parbattanews

বঙ্গবন্ধুকে দু’বার দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার

’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের পরে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে চাঁদপুরে মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। বয়সে বড় মামাত ভাই দেলোয়ার হোসেনের সাথে একদিন চাঁদপুর থেকে লঞ্চ যোগে ঢাকায় যাই শহর দেখার জন্য। দেশের তখনকার রাজনৈতিক উত্তাল পরিবেশ নিয়ে আমাদের তেমন কোনো মাথাব্যথাই ছিল না। ঢাকা এসে শুনলাম, সেদিনই বঙ্গবন্ধুর সমাবেশ আছে। কৌতূহলবশতঃ আমি ও আমার মামাত ভাই দেলোয়ার হোসেন জনস্রোত অনুসরণ করে সোহরাওয়ার্দীর উদ্যানে গেলাম। দেখি সেখানে প্রচুর লোকের সমাগম। মানুষ আর মানুষ। আমরা পিছন থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনলাম। ওদিন রাতেই আমরা দুই ভাই চাঁদপুর ফিরে যাই। মূলতঃ সেদিনের সমাবেশ ও বঙ্গবন্ধুর ভাষণই ছিল ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। যার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা হয়। সেদিনই দূর থেকে প্রথম বঙ্গবন্ধুকে আমার দেখার সুযোগ হয়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম গঠিত বাঘাইছড়ি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন তপন কান্তি দে। আর আমি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। এর পরের কমিটিতে আমাকে সভাপতি এবং দীলিপ কুমার দাশকে (বর্তমানে আওয়ামীলীগ নেতা) সাধারণ সম্পাদক করা হয়। উক্ত কমিটিতে বেলায়েত হোসেন, জাফর আলী খান (বর্তমান মেয়র), আবুল কাশেম, দেলোয়ার হোসেন, রওশন আরা (দারোগার মেয়ে), জলদেবী চাকমাসহ অনেকেই ছিলেন। পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের কমিটিতে আমাকে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। এছাড়াও থানা ও জেলা আওয়ামী লীগের সাথেও বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছি। ১৯৭৫ সালে আমি কাচালং পাইলট হাই স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম। যেহেতু আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের নির্দেশে বিভিন্ন কাজে কর্মে আমাদের রাখা হতো। সেই হিসেবে জেলা ত্রাণ কমিটিতেও দায়িত্ব পালন করতাম। দায়িত্বের খাতিরে মাঝেমাঝে রাঙামাটি আসতে হতো। রাঙামাটির রিজার্ভ বাজারে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আবছার চৌধুরী (বর্তমানে সমাজকর্মী) ভাইয়ের বাসায় থাকতাম। তিনি একজন কর্মী অন্তঃপ্রাণ নেতা ছিলেন। মাঝে মাঝে হোটেলেও থাকতাম।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়া আসার সংবাদে আমিও রাঙামাটি আসি। বঙ্গবন্ধুর সম্মানে বেতবুনিয়া  ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের প্রবেশ পথে গেইট করার দায়িত্ব পড়ে ছাত্রলীগের উপর। আমরা কয়েকজনে গেইট করার দায়িত্ব পালন করি। ছাত্রলীগের জেলা কমিটির সর্বেসর্বা ছিলেন নুরুল আবছার ভাই। তাঁর নেতৃত্বেই আমরা কাজ করতাম। গেইট করার কাজ সেরেই সেদিন আগেভাগেই সভাস্থলে উপস্থিত ছিলাম। মূল স্টেজের পাশে আমি, রণ বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, নুরুল আবছারসহ বেশ কয়েকজন ছিলাম। স্টেজে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা ছিলেন। গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ সামনের সারিতে বসেছিলেন। আমরা কাছ থেকে মনোযোগ দিয়ে সেই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনলাম। বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার জন্য শত শত মানুষের ভীড় পড়ে যায়। সেদিনই আমার আরেকবার সরাসরি বঙ্গবন্ধুকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল।

প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি বিষয় না বললেই নয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে বিজয়ের পূর্ব মূহুর্তে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী বাঘাইছড়ি সদরে আসে ১৪ ডিসেম্বর সকালে। সেদিন তারা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে কাচালং বাজারে সভা করেন। সভা শেষে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ যৌথ বাহিনীর সদস্যদেরকে খাগড়াছড়ি পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে এবং পুরান মারিশ্যার আলামীন সওদাগর (বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা) ও ইনতাজ আলীকে দায়িত্ব দেয়।

আমরা ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় যৌথ বাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে খাগড়াছড়ির উদেশ্যে যাত্রা করলে কিছু দূর যাওয়ার পরে কাচালং বাজারের পশ্চিম দিকে পাগুইজ্জাছড়িতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী মিজোবাহিনীর অ্যাম্বুুশের শিকার হই। বেশ কিছুক্ষণ যুদ্ধ শেষে মিজোবাহিনী দক্ষিণ দিকে রাঙ্গামাটির দিকে সরে গেলে আমরা আবার হাজাছড়া দিয়ে (বর্তমানে যেখান দিয়ে বাঘাইছড়ি-মেরুং রাস্তা হচ্ছে) খাগড়াছড়ির দিকে রওনা হই। রাত শেষে ফজরের নামাজের আগে আমরা ১৫ ডিসেম্বর খাগড়াছড়িতে পৌঁছি। বিভিন্ন মসজিদের মুসল্লিরা নামাজ শেষে জেলা শহরে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর উপস্থিতি লক্ষ করে জয়োল্লাসে মেতে উঠে এবং বিভিন্ন বয়সের সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আনন্দ উল্লাস করতে থাকে। খাগড়াছড়িতে ২ দিন অবস্থান করে আমরা আবার বাঘাইছড়িতে ফিরে আসি।

আবু সৈয়দ মোহাম্মদ হাশিম: রাঙামাটির পার্বত্য জেলার বাঘাইছড়ির উপজেলার, কলেজ পাড়ার বাসিন্দা। কাপ্তাই লেক প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তার পরিবার। তিনি বাঘাইছড়ি থানা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, এছাড়াও বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম-সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরবর্তীকালে তিনি যথাক্রমে রাঙ্গুনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। কর্মজীবনে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব হিসাবে অবসরে গমন করেন। তার পূর্বে তিনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দায়িত্ব পালন করেন। তিনি যথাক্রমে জয়পুরহাট ও সিলেট জেলার জেলা প্রশাসক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

Exit mobile version