parbattanews

পাহাড়ে বৈসাবিন বর্জনের নীরব ষড়যন্ত্র চলছে

বৈসাবিন( বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু, নববর্ষ) উৎসব সমাগত হলে খাগড়াছড়িসহ তিন পার্বত্য জেলায় শুরু হয় নানামুখী ষড়যন্ত্র। পাহাড়ের মানুষ ভালো নেই, এখানে চলছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ইত্যাদি মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে একটি চিহিৃত মহল পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রাণের উৎসব বর্জনের আহ্বান জানিয়ে থাকেন।

যদিওবা পাহাড়ি জনগোষ্ঠী প্রতিবারই ষড়যন্ত্রকারীদের জাল ছিন্ন করে তাদের প্রাণের উৎসব বৈসাবিন পালন করে এসেছে। এবারও সে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালায় অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ এক শীর্ষ সন্ত্রাসী নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে আটকের পর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়। এ ঘটনার জেরে ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের সন্ত্রাসীরা তাণ্ডব লীলা শুরু করে। সে সাথে ভুয়া ছবি পোস্ট করে পাহাড়িদের বাড়ি-ঘরে আগুন লাগানোর মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে চিহিৃত সন্ত্রাসীরা। যারা ২০১৩ সালে খাগড়াছড়িতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভা বানচাল করার জন্য গাড়ীতে পেট্রোল বোমা হামলা, বেইলী ব্রিজের পাটাতন উপরে ফেলাসহ নজীর বিহীন তাণ্ডব চালিয়ে ছিল।

ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত: গত ১৬ মার্চ (মঙ্গলবার) সকাল ৮টার দিকে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালার বাবুছড়ায় নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে অস্ত্র, গুলি ও বিপুল সামরিক সরঞ্জামসহ ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের সামরিক কমান্ডার মিলন ওরফে সৌরভ চাকমাকে আটক করা হয়। আটকের পর সে অসুস্থ বোধ করলে তাকে দীঘিনালা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেলা ১১টায় সেখানে তার মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন দীঘিনালা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পেয়ার আহম্মেদ। দীঘিনালা সূত্র জানায় তার বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা, চাঁদাবাজি ও অস্ত্র মামলা রয়েছে।

চিকিৎসকের মতে, মিলন চাকমা ওরফে সৌরভ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। অথচ ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের সদস্যরা এ ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য উস্কানীমূলক তৎপরতা শুরু করে। ঐদিন বিকাল ৫টার দিকে দীঘিনালার বাবুছড়া বাজার এলাকায় ঢাকা শান্তি পরিবহনের একটি বাসের যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে পেট্রোল ঢেলে বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। একই সময় বাবুছড়া এলাকায় আরও দুটি ট্রলিতে অগ্নিসংযোগ ও বেশ কয়েক জনকে মারধর করা হয়। এরপর থেকে দীঘিনালা উপজেলার বিভিন্ন সড়কে আতঙ্কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

খাগড়াছড়ি সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সাংগঠনিক সম্পাদক রুকন উদ্দিন জানান, দুর্বৃত্তরা মঙ্গলবার (১৬ মার্চ) বিকেলে দীঘিনালায় একটি বাস ও দুটি ট্রলিতে আগুন দেয়। শ্রমিক ও পরিবহনের নিরাপত্তায় হুমকি থাকায় দূরপাল্লার বাস ছাড়া বন্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাত ব্যক্তি ফোন করে যানবাহন না চালানোর জন্য হুমকি দেওয়া হয়েছে। ফলে ভয়ে কেউই দীঘিনালায় গাড়ি চালাতে সাহজ পাচ্ছে না। এতে করে খাগড়াছড়ি জেলার সাথে রাঙামাটির লংগদু, বাঘাইছড়ি, সাজেক ও বাবুছড়া সড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ রেখেছে।

এদিকে ওইদিন রাতে খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলার জয়সেন পাড়া এলাকায় পাহাড়িদের কয়েকটি নবনির্মিত ঘরে বাঙালিরা আগুন দিয়েছে মর্মে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা অপপ্রচার চালানো হয়। কিন্তু খবর নিয়ে জানা গেছে পুরো ঘটনাটিই সাজানো ও সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতি নষ্ট করার পরিকল্পিত অপপ্রচার। এ নিয়ে চিহিৃত মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত বেশ কিছু অনলাইন ভিত্তিক পত্রিকা ও নিউজ পোর্টালের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক পেইজ-এ খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলার মাইছছড়ির জয়সেনপাড়া এলাকায় কিছু উপজাতিদের নির্মিত বাড়িতে আগুন লাগানোর ঘটনার সংবাদ প্রকাশ করা হয়। এর জন্য দায়ী করা হয় ওই এলাকায় বসবাসরত বাঙ্গালীদের। এছাড়া আরো বলা হয় ওই ঘর গুলিতে বসবাসরত প্রায় ৯টি পাহাড়ি পরিবারের ঘর পুড়িয়ে বাস্তুহীন করা হয়েছে। এই সংবাদের প্রেক্ষিতে এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিগণ, সাংবাদিক এবং সরকারি কর্মকর্তাসহ একটি দল ওই সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। কিন্তু পুরো ঘটনায় নেহায়েতই মিথ্যা ও বানোয়াট এবং উদ্দেশ্য প্রণোদীত বলে প্রমাণিত হয়।

ঘটনাস্থল পরিদর্শনকারীরা জানান, এলাকায় পরিদর্শন মাত্র দুইটি অস্থায়ীভাবে নির্মিত ঘরের পোড়া অংশবিশেষ দেখতে পাওয়া গেছে। এছাড়া স্থানটি দূর্গম এবং জনমানবহীন এলাকা হওয়ায় সেখানে নয়টি ঘরের কোন অস্থিত্ব কখনই ছিল না বলে জানান পরিদর্শন দল। পাশাপাশি উক্ত জায়গাটির নথিপত্র চাওয়া হলে স্থানীয়দের মধ্যে শুধুমাত্র বাঙ্গালীরাই তাদের কবুলিয়তনামার কপি প্রদর্শন করতে সমর্থ হয়। এ সময় যা স্থানীয় হেডম্যান ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বাঙালিরাই এ ভূমির মালিক জানান।

এ সময় উপস্থিত বাঙ্গালীরা বলেন, কিছু দিন পূর্বে এই জমিটি কয়েকজন পাহাড়ি সন্ত্রাসী দখলের চেষ্টা করে। এ সময় সন্ত্রাসীরা জমির মালিক দাবি করায় বাঙালিদের হামলা ও নির্যাতন করে। এবং সূর্য ভানু নামক একজনের মাথা ফাটিয়ে দেন। যার প্রেক্ষিতে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বাঙালিরা ভূমি কমিশনার, মহালছড়ি বরাবর সঠিক বিচারের জন্য আবেদন পত্র প্রেরণ করেন।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, সন্ত্রাসীরা পরিস্থিতি ঘোলাটে করার উদ্দেশ্যে গত ১৪ মার্চ আনুমানিক রাত্র ১০টায় অস্থায়ীভাবে তাদের নির্মিত দুইটি ঘরে নিজেরাই আগুন ধরিয়ে দেয় এবং বাঙ্গালীদের উপর দোষ চাপিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করতে থাকে। পরিদর্শন দল কর্তৃক সামাজিক যোগাযোগ এবং অনলাইন নিউজ পোর্টাল এর মাধ্যমে প্রাপ্ত ফুটেজে দেখা যায় ভিডিওটি ও ছবিগুলো ১৪ মার্চ রাত ৯টা ৪৫ এ ধারন করা হয়েছে। এছাড়াও ওই ভিডিও এবং ছবিতে কোনো বাঙালির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে কয়েকজন পাহাড়িকে ভিডিওটিতে দেখা গেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাঙালিরা যদি আগুন দিয়ে থাকে সেখানে পাহাড়ি উপস্থিত হয়ে ভিডিও করলো কি করে।

স্থানীয় শান্তি প্রিয় পাহাড়ি-বাঙালিদের মতে, এলাকার সার্বিক শান্তি ও সম্প্রীতি নষ্ট করার উদ্দেশ্যে এবং সাধারণ শান্তি প্রেমী পাহাড়ি ও বাঙ্গালীদের মাঝে ভেদাভেদ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে চিহিৃত মহলটি এই ঘটনাটি পরিকল্পিতভাবে সাজিয়েছে। ঘটানো হয়।  ঘটনাস্থলে পরিদর্শন করে স্থানীয় পাহাড়ি ও বাঙালিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। এটি তৃতীয় পক্ষ অথ্যাৎ ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপকে দায়ী করেছে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে পরিদর্শন দল জনপ্রতিনিধিরা সাধারণ মানুষকে মিথ্যা অপপ্রচারে বিভ্রান্তি না হয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার আহ্বান জানান।

সাজেকের মিজোরাম সীমান্তে ৬১ লাখ টাকা ভারতীয় রুপি, বিপুল পরিমাণ ভারী আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদসহ পাঁচ ইউপিডিএফ প্রসীত সন্ত্রাসী আটক এবং খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলার জয়সেন পাড়া এলাকায় পাহাড়িদের কয়েকটি ঘরে আগুন দেওয়ার মিথ্যা অপপ্রচার বৈসাবি উৎসব বানচালের নতুন কৌশল বলে মনে করে পর্যবেক্ষক মহল।

সূত্র জানায়, গত ১৪ মার্চ রাঙামাটির বাঘাইছড়ি সাজেক ও ভারত সীমান্তের কমলা নগরের ছোট পানছড়ি এলাকায় ৬১ লাখ ভারতীয় রুপি, ৩টি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও বিপুল পরিমান গোলাবারুদসহ বকুল কসুম চাকমা ও তার চার সহযোগীকে আটক করা হয়েছে। আটককৃতরা প্রাথমিকভাবে ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের সদস্য বলে জানা গেছে।

অপর দিকে মঙ্গলবার বিকালে বান্দরবানে সন্ত্রাসীদের গুলিতে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের সক্রিয় সদস্য জলন্ত চাকমাকে (৪০) গুলি করে হত্যা করা হয়। বান্দরবান জেলা সদরের টংকাবর্তীর ৭নং ওয়ার্ডের চাকমা পুনর্বাসন এলাকায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটে।

এদিকে আগামী রবিবার খাগড়াছড়িতে আধা বেলা সড়ক অবরোধ ডেকেছে ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপ। ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) প্রসীত গ্রুপের প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগে দায়িত্বে থাকা নিরন চাকমা বুধবার বিকালে সংবাদ মাধ্যমে প্রেরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ অবরোধ আহ্বান করেন।

পর্যবেক্ষক মহলের মতে, প্রতি বছর বৈসাবিন উৎসব সমাগত হলে একটি চিহিৃত মহল নানা অপতৎপরতায় মেতে ওঠে। উদ্দেশ্য দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ। এখন যা শুরু হয়েছে ওই ষড়যন্ত্রেরই অংশ।

পাহাড়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পাহাড়ের মানুষের নিরাপত্তায় আমরা কাজ করছি। যে কোন মূল্যে মানুষের শান্তি বজায় রাখতে মহল বিশেষের যে কোন অপতৎপরতা প্রতিরোধ করা হবে।

Exit mobile version