parbattanews

পাহাড়ে যে নির্যাতন ও দখলদারিত্ব চলছে তাতে পাহাড়িদেরও একটি ক্ষুদ্রগোষ্ঠী যুক্ত ও লাভবান হচ্ছে: আনু মুহম্মদ

Songhoti somabesh

স্টাফ রিপোর্টার:

পার্বত্য চট্রগ্রামে পাহাড়িদের জমি-জায়গা জবরদখল চলছে উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে পাহাড়িদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানিয়েছেন তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব আনু মুহম্মদ। তিনি বলেন, পাহাড়ে ভূমি দখলদারিত্ব চলছে। আর এই দখলদারিত্বের পেছনে শুধু বাঙালী আর সরকারি আমলারা জড়িত নয়, এর সাথে পাহাড়িদের অনেকেও জড়িত আছে। তারাও লাভবান হচ্ছে। তাই এর বিরুদ্ধে সকল পাহাড়িকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

সংবেদনশীলতার অভাবে পাহাড়ে জাতিগত সহিংসতা চলছে মন্তব্য করে তিনি আরো বলেন, শান্তিচুক্তির ১৮ বছর পরও পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। কারণ সেখানকার মূল জনগোষ্ঠি জুম্মু জাতির সাথে কোন আলাপ-আলোচনা না করে তাদের বাসস্থানের কাছে ক্যাম্পগুলো তৈরি করা করা হয়েছে।

শুক্রবার (২০ মার্চ) বিকাল ৪টায় ঢাকায় জাতীয় যাদুঘরের সম্মুখে গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের উদ্যোগে আয়োজিত এক সংহতি সমাবেশ তিনি এসব কথা বলেন।

সমাবেশে ভূমিরক্ষা কমিটির সভাপতি পরিতোষ চাকমার সভাপতিত্বে বক্তব্য রেখেছেন প্রফেসর আনু মহাম্মদ (তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব), জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম লালা, মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, দীঘিনালা উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান সুসময় চাকমা, কবাখালি ইউপি চেয়ারম্যান বিশ্বকল্যাণ চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সভাপতি মাইকেল চাকমা ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি থুইক্যচিং মারমা। সভা পরিচালনা করেন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাধারণ সম্পাদক অংগ্য মারমা। সমাবেশে উপস্থিত থেকে সংহতি প্রকাশ করেছেন মঙ্গলধ্বণির সম্পাদক শাহরিন আরাফাত, গণমুক্তি গানের দলের নাট্য সম্পাদক নাহিদ সুলতানা লিসা, জ্ঞানালোক ধর্মীয় শিক্ষা পরিষদের জুয়েল বড়ুয়া। সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন ৪নং দীঘিনালা ইউপি চেয়ারম্যান চন্দ্র রঞ্জন চাকমা, বিজিবি কর্তৃক উচ্ছেদকৃত শশী মোহন পাড়ার কার্বারী নতুন চন্দ্র চাকমা, গোপাদেবী চাকমা ও তার মেয়ে অপ্সরী চাকমা। এছাড়া হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভানেত্রী নিরূপা চাকমাও উপস্থিত ছিলেন। সমবেশে দীঘিনালা উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান সুসময় চাকমা, কবাখালি ইউপি চেয়ারম্যান বিশ্বকল্যাণ চাকমা ও ভূমিরক্ষা কমিটির সভাপতি পরিতোষ চাকমা বাবুছড়ায় ভূমি বেদখলের চিত্র তুলে ধরেন এবং আন্দোলনে সংহতি জানানোর জন্য উপস্থিত বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ধন্যবাদ জানান।

‘দীঘিনালা উপজেলায় ২১ পাহাড়ি পরিবারকে উচ্ছেদে করে ৫১ বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদরদপ্তর স্থাপনের অভিযোগ এনে তা অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার দাবিতে এবং উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলোকে নিজ নিজ ভূমিতে পুনর্বাসনের দাবিতে’ এ সংহতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

প্রফেসর আনু মহাম্মদ দীঘিনালা আরও বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত থাকলে বাংলাদেশও অশান্ত থাকবে। পাহাড়ে যে নির্যাতন ও দখলদারিত্ব চলছে তার সাথে শুধু সেনাবাহিনী আর আমলারা নয়, পাহাড়িদের মধ্য থেকেও একটি ক্ষুদ্রগোষ্ঠী এর সাথে যুক্ত ও লাভবান হচ্ছে। ‘৯৭ সালে যে ‘শান্তিচুক্তি’ হয় তাতে নির্দিষ্ট পর্যায়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় নি, তা আমরা সবাই জানি। পাহাড়ের অধিবাসী যাদের সবাইকে জুম্মো বলা হয়, তাদের মধ্যেও বিভেদ তৈরি হয়েছে। লড়াইয়ে ঐক্য না থাকায় লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না। পাহাড়িদের নিজেদের মধ্যে যেমন ঐক্য প্রয়োজন, তেমনি সমর্থকদের সাথেও ঐক্য গড়া দরকার। পাহাড়ে যে নির্যাতন নিপীড়ন আর দখলদারিত্ব চলছে তাতে শুধু পাহাড়িরা নয় সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীও। এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দায়িত্ব শুধু পাহাড়িদের নয়, অন্যদেরও দায়িত্ব আছে। বাঙালিদের মধ্যে যারা সংবেদনশীল তাদের সাথে ঐক্য সম্প্রসারিত করতে হবে।’
আনু মহাম্মদ আরও বলেন,‘দেশের মোট জনসংখ্যার ৯৯ ভাগ বাঙালি হলেও এদেশে আরও বহু জাতি আছে। হিন্দু বৌদ্ধসহ ধর্ম বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী অনেকে আছে, রাষ্ট্রটা সবার। এটি একটি বহু জাতিক রাষ্ট্র। যে লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, স্বাধীনতার পর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল সংবেদনশীলতা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারে নি। জাতিগত সংঘাত বিদ্বেষ ও বৈষম্য বেড়েছে।’

ব্যারিস্টার জ্যেতির্ময় বড়ুয়া তার বক্তব্যে বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের চেয়ে সেটলারদের সংখ্যা বছর বছর বেড়ে যাচ্ছে। এক সময় সেটলাররাই সংখ্যাগুরু হয়ে পড়বে। হিসেব করলে পাহাড়িদের চেয়ে সেনা আর সেটলারের সংখ্যা বেশী হতে পারে। সারা দেশে ৪৮০০০ একর জমি সেনাবাহিনীকে দেয়া হয়েছে। দেশের সবচেয়ে ভাল, লোভনীয় জমি অবৈধভাবে সেনাবাহিনীকে দেয়া হচ্ছে। দেশের সংবিধানে এভাবে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংস করে কোন সংস্থাকে জমি দেয়ার বিধান নেই।’ যাদের ক্ষমতা আছে আইন কী তাদের জন্য তা তিনি প্রশ্ন রাখেন। তিনি আরও বলেন, ‘মেজরিটির আগ্রাসন চালানোর ক্ষমতা রয়েছে। সংখ্যায় কমদের ওপর চলছে আগ্রাসন নির্যাতন। অতীতে তা দেখা গেছে, ভবিষ্যতেও তার আলামত স্পষ্ট। এককভাবে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব নয়, তার জন্য সবাই মিলে আন্দোলন করতে হবে। মি. বড়ুয়া দীঘিনালায় শান্তিপূর্ণ পদযাত্রায় হামলা, যশোহরে হামলা, রামুতে হামলা বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করেন এবং তীব্র নিন্দা জানান।

জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম তার বক্তব্যে দীঘিনালা শান্তিপূর্ণ পদযাত্রায় সেনা-পুলিশের হামলা, ধরপাকড় ও মিথ্যা মামলার তীব্র প্রতিবাদ জানান। ডেস্টিনি নামের এনজিওসহ সেনা-আমলাদের পাহাড়ের হাজার হাজার একর জমি ইজিরা নেয়ারও সমালোচনা করেন। ফয়জুল হাকিম ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর কঠোর সমালোচনা ও নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হলেও এরা সংবিধান সভা করেনি। জনগণের মতামত গ্রহণ করেনি। দেশে বাঙালি ভিন্ন আরও ৪৫টির অধিক জাতিসত্তা রয়েছে, তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। ৫ জানুয়ারি ভোটারহীন এক নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমানে এরা অবৈধভাবে ক্ষমতায় রয়েছে।’ ফয়জুল হাকিম তার বক্তব্যে আরও বলেন, ‘দেশের জনগণকে দুর্যোগে ফেলে ‘৭১ সালে নেতারা আত্মসমর্পণ করেছিলেন তার ময়না তদন্ত করা দরকার। দীঘিনালা বাবুছড়ায় নির্যাতন চলছে, শুধু সেখানে নয় দিনাজপুর, রাজশাহীসহ সর্বত্র সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ওপর নিপীড়ন চলছে। দেশের কৃষক শ্রমিক সাধারণ জনগণেরও এদেশে অধিকার নেই। তিনি রাণা প্লাজায় শ্রমিক হত্যাসহ বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরেন।
তিনি তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে পাহাড় সমতলে নিপীড়কদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানা।

সমাবেশে বক্তারা অভিযোগ করে বলেন, ‘নিজ নিজ জমি ফিরে পাবার দাবিতে ১৫ মার্চ দীঘিনালায় ভূমি রক্ষা কমিটির শান্তিপূর্ণ  পদযাত্রায় বিনা উস্কানিতে সেনা-পুলিশ লাঠিপেটা, হামলা এবং গুলি করে। ১ কলেজ ছাত্রীসহ ১১ জনকে অন্যায়ভাবে কারারুদ্ধ করা হয়েছে।

বক্তারা আরো বলেন, ‘দীঘিনালার বাবুছড়া এলাকায় যত্ন কুমার কার্বারী পাড়া ও শশী মোহন কার্বারী পাড়ায় বিজিবি’র ৫১ ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপনের নামে ২১ পাহাড়ি পরিবারকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়েছে। তাদেরকে এখনো নিজ বসতভিটায় পুনর্বাসন করা হয় নি। উপরন্তু বিজিবি সদস্যরা হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলোর জায়গা বেদখল করে স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করছে।’

সমাবেশে বাবুছড়ার ২১টি পাহাড়ী পরিবারকে উচ্ছেদ করে ৫১, বিজিবি‘র ব্যাটালিয়ন সদর দফতর স্থাপনের অভিযোগ এনে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলোকে নিজ নিজ ভূমিতে পুনর্বাসন, বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদর দফতর অন্যত্র স্থানান্তর, পাহাড়ীদের নামে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার এবং আটক ১ ছাত্রীসহ গ্রেফতারকৃত ১১জনের নিঃশর্ত মুক্তিসহ ৭দফা দাবি জানায় এ ৩ পাহাড়ি সংগঠনের নেতারা।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের অরক্ষিত সীমান্ত সুরক্ষায় দীঘিনালার বাবুছড়া এলাকায় বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন-বিজিবি‘র একটি ব্যাটালিয়ন স্থাপনের জন্য ১৯৯১ সালে সরকারিভাবে প্রয়োজনীয় ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। গত বছরের ২২ মে বাবুছড়া বিজিবি ব্যাটালিয়নের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আনুষ্ঠানিকভাবে বাবুছড়াতেই পালন করা হয়। এরপর থেকে বিজিবির সদর দপ্তরের ভূমি নিজেদের দাবী করে বিবিজি‘র সদর দপ্তর স্থাপনে বিরোধীতা করে আসছে স্থানীয় পাহাড়ীরা।

এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৫ মার্চ বিজিবি সদর দপ্তর অভিমুখে পদযাত্রা কর্মসূচীকে কেন্দ্র করে শান্তিচুক্তি বিরোধী ইউনাইডেট পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ সমর্থিত দীঘিনালা ভুমি রক্ষা কমিটির নেতৃত্বাধীন পাহাড়ীদের সাথে সেনাবাহিনী ও পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের হামলায় ১০ সেনা সদস্য সহ ১৫জন আহত হয়।

এর আগে ইউপিডিএফ‘র মদদে গত বছরের ১০ জুন সন্ধ্যায় কয়েকশ সংঘবদ্ধ পাহাড়ি নারী-পুরুষ দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে নির্মাণাধীন বাবুছড়া ৫১, বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন-বিজিবি‘র সদর দফতরে হামলা চালায়। এতে ছয় বিজিবি ও এক পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ২২ জন আহত হন। হামলায় বিজিবি‘র দুটি রাইফেলসহ বেশকিছু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুলিশ পাঁচ রাউন্ড শর্টগানের গুলি ও পাঁচ রাউন্ড টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

Exit mobile version