parbattanews

বলিপাড়ায় দুপুর ৩ টায় সন্ধ্যা হয় এবং সকাল ১১ টায় সকাল হয়

(১৯)
ফারুয়াতে বসে প্ল্যান করলাম পায়ে হঁটে রাজস্থলি যাবো। রাজস্থলি ফারুয়ার সোজা পশ্চিমে দু’দিনের পথ। আমি আমার পূর্বের লেখায় উল্লেখ করেছি যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় উত্তর দক্ষিণে প্রলম্বিত। তাই একবার পাহাড়ের রিজ লাইনে উঠতে পারলে উওর দক্ষিণে চলাচল সহজ।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে পূর্ব পশ্চিমে গমন কঠিন শুধু নয় বিপদ সংঙ্কুলও বটে। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে চলার সময় সেনাবাহিনীকে পাহাড়ের পাদদেশ, ছড়া এবং ডিফাইল এড়িয়ে চলতে হয় কৌশলগত কারণে। এই সব স্থানসমুহে অপারেশন পেট্রোল সহজে আক্রান্ত হতে পারে শান্তিবাহিনীর দ্বারা । অতীতে এমন ঘটনা ঘটেছিল বলে এই সব স্থানে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে যখন পূর্ব হতে পশ্চিমে কিংবা পশ্চিম থেকে পূর্বে যেতে হয় তখন নীচ থেকে পাহাড়ের উপরে উঠে আবার নীচে পাহাড়ের পাদদেশে নামতে হয়। এই নামাটা যথেষ্ট বিপজ্জনক। কারণ পাহাড়ের ঢালে নামার সময় অনেক সৈনিক পা ফসকে স্লাইডিং করে কিংবা পাহাড়ের খাদে পড়ে হাত পা ভেঙ্গে ক্যাটাগরি ডাউন হয়েছে। ক্যাটাগরি ডাউন হলে একজন সৈনিক যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত থাকে না। ঐ সৈনিককে একটা সময় অতিক্রান্তের পরে তার শারিরীক পরীক্ষা নিয়ে নতুন করে ঐ সৈনিকের ক্যাটাগরি আপ করা হয়।

এই সময়টাতে ঐ ক্যাটাগরি ডাউন সৈনিকের মোরালও ডাউন হয়ে যায়। একবার পাহাড় থেকে নীচে নামার পরে ছড়া এবং ডিফাইল অতিক্রম না করে অন্য পাহাড়ে ওঠা সম্ভব হয় না। তাই এই সময়ে অপারেশন পেট্রোলকে খুব সাবধানে পথ চলতে হয়। কিভাবে কোন ফর্মেশনে পাহাড়ে পথ চলতে হয় তার কৌশল এখানে আলোচনা করা সমীচীন নয় তাই আলোচনা থেকে বিরত রইলাম।

তো এই কঠিন পথ অতিক্রম করে আমার নিজের নেতৃত্বে একটি এ টাইপ পেট্রোল নিয়ে ফারুয়া থেকে রাজস্থলি যাত্রার দিনক্ষণ ঠিক করলাম। এই যাত্রা শীতের প্রারম্ভে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। যথা সময়ে এডজ্যুটেন্ট লেফট্যানেন্ট রেজানূর রহমানসহ প্রথমে দক্ষিণ মুখি যাত্রা শুরু করলাম। অনেক দুর যাবার পরে যাত্রামুখ পরিবর্তন করে পশ্চিমমুখী হলাম সন্ধার পরে যাতে শান্তি বাহিনীর পক্ষে আমাদের যাত্রা পথের সন্ধান পাওয়া যেন সম্ভব না হয়। রাতে হঠাৎ সৈনিকদের মধ্যে হতচকিত ভাব লক্ষ্য করে এর কারণ জানতে এডজ্যুটেন্ট কে বলাম। এ

ডজ্যুটেন্ট আমাকে জানালো যে, একটি হাতির পাল আমাদের সামনে কোনো স্থানে আছে এবং আমরা যে পথ ধরে যাচ্ছি সেই পথ দিয়েই হাতির পালটি সামনে গেছে । জঙ্গল ভেঙ্গে হাতির পালের সামনে এগুনোর পথে দেখলাম দুদিকে গাছের ডালপালা ভেঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে। আমি আদেশ দিলাম সামনে অগ্রসর না হবার। রাতে পাহাড়ের উপরে থাকার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিলাম। রাতে পাহাড়ের রোমান্টিক অবস্থা রাতে পাহাড়ে না থাকলে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। রাত বারোটার পরে গাছের পাতা বেয়ে টপ টপ করে শিশির পড়তে আরম্ভ করে । আবহাওয়া শীতল হয়ে আসে। সকালে মনে হবে মাঘ মাসের শীত যেন পড়েছে পাহাড়ে।

পরদিন সকালে হাতির চলার পথ ভালো করে দেখলাম। শুরু হল পথ চলা । মধ্য পথে এসে পাহাড়ের ঢালে একটি গুহা নজরে এলো। গুহার সামনে ঝরণার পানি একটি পুকুরের মতো গর্তে প্রায় ত্রিশ গজের মতো নীচে স্বজোরে আছড়ে পড়ছে। যায়গাটা এমন যে এটাকে বাইপাস করে সামনে যাওয়া সম্ভব নয়। আমি লক্ষ্য করলাম গুহার ভেতরের পাথর মনে হলো স্বেত পাথরের মতো। প্রথমে একজন সৈনিক তার রাইফেল উপরে তুলে ঝরণা পুকুরে লাফ দিলো। পরে সবাই একে একে পুকুরে লাফ দিয়ে পার হলো। শেষে আমিও একই ভাবে ঝরণা পুকুর পার হলাম।

এই স্থানটি ফারুয়া এবং রাজস্থলির মাঝামাঝি বলে মনে হয়। এই স্থানটি একটি দর্শনীয় স্থান হতে পারে। সারাদিন হেঁটে বেলা তিনটার দিকে বলিপাড়া এসে আমি যা দেখলাম তা জীবনে এই প্রথম। বাংলাদেশে এমন স্হানও আছে যেখানে বেলা তিনটার সময় সন্ধ্যা হয় এবং বেলা এগারোটায় সকাল হয়! আমরা বলি পাড়ার পাহাড়ের কিনারে এসে নীচে তাকিয়ে দেখছি পাহাড়ের নীচে একটি পাথুরে ঝরণা বয়ে যাচ্ছে সাথে একটা গ্রাম। গ্রামে সন্ধ্যা নামে নামে । মানুষের চলাচল দেখলাম সীমিত তারা পাহাড় বেয়ে নীচে গ্রামে ফিরে আসছে। এবং ঘরে ঘরে আলো তখনও জ্বলেনি । পাহাড় এতো উঁচু যে আমরা বলিপাড়াতে যাবার পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

একজনকে দেখলাম পাহাড়ের পথ বেয়ে নীচে নামছে। আমরা সেই পথ ধরে পাহাড় বেয়ে নীচে নামলাম। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এই চার ঘন্টার আলোর গ্রামে রাতে থাকবো। বহু কষ্টে একে একে নীচে নেমে আসলাম। এটা টিপরা সম্প্রদায়ের গ্রাম। আমি ঝরণার পাশে বসে দুপুরের খাবার খেলাম। এই গ্রাম থেকে আকাশের দিকে তাকালে দিনের আলো দেখা যায়। কিন্তু গ্রামে সন্ধ্যার সমারোহ এ এক অভূতপূর্ব এবং অভিনব আলোছায়ার খেলা। আমার মনে হয় না পার্বত্য চট্টগ্রামে এই ধরনের কোনো গ্রাম আছে। এই বলিপাড় গ্রামটি রাজস্থলির কয়েক কিলোমিটার পূর্বে। এই গ্রামটিও একটি পর্যটকের জন্য আকর্ষণীয় ও মোহনীয় স্থান হতে পারে।

বান্দারবানে বলিপাড়া নামে আর একটি গ্রাম আছে সেই গ্রাম আর রাজস্হলির বলিপাড়া এক গ্রাম নয়। অনেকেই এই ভূলটা করে থাকেন। পরদিন আমরা বলিপাড়া থেকে রাজস্থলি আসি। এর পরে আসি কাপ্তাই ব্যাটালিয়ান রিয়ার হেডকোয়ার্টারে। আমাদের যাত্রার এখানেই পরিসমাপ্তি হয়। সামনে আসছে নতুন অধ্যায়।

♦ জেনারেল – প্রাক্তন মহাপরিচালক, বিডিআর।

Exit mobile version