অনাপত্তি নাদিলে ব্যাংক থেকে কেউ লোন পায়না। এই লোন না পাওয়ার কারনে অত্রাঞ্চলে ব্যবসা বানিজ্যে মন্দা ও স্থবিরতা নেমে এসেছে। এই ক্ষেত্রে যাতে করে ব্যবসায়িরা লোন নিতে পারে তার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে হবে। অন্যদিকে, হাউজবিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের কাছে টাকা আছে কিন্তু এই অনাপত্তি না থাকার কারনে এই হাউজ বিল্ডিং কর্পোরেশন থেকে লোন নিতে পারছেনা। সুতরাং এই বিষয়টি খুবই জরুরি ভিত্তিতে দেখা দরকার বলে আমি করছি।

ক্ষুদ্র জাতি স্বত্তাসমূহর সম্প্রদায়ের অর্ন্তভূক্ত লোকগুলোকে মাতৃভাষার শিক্ষক নিয়োগ প্রদান প্রসঙ্গেঃ

মাননীয় স্পিকার আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্ষুদ্র জাতি স্বত্তাসমূহর সম্প্রদায়ের অর্ন্তভূক্ত লোকগুলোকে নিজেদের ভাষায় নিজেদের বর্ণমালায় নিজেদের মাতৃভাষায় প্রাইমারি লেভেল পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। কিন্তু যারা শিক্ষা দেবে মনে করেন অঙ্গের মাস্টার তাকে তিনমাস ট্রেনিং দিয়ে বলা হচ্ছে তুমি চাকমা ভাষায় শেখাও। একজন ফ্রিজিক্সের মাস্টার তিনমাস ট্রেনিং দিয়ে তাকে বলা হচ্ছে তুমি মারমা ভাষায় শিক্ষা দাও। এটা বোধয় সমীচিন হবে না। সুতরাং এই ভাষা এবং নিজের বর্ণমালায় শিক্ষকতা করার জন্য অবিলম্বে এমপ্লয়মেন্টের ব্যবস্থা করতে হবে যারা ওয়েল ট্রেইন এবং এই ব্যাপারে যাদের দখল আছে তারা যেন এই শিক্ষকতার কাজটি যেন পায়।

শান্তি চুক্তির কোথাও উল্লেখ নেই প্রত্যাহারকৃত সেনা ক্যাম্পগুলোতে পুলিশ বসানো যাবেনাঃ

মে মাসের ২৬ তারিখ আমাদের মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এপি ব্যাটালিয়নের একটি রেঞ্জ অফিস উদ্বোধন করেছেন। তিন পার্বত্য জেলায় তিনটি ব্যাটালিয়ন থাকবে। এনিয়ে শুরু হয়েছে, নানা ধরনের কথাবার্তা। যেমন একটি মহল বলছে যে শান্তিুচুক্তিতে আছে অপ্রয়োজনীয় সেনাক্যাম্প গুটিয়ে আনা হবে। এরই মধ্যে গুটিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু এখন জনগনের ভীতি দূর করা এবং এলাকার মানুষের চাহিদা অনুসারে সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিত্যক্ত সেনা ক্যাম্পগুলোতে এপিবিএন ব্যাটালিয়ন বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন অনেকেই বলছেন যে এটা নাকি শান্তিচুক্তির বরখেলাপ। এটা নাকি শান্তিচুক্তির লঙ্গণ? শান্তিচুক্তিতে কোথাও লেখা নাই! পরিত্যাক্ত সেনাক্যাম্পগুলোতে পুলিশ বসানো যাবেনা সুতরাং অপচেষ্ঠা হচ্ছে মাননীয় স্পিকার; একই সঙ্গে বলতে চাই, আবার একটি মহল বলছে সেনাবাহিনী এবং সরকার বাহিনীর দ্বারা ওখানকার মানুষ নাকি অতিষ্ট নাভিশ^াস উঠছে। কিন্তু আমরা পরিস্কারভাবে বলতে চাই পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা অবৈধ অস্ত্রধারী, অবৈধভাবে যারা চাঁদা আদায় করছেন, এসব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে এবং অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। তবেই শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে এবং স্বাচ্ছন্দ্য হবে। অতএব এই এপি ব্যাটালিয়ন সরকার বসাচ্ছে জনগণের চাহিদার ভিত্তিতে। সুতরাং আমাদের এই ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এই অপচেষ্ঠার বিরুদ্ধে আমাদেরকে সচেতন থাকতে হবে।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে যারা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ-প্রতিরোধে যারা অস্ত্র ধরেছেন, তাদেরকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিঃ

এমপি দীপংকর তালুকদার স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, মাননীয় স্পিকার আমি একটি কথা বলে আমার বক্তব্য শেষ করতে চাই। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রায়শ বলেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে কে কোথায় ছিলেন? ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পরে কিছু তরুন তাদের জান-মাল বাজি রেখে অস্ত্রহাতে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ প্রতিরোধ করেছিলো। যারা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ-প্রতিরোধে যারা অস্ত্র ধরেছেন, তাদেরকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হোক। একই সাথে যারা সেসময় যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন এবং যারা আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন, যারা অসুস্থ এই সমস্থ প্রতিরোধ যোদ্ধাদের জন্য আগামী বাজেটে একটি তহবিল গঠন করার দাবিও জানিয়েছেন রাঙামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: পাহাড়, শান্তি চুক্তি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন