পাহাড় সেজেছে উৎসবের সাজে : পুজা ঈদ ও দানোৎসবকে ঘিরে জাতিভেদ ভুলে সবাই এক কাতারে

1375210_587159891331437_503818196_n

মুজিবুর রহমান ভুইয়া :

হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দুর্গোৎসব, মুসলমানদের পবিত্র ঈদুল আযহা ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দানোৎত্তম কঠিন চীবর দানোৎসবকে ঘিরে পাহাড় সেজেছে উৎসবের সাজে। পাহাড়ের প্রতিটি জনপদের কোণায় কোণায় বাজছে উৎসবের সূর। নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষের আবাসস্থল পার্বত্যাঞ্চলের প্রতিটি জনপদে এখন তৈরী হয়েছে মাসব্যাপী ধর্মীয় উৎসবের আবহ। ধনী-গরিব সকলের ঘরে ঘরে চলছে উৎসবের প্রস্তুতি।

চলতি বছর হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দুর্গোৎসব, মুসলমানদের পবিত্র ঈদুল আযহা ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দানোৎত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব কাছাকাছি সময়ে হওয়ার কারণে হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের মাঝে বিরাজ করছে উৎসবমুখর পরিবেশ।

মাসব্যাপী উৎসবের আনন্দে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান আর মুসলিম যেন মিলেছে এক কাতারে জাতিগত সব বিভেদ ভুলে, মানুষ হিসেবে, বাংলাদেশী হিসাবে। এমনকি পাহাড়ী-বাঙ্গালীর জাতিগত বিভেদ ভুলে সবাই দাঁড়িয়েছে এক কাতারে। পাহাড়ের এই উৎসব জাতিগত বিভেদ ভুলিয়ে দেয়। সবাই ভুলে যায় কে পাহাড়ী বা কে বাঙ্গালী। সবাই মেতে উঠে ধর্মীয় উৎসবের অনাবিল এক আনন্দ আয়োজনে। তৈরী হয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। সব মিলে ধর্মীয় উৎসবগুলো জাতিগত ভেদাভেদ‘র শেকড়কে উপড়ে ফেলে। সকলের আন্তরিকপূর্ণ উপস্থিতিতে উৎসবগুলো হয়ে উঠে প্রাণবন্ত।

আগামী ১০ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে শারদীয় দূর্গোৎসব চলবে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত। এসময় পার্বত্য তিন জেলার ২৫ টি উপজেলায় একযোগে পালিত হবে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান এ ধর্মীয় উৎসব। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবছর অধিকাংশ পূজামন্ডপেই তৈরি করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন দেবীমূর্তি। শিল্পীর মননশীল চিন্তায় দেবী সাজানো হয়েছে নান্দনিক সাজে। পাশাপাশি বর্ণিল সাজে সাজানো হয়েছে পূজামন্ডপগুলোকে। আর কেনা-কাটায়ও পিছিয়ে নেই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে দুর্গোৎসব সম্পন্ন করতে প্রতিটি মন্ডপে নেয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধমীয় উৎসব দূর্গাপূজা শেষ হতে না হতেই আগামী ১৬ অক্টোবর পালিত হবে মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদ-উল আযহা। পবিত্র ঈদ-উল আযহা পালনেও সামর্থ্য অনুযায়ী প্রস্তুতি শেষ করে এনেছে মুসলমানরা। এ উৎসবকে ঘিরে ইতিমধ্যে তিন পার্বত্য জেলায় জমে উঠেছে কোরবানীর পশুর হাট। কোরবানীর পশুর হাটকে ঘিরেই চলছে প্রাথমিক উৎসব।

এদিকে মুসলমানদের ঈদের আনন্দ কাটতে না কাটতেই শুরু হবে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের ঐতিহ্যবাহী উৎসব দানোৎত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব। কঠিন চীবর দানোৎসবকে সামনে রেখে পাহাড়ী জনপদের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে চলছে উৎসব প্রস্তুতি। এ উৎসবে তাদের নতুন জামা-কাপড় কেনাকাটার রেওয়াজ না থাকলেও এই ধর্মীয় উৎসব আয়োজন ও পালনে তাদের মাঝে উৎসাহের কোনো কমতি নেই।

১৮ আক্টোবর থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত পার্বত্য জনপদের বিভিন্ন বৌদ্ধ মন্দিরে পালন করা হবে ঐতিহ্যবাহী কঠিন চীবর দানোৎসব। এসময় পাহাড়ের আকাশে আকাশে ভেসে বেড়াবে ফানুস বাতির আলোকসজ্জা।

প্রতি বছরই কঠিন চীবর দানোৎসবকে ঘিরে বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে লাখো বৌদ্ধ ভক্তের মানুষের সমাগম ঘটে। আর তাই প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও মন্দিরগুলোকে সাজানো হচ্ছে বর্ণিল সাজে। প্রতিদিন শত শত দায়ক-দায়িকা অংশ নিচ্ছেন বৌদ্ধ মন্দিরগুলোর প্রস্তুতি কাজে। প্রতিটি বৌদ্ধ মন্দিরেই চলছে কঠিন চীবর দানোৎসব উদযাপনের প্রস্তুতি। দানোৎত্তম কঠিন চীবর দানোৎসবকে ঘিরে বৌদ্ধ ধর্মালম্বী সম্প্রদায়ের এ ধর্মীয় উৎসবগুলোতে থাকেনা কোন জাতিগত ভেদাভেদ। সকল সম্প্রদায়ের মানুষের উপস্থিতিতে এই ধর্মীয় উৎসবগুলো হয়ে উঠে প্রাণবন্ত।
 
এ বিষয়ে খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এসোসিয়েশনের সভাপতি বিশ্ব কল্যাণ চাকমা জানান, দানোৎত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব উদযাপন করতে পাহাড়ের বৌদ্ধ ধর্মালম্বী সম্প্রদায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। তিনি বলেন, কঠিণ চীবর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব হলেও এ উৎসবে পার্বত্য জনপদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজনের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি অনেক অতিথিও অংশগ্রহণ করবেন।
 
মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দুর্গোৎসব, মুসলিম সম্প্রদায়ের ঈদ-উল আযহা ও বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসবকে ঘিরে পাহাড়ের মানুষের মাঝে যে উৎসবের আবহ তৈরী হয়েছে তা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন করতে স্থানীয়ভাবে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
 
খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো: মাসুদ করিম পার্বত্যনিউজকে জানান, আসন্ন তিন তিনটি উৎসব শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এসব ধর্মীয় উৎসব চলাকালে জেলার কোথাও যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেজন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক করা হয়েছে। তিনি শান্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য তিনি সকল সম্প্রদায়ের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।

এদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দুর্গোৎসব, মুসলমানদের পবিত্র ঈদুল আযহা ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দানোৎত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব উপলক্ষে সকল সম্প্রদায়ের প্রতি শুভেচ্ছা জানিয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ও খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি ওয়াদুদ ভুইয়া। শুভেচ্ছা বার্তায় তিনি সকল সম্প্রদায়কে অভিন্ন আত্মায় উৎসব পালনের আহবান জানিয়ে বলেন, ধর্ম যার যার উৎসব সকলের। উৎসব থেকে সংঘাত, সংঘর্ষ আর জাতিগত বিভেদ ভুলে সকলকে আগামীদিনে ঐক্যবদ্ধ থেকে পাহাড়ের মানুষের কল্যাণে একাত্ম হয়ে কাজ করার আহবান জানান। এ উৎসব থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শিক্ষা নিতেও সকলের প্রতি আহবান জানান।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন