খাগড়াছড়ি পৌরসভা নির্বাচনে অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্ত নিয়ে শঙ্কা : প্রার্থীরা মানছে না আচরণবিধি
খাগড়াছড়ি পৌরসভার নির্বাচনী মাঠ সরগরম হয়ে উঠেছে। কনকনে শীত উপেক্ষা করে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত প্রার্থীরা ছুটছেন ভোটারদের বাড়ি-ঘরে। চলছে উঠোন বৈঠকসহ গণসংযোগ। শহরে চলছে মাইকিং। প্রার্থীদের পোস্টার-ব্যানারে ছেয়ে গেছে শহরের অলিগলি। প্রার্থীরা দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। মেয়র পদে বড় দুই দলের প্রার্থীর পক্ষে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে নেমেছেন।
অপর দিকে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় নির্বাচনী মাঠে বাড়তি উত্তাপ ছড়াচ্ছে।প্রচারণায় পিছিয়ে নেই কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত আসনের নারী প্রার্থীরাও। মনোনয়নপত্র দাখিলের দিন থেকে শুরু করে কোন প্রার্থীই মানছে না নির্বাচনী আচরণবিধি। গণসংযোগের নামে করছে শো-ডাউন।
আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে বলে দাবি করলেও বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নানা শঙ্কা প্রকাশ করছেন। পক্ষান্তরে রিটার্নিং অফিস অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনে জিরো টলারেন্স নীতিতে শেষ পর্যন্ত থাকবেন বলে জানিয়েছেন। সাধারণ ভোটাররাও চাইছেন নির্বাচনে সুস্থ্য পরিবেশ। তবে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কতটুকু অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত হবে, ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে এ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে। এছাড়া রয়েছে ভোটের কঠিন সমীকরণে প্রসীতের ইউপিডিএফ ও নতুন ভোটাররা।
দ্বিতীয় ধাপে আগামী ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য খাগড়াছড়ি পৌরসভায় ভোটার এবার ৩৭ হাজার ৮৭ জন। তার মধ্যে পুরুষ ভোটার ২০ হাজার ৩৫১ জন ও নারী ভোটার ১৬ হাজার ৭শ৩৬জন।
পৌর নির্বাচনে মেয়র পদে চার প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও আলোচনা-প্রচারণায় রয়েছেন, নৌকার প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্মলেন্দু চৌধুরী, ধানের শীষ প্রতীকের বিএনপির মনোনীত প্রার্থী ইব্রাহিম খলিল ও মোবাইল ফোন প্রতীক নিয়ে বর্তমান মেয়র ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মো. রফিকুল আলম। এই তিন প্রার্থী কনকনে শীত উপেক্ষা করে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত ছুটছেন ভোটারদের বাড়ি-ঘরে। চালাচ্ছেন উঠোন বৈঠকসহ গণসংযোগ। তবে প্রচারণা কিংবা আলোচনায় নেই লাঙ্গল প্রতীকধারী জাতীয় পাটির প্রার্থী ফিরোজ আহমেদ।
সমতলের সাথে পাহাড়ি এলাকা খাগড়াছড়ির সব কিছুর মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। খাগড়াছড়ি পৌরসভা নির্বাচনে জাতীয় রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি জেএসএস ও ইউপিডিএফসহ চারটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের প্রভাব রয়েছে। সে কারণে প্রার্থীদের জয়-পরাজয় নির্ভর করছে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনের উপরও। কারণ এবার পাহাড়ের অন্যতম প্রভাবশালী আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল প্রসীতের ইউপিডিএফ’র কোন প্রার্থী নেই।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্মলেন্দু চৌধুরী। তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের সকাল-থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত গণসংযোগ প্রচারণা চালাচ্ছেন। তার পক্ষে কয়েকদিন গণসংযোগ করে গেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক। এ সময় তিনি হুমকি দিয়ে গেছেন, যারা নেত্রীর সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হবেন, তারা কখনো দলের সদস্য পদ পাবেনা, আওয়ামী লীগের নৌকায় উঠতে পারবেনা।
প্রচার-প্রচারণায় পিছিয়ে নেই ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী ও জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম খলিল। বিশাল কর্মী বাহিনী নিয়ে যাচ্ছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। তার পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-কর্মসংস্থান বিষয়ক সম্পাদক ওয়াদুদ ভূঁইয়া। তিনি ভয়কে জয় করে ধানের শীষে ভোট দেওয়ার জন্য জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছেন।
বর্তমান পৌর মেয়র মো. রফিকুল আলম নৌকা প্রতীকের প্রত্যাশি থাকলেও শেষ পর্যন্ত দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে সম্মিলিত নাগরিক পরিষদের প্রার্থী হিসেবে আবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তিনি এবারও মোবাইল প্রতীক নিয়ে জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন। তবে প্রচার-প্রচারণায় নেই লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে জাতীয় পাটির প্রার্থী ফিরোজ আহমেদ।
গত পৌরসভাসহ সকল জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে প্রসীতের ইউপিডিএফ প্রার্থী দিলেও এবার নিবাচনী মাঠে তাদের কোন প্রার্থী না থাকায় ভোটের সমীকরণ নিয়ে ভোটার-প্রার্থীরা নানা হিসেব-নিকাশ কষছেন। তার সাথে রয়েছে নতুন প্রায় সাড়ে তিন হাজার ভোটার।
ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী নির্মলেন্দু চৌধুরী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে দাবি করলেও নানা শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিএনপি প্রার্থী ইব্রাহিম খলিল ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মো. রফিকুল আলম।
বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ও জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম খলিল বলেছেন, গণসংযোগ করতে গিয়ে সাধারণ ভোটারদের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। ভোটে যদি সুস্থ পরিবেশ থাকে, জনগণ যদি তার পছন্দের প্রার্থীকে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে তাহলে তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হবেন।
বিএনপি প্রার্থী ইব্রাহিম খলিল পেশীশক্তি, প্রভাবমুক্ত, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে দাবি জানিয়ে বলেন, ইভিএম-এ ভোট গ্রহণ নিয়ে সাধারণ মানুষের শংকা রয়েছে। কারণ সরকার নানা কৌশলে জনগণের বিজয় ছিনিয়ে নিচ্ছে। আমরা জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি।
খাগড়াছড়ি পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থী মো. রফিকুল আলমও ইভিএম নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন এবং সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশে জনগণ যদি ভোট দিতে পারে তার বিজয় নিশ্চিত দাবি করে ভোট গ্রহণে স্বচছতার মানদণ্ড নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
মনোনয়নপত্র দাখিলের দিন থেকে প্রায়ই সব মেয়র প্রার্থীই নির্বাচনী আচরণবিধি চরমভাবে লঙ্ঘন করে চলেছেন। গণসংযোগের নামে শক্তি প্রদর্শনের জন্য ব্যাপক শো-ডাউন করে যাচ্ছেন প্রায় সব প্রার্থীই। শহরের বিভিন্ন স্থানে ঝুলছে প্রার্থীদের বিশালাকৃতি ব্যানার। অনেক প্রার্থী গাড়িতে দুটি মাইক ঝুলাচ্ছেন। কেউ আচরণবিধি লঙ্ঘন করে অলি-গলিতে অফিস বানিয়েছেন। তবে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করতে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুতির কথা বলছেন রিটার্নিং অফিসার রাজ আহমেদ। তার দাবি নির্বাচন অবাধ-সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য যা করার দরকার সবই করা হচ্ছে। কোন অপশক্তিকে আমরা মাথা তুলে দাঁড়াতে দেবো না। আমরা নির্বাচনে জিরো টলারেন্স নীতিতে শেষ পর্যন্ত থাকব।
তিনি বলেন, খাগড়াছড়ি পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকা। এখানে ইউপিডিএফ বলি, কিংবা রাজনৈকি সন্ত্রাসী, সংস্কারপন্থী বলি এধরণের বহু গোষ্ঠী-সম্প্রদায় আছে। যারা তাদের স্বার্থ আদায়ে কাজ করার অপচেষ্টা, অপপ্রচার বা অপকর্ম করতে পারে। এ সব অপশক্তি কোনভাবেই যাতে প্রভাব বিস্তার করে নির্বাচনকে তাদের অনুকুলে নিতে না পারে তার জন্য আমার জিরো টলারেন্স নীতিতে আছি।
খাগড়াছড়ি পৌরসভায় এবার চার মেয়র প্রার্থীর বাইরেও কাউন্সিলর পদে ৪০ জন ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ১০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
খাগড়াছড়ি পৌরসভা নির্বাচনে এবার প্রসীতের ইউপিডিএফ’র প্রার্থী নেই। সে সাথে রয়েছে নতুন ৩ হাজার ৪শ ৮৬ ভোট। ফলে ভোটের সমীকরণের ফলাফল মিলাতে অপেক্ষা করতে হবে আগামী ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত।