শুরু হয়েছে আরেকটি নতুন বছর। প্রতিবারই সবার প্রত্যাশা থাকে নতুন বছরে সবুজ পাহাড়ে শান্তির বারতা ছুঁয়ে যাবে। বন্ধ হবে হানাহানি। অসা¤প্রদায়িক চেতনায় সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের স্বার্থে এক হয়ে কাজ করবে। পাহাড় থেকে শান্তির সুবাতাস ছড়িয়ে পড়বে সারাদেশে। পার্বত্যবাসীর পক্ষ থেকে এবারো এমন প্রত্যাশা রেখে বিগত বছরটিতে রাঙামাটিতে ঘটে যাওয়া কিছু আলোচিত ঘটনা তুলে ধরছি।
২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি দুপুরে রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে প্রকাশ্যে দিবালোকে সরকারি অফিসের ভেতরে রূপকারি ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার সমর বিজয় চাকমাকে (৩৮) গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। নিহত সমর বিজয় চাকমা জনসংহতি সমিতি (জেএসএস সংস্কার, জেএসএস এম এন লারমা গ্রæপ নামেও পরিচিত) দলের বাঘাইছড়ি থানা কমিটির স্কুল বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। এ ঘটনার জন্য জেএসএস (সংস্কার) দলের পক্ষ থেকে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএসকে দায়ী করে অভিযোগ করে। এ ঘটনা দিয়ে ২০২১ সালে রাঙামাটিতে রক্তপাতের ঘটনা শুরু হয়।
এরপর একই উপজেলায় ৩০ মার্চ জেএসএস (সংস্কার) গ্রুপের সামরিক কমান্ডার বিশ্ব চাকমা ওরফে যুদ্ধ চাকমাকে (৪২) তার সহকর্মী সুজন চাকমা গুলি করে হত্যা করে। দলটির সূত্রে জানা গেছে, ৩০ মার্চ রাতে উপজেলার বাবুপাড়ায় দায়িত্ব পালন করছিলেন কমান্ডার বিশ্ব চাকমা। সঙ্গে ছিলেন তার সতীর্থ সুজন চাকমা। সুজন ওইদিন রাত ৩টার দিকে কমান্ডার বিশ্ব চাকমাকে গুলি করে হত্যার পর পালিয়ে যায়। পালানোর সময় ঘটনাস্থল থেকে সে একটি এম ফোর রাইফেল ও একটি একে-৪৭ রাইফেল নিয়ে যায়। নিহত বিশ্ব চাকমা চার বছর আগে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস থেকে অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে এসে সংস্কারপন্থী জেএসএস এমএন লারমা দলে যোগদান করেছিলেন। পরে তাকে সংগঠনটির বাবুপাড়ার সামরিক কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
৮ জুলাই রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার দুর্গম রাইখালী ইউনিয়নের নারানগিরি বড়পাড়া এলাকায় জেএসএস সন্তু গ্রুপের সঙ্গে এমএনপি গ্রæপের গুলিবিনিময়কালে একজন নিহত হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ৮ জুলাই সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাপ্তাই উপজেলার দুর্গম রাইখালী ইউনিয়নের নারানগিরি বড়পাড়া ও মিতিয়াছড়ির আশপাশের এলাকায় সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে মারমা ন্যাশনালিস্ট পার্টির (এমএনপি) সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে দফায় দফায় গুলিবিনিময় হয়।
১৬ অক্টোবর রাতে কাপ্তাই উপজেলার চিৎমরম ইউনিয়নের আগাপাড়া এলাকায় নেথোয়াই মারমা (৬০) নামে আ’লীগের এক ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থীকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। পুলিশ জানায়, শনিবার (১৬ অক্টোবর) দিনগত রাতে একদল অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী চিৎমরম ইউনিয়ন আ’লীগের সভাপতি ও একই ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী নেথোয়াই মারমার বাড়িতে ঢুকে গুলি করে তাকে হত্যা করে।
২৬ অক্টোবর রাতে রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার কাপ্তাই ইউনিয়নের নতুন বাজার এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে সজিবুর রহমান (৪৫) নামে কাপ্তাই ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের এক সদস্য নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হন আরও ২০ জনের মতো। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার (২৬ অক্টোবর) দিনগত মধ্যরাতে কাপ্তাই ইউনিয়নের নতুন বাজার এলাকায় কাপ্তাই ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী প্রকৌশলী আব্দুল লতিফের সঙ্গে একই ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন বঞ্চিত মহিউদ্দীন পাটোয়ারী বাদলের সমর্থকরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার সজিবুর রহমান ঘটনাস্থলে মারা যান।
৩০ নভেম্বর ভোরে রাঙামাটি সদর উপজেলার বন্ধুকভাঙ্গা ইউনিয়নের কিচিং আদম এলাকায় ঘরে ঢুকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (সন্তু) গ্রুপের সশস্ত্র এরিয়া কমান্ডার আবিষ্কার চাকমাকে (৪০) গুলি করে হত্যা করে তাদের প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসীরা। নিহত আবিষ্কার চাকমা বাঘাইছড়ি উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের সিজক এলাকার মিন্টু চাকমার ছেলে। নিহতের বাবা মিন্টু চাকমা বলেন, ‘মঙ্গলবার (৩০ নভেম্বর) ভোরে আমার ছেলে নিজের ঘরে সাংগঠনিক কাজ করছিল। এসময় হঠাৎ প্রতিপক্ষের লোকজন ঘরে ঢুকে আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে।’ নিহত ব্যক্তি সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পিসিজেএসএসের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা এবং একাধিক মামলার আসামি বলে নিরাপত্তা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে। সূত্রটি বলছে, আবিষ্কার চাকমা বিগত কয়েক বছর ধরে বাঘাইছড়ি এলাকার এরিয়া কমান্ডারের দয়িত্ব পালন করেছিলেন। স¤প্রতি তিনি লংগদু, নানিয়ারচর এবং বরকল উপজেলার সুবলংয়ের ইউনিয়নের এরিয়া কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি রাঙামাটি সদরের বন্ধুকভাঙ্গা ইউনিয়নের কিচিং আদম এলাকায় বসবাস করতেন।
বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিলো- পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি সাবেক গেরিলা নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা (৭৭) এ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণ করেননি। অংশ নেননি বাংলাদেশের কোনো জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে। তবে এবার তিনি করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রতিরোধক টিকা নিতে জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণ করেন। কেননা, জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া ভ্যাকসিন নিতে পারছিলেন না তিনি। যে কারণে বিদেশ ভ্রমণসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে আটকে যাচ্ছিলেন তিনি। নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২৯ আগস্ট রাঙামাটি জেলা নির্বাচন অফিসে গিয়ে অত্যন্ত গোপনীয়তায় নিজেকে ভোটার তালিকায় অন্তুর্ভুক্ত করতে ছবি তোলাসহ আনুসাঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সন্তু লারমা চেয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের তার বাসায় নিয়ে গিয়ে ভোটার কার্যক্রম শেষ করতে। কিন্তু জেলা নির্বাচন কমিশন অফিস থেকে তাকে জানানো হয়, টেকনিক্যালি সেটা সম্ভব নয়। এরপর তিনি নির্বাচন কমিশন অফিসে এসে অত্যন্ত গোপনে ভোটার হওয়ার জন্য আবেদন করেন।