ফটিকছড়ি-লক্ষ্মীছড়ি সীমান্তের মানুষ ইউপিডিএফ’র অত্যাচার নির্যাতনে অতিষ্ঠ

Ramgarh 18.1.16 copy

ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি, পার্বত্যনিউজ:

ইউপিডিএফ কমান্ডার অমর ও মিলন বাহিনীর চাঁদাবাজি আর অত্যাচারে অতিষ্ঠ ফটিকছড়ি-লক্ষ্মীছড়ি সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ। চাঁদা না দেয়ায় তাদের হাতে খুন হয়েছে অন্তত অর্ধডজন ব্যবসায়ী ও নিরীহ মানুষ।

ফটিকছড়ি উপজেলার বিভিন্ন শ্রেণী পেশার লক্ষ লক্ষ মানুষ অমর-মিলন চাকমা বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। তারা পার্বত্য শান্তিচুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ’র লক্ষীছড়ি-ফটিকছড়ি সীমান্তের আঞ্চলিক কমান্ডার। উপজাতীয় এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দূষ্কর্মের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে স্থানীয় বাঙ্গালী সোর্স।

আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর বড় ধরণের কোন অভিযান পরিচালিত না হওয়ায় উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের অপকর্মের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তাদের নির্যাতনের সর্বশেষ শিকার ফটিকছড়ির ব্র্যাক কর্ণফুলী চা বাগান ও বাগানের দুই ম্যানেজার। এর আগে তারা উক্ত এলাকায় অপহরনের পর হত্যা করেছে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীকে।

অনুসন্ধনে জানা যায়, লক্ষীছড়ির দুইদ্যেখোলা, বাইন্যেছোলা এলাকায় ইউপিডিএফ’র নেতৃত্ব দেয় কমান্ডার সমীর চাকমা ওরফে অমর চাকমা। বার্মাছড়ি এলাকায় ও রাঙ্গামাটির কাউখালীর এলাকায় নেতৃত্ব দেয় মিলন চাকমা।

এ দুই কমান্ডারের রয়েছে প্রায় ৫শ সদস্যের সশস্ত্র প্রশিক্ষিত বাহিনী। তৎমধ্যে শতাধিক নারী সদস্যও রয়েছে। তারা সেখানে ”পরিষদ” নামে পরিচিত।

পার্বত্য এলাকার পাশাপাশি ফটিকছড়ির সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন লেলাং, কর্ণফুলী চা বাগান, কাঞ্চনপুর, মানিকপুর, রক্তছড়ি, ট্যাকবাড়িয়া, সরকারী ঢেভা, নানুপুরের খিরাম, গামারীতলা, মধ্যছড়ি, দাঁতমারার বালুখালী,সোনারখীল,চাপাতলী,মনাইয়ার দোকান, গোইয়া পাড়া,চিত্তরামের দোকান, কালাপানি, নতুন বাজার,বড়ইতলী,বাগানবাজার, পাইন্দং, ভূজপুর, সাপমারা, নারায়ণহাট এলাকা, রাউজানের নন্দীরখীল, হলদিয়া, এয়াছিন নগর, ডাবুয়া গুলো তারা নিয়ন্ত্রণ করে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সীমান্তবর্তী এই এলাকা এক সময় পার্বত্য বিদ্রোহী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী শান্তিবাহিনীর নির্যাতন চলতো। ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তির পর জম্ম নেয় পার্বত্য শান্তিচুক্তি বিরোধী জোট ইউপিডিএফ। শান্তিচুক্তির পক্ষের জোট জেএসএস’র এক সময় এখানে অবস্থান থাকলেও, পরে তারা এলাকা থেকে বিতাড়িত হয়। সীমান্তবর্তী বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী তাদের সাথে সব সময় বন্ধুত্ব সুলভ আচরণ করলেও তারা সব সময় বাঙ্গালী বিরোধী আচরণ করেছে।

জানা গেছে, ১৯৯৮ সালে প্রবীন ব্যবসায়ী এজাহার মিয়া কোম্পানীকে অপহরণ করে ইউপিডিএফ। নানুপুরের আওয়ামীলীগ নেতা সৈয়দ ওসমান গনি বাবু (বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান) দেন দরবার করে ছাড়িয়ে আনেন প্রায় একমাস অতিক্রম হবার পর।

চাঁদা আদায়ের সুবিধার্তে বার্মাছড়ি বাজার মধ্যছড়ি থেকে স্থানান্তর করে। ঐ সময়ে ফটিকছড়ি-গহিরার প্রায় ১৫ ব্যবসায়ীকে এক যোগে অপহরণ করে। মুক্তিপন দিয়ে ৩দিন পর তাদের ছাড়া হয়। ২০০৫ সালের পর থেকে পার্বত্য এলাকায় বাঙ্গালীদের ক্রয় করা গাছ বাগান, বাঁশ বাগান, কলা বাগান, হলুদ বাগান, আধা-রসুন বাগান ছেড়ে দিতে বাধ্য করছে।
২০১৪ সালের সেনাবাহিনীর সোর্স হয়ে কাজ করার অপরাধে খিরাম এলাকায় ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয় ব্যবসায়ী ইউসুফকে। ২০১৩-১৪ সালে অন্ত:কোন্দলের দায়ে কাঞ্চন নগরের সরকারী ঢেভায় ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে দুই চাকমা জেএসএস কর্মীকে। ২০১৩ সালে দাঁতমারা এলাকায় হত্যা করা হয় অপর জেএসএস কর্মীকে।

২০১৩ সালে খিরামের বিএনপি নেতা আহমদ ছাপাকে অপহরণ করে মিলন চাকমা বাহিনী। একমাস আটক রাখার পর ৪ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ নিয়ে তাকে ছাড়া হয়। ২০১৫ সালে সর্তা বনবিটের কর্মচারী এজাহার মিয়া, হোসেন বলি ও আইয়ুব বলীকে গামরীতলা থেকে অপহরণ করা হয়। এক সপ্তাহ পরে তাদের ১৬ লক্ষ টাকা মুক্তিপনের বিনিময়ে ছাড়া হয়। ২০১৫ সালে পাইন্দং এলাকার এক প্রবাসীর শিশু সন্তানকে অপহরণ করে ৮ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ আদায় করা হয়।

২০১৪-১৫ সালের শুষ্ক মৌসুমে ধুরুং বনবিট, সর্তা বনবিট, নারায়ণহাট বনবিট, দাঁতমারা বনবিট, কর্ণফূলী চা বাগান, কাঞ্চন নগর রাবার বাগান, রাঙ্গামাটিয়া রাবার বাগানের লক্ষ লক্ষ টাকার মুল্যবান গাছ কেটে উজাড় করেছে। ২০১৫ সালে দাঁতমারার বালুখালী এলাকায় আজিজ সওদাগরের প্রায় কয়েক লক্ষ আগর গাছ কেটে ফেলে চাঁদা না দেয়ায়।

২০১৪-১৫ সালে ফটিকছড়ির রাঙ্গামাটিয়া, গোপালঘাটা, কাঞ্চনপুর, মানিকপুর, পাইন্দং, দাতমারা এলাকায় গণহারে শতাদিক বাঙ্গালীর ঘর ডাকাতি করে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা।

ইউপিডিএফ সন্ত্রসীদের আক্রমণের সর্বশেষ শিকার ফটিকছড়ির ব্র্যাক কর্ণফুলী চা বাগানের দুই ম্যানেজার শাহ নেওয়াজ ও ইলিয়াছ। ব্র্যাক কর্ণফুলী চা বাগান কর্তৃপক্ষ জানান, জাফরাবাদ, দুইধ্যাখোলা, ট্যাকবাড়িয়া, সরকারী ঢেবা, রক্তছড়ি, মানিকপুর এলাকার শত শত একর চা বাগানের ইজারাকৃত জমিতে কাজ করতে দিচ্ছেনা ইউপিডিএফ।

তারা জমিগুলো তাদের দাবী করে। কিন্তু কোন সমঝোতায় বসেনা। উল্টো চাঁদা দাবী করে। এ জন্য জাফরাবাদ এলাকায় প্রায় ৫ হাজার চা গাছ মরে যাচ্ছে।

ভূক্তভোগীরা জানায়, সীমান্তবর্তী এই সব এলাকার কৃষি জমিতে চাষ করতে, ফসল তুলতে, পাহাড়ী টিলাতে গাছ রোপ, কর্তন করতে ইউপিডিএফ’কে মোট অংকের চাঁদা দিতে হয়। নয়তো তারা শ্রমিকদের মারধর করে ধরে নিয়ে যায়। মুক্তিপন আদায় করে।

বাঁশ ব্যবসায়ী শামসুল আলম (৪২) বলেন, পাহাড়ী এলাকায় ব্যবসা করতে হলে প্রথমে ইউপিডিএফ’কে ১০-৫০ হাজার টাকা দিয়ে পাস নিতে হবে। আবার ঘাটে ঘাটে ইউনিয়ন পরিষদ, স্কুল, হিন্দু মন্দির, বৌদ্ধ বিহার, ইউপিডিএফ ও জেএসএস’র নামে চাঁদাও দিতে হয়। এভাবে ২ হাজার টাকার বাঁশের চালি ফটিকছড়ি পৌঁছাতে লাগে ৩ হাজার টাকা চাঁদা। গাছ ব্যবসায়ী সেলিম উল্লাহ (৪৫) বলেন, পাহাড়ী এলাকায় গাছ বাগান কাটতে হলে বাগান অনুপাতে দিতে হয় চাঁদা। আবার গাছ ও লাকড়ি গাড়ি প্রতি চাঁদা। এক সিজনের জন্য পাশ পারমিট নিতেও হয়। ব্যতিক্রম হলে অপহরণ করে নির্যাতন করে। মুক্তিপন নেয়।

জীপ গাড়ির মালিক রাশেদুল আলম (৩৩) বলেন, জীপ, ট্রাক, ট্রলি গাড়ি পার্বত্য এলাকায় ঢুকলেই পাস নিতে হয়। না হয় ড্রাইভার কে আটক করে বেদম পিটুনি দেয়। গাড়ি নষ্ট করে দেয়।

কাঞ্চনপুরের কৃষক শিমুল মহাজন শম্ভু (৪৭) বলেন, আমাদের বাপ দাদার জোত সম্পত্তি গুলো বিগত ২-৩ বছর যাবৎ পরিষদ নামধারী উপজাতিরা দখল করছে। আমাদের তারা কৃষিকাজ করতে দিচ্ছেনা। চাষাবাদ করলে চাঁদা দাবী করে।

এদিকে এক শ্রেনীর বাঙ্গালীরা টাকার বিনিময়ে ইউপিডিএফ’র সোর্স হিসেবে কাজ করে। তাদের কারণে বাঙ্গালীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোন উদ্যোগ নিতে পারেনা। এই সোর্স গুলো চিহ্নিত করে বিচারের ব্যবস্থা করা দরকার।
ফটিকছড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) বিদ্যুত কুমার বলেন, বাগানের দুই ম্যানেজারের উপর হামলার ঘটনায় এখনো কোন অভিযোগ পাইনি। এছাড়া চাঁদাবাজি বা খুনের ঘটনায় যারা ভূক্তভোগী তারা থানায় অভিযোগ করেন না।

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ না পেলে কাজ করা সম্ভব হয় না বলে তিনি জানান।

সেনাবাহিনীর বাইন্যাছোলা ক্যাম্পের কর্পোরাল সরোয়ার বলেন, চা বাগানের ম্যানেজারের উপর সন্ত্রাসী হামলা, উপজাতিদের ঘর পোড়ানো এলাকা গুলোতে সেনাবাহিনীর টহল টিম জোরদার করা হয়েছে। সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে।

এ ব্যাপারে ইউপিডিএফ’র প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগের প্রধান নিরন চাকমা পার্বত্যনিউজকে বলেন, ইউপিডিএফ’র বিরুদ্ধে এ ধরণের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। একটি মহল ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ইউপিডিএফ’র বিরুদ্ধে এ ধরণের অভিযোগ করে থাকে সব সময়। ইউপিডিএফ’এ কোনো কমান্ডার নেই। সমীর চাকমা, অমর চাকমা ও মিলন চাকমা নামে ইউপিডিএফ’র কোনো কমান্ডার নেই।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ইউপিডিএফ, চা বাগান, চাঁদাবাজি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন