বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে নেটওয়ার্ক ব্যবসা করছে মিয়ানমার

fec-image

বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের দ্বারা সংগঠিত অপরাধ দমনে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ এলাকায় বাংলাদেশী মোবাইল কোম্পানির থ্রি-জি ফোর-জি বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। ফলে উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি ক্যাম্পে রোহিঙ্গা কর্তৃক ব্যবহৃত বাংলাদেশী সিম গুলো প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। আর রোহিঙ্গাদের কারণে একই ভোগান্তিতে পড়েছেন স্থানীয়রা।

কিন্তু রোহিঙ্গারা থেমে নেই, তারা বিকল্প উপায়ে মোবাইল ব্যবহার অব্যাহত রেখেছে। সীমান্ত এলাকা হওয়ায় সহজে মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক মিলছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে। একারণে মিয়ানমারের মোবাইল অপরাটের ‘এমপিটি’ সিমের প্রতি ঝুঁকছে রোহিঙ্গারা। দেশীয় মোবাইলের নেট বিড়ম্বনায় স্থানীয়রাও এসব সিম কিনে ব্যবহার করছে বলে তথ্য আসছে। চাহিদা বেড়েছে জানতে পেরে মিয়ানমারও নড়েচড়ে বসেছে। সীমান্তের টাওয়ার গুলোতে ফ্রিকোয়েন্সি বাড়িয়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে দেদারসে নিজেদের নেটওয়ার্ক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার। ব্যবহারকারীদের মতে, ওই কোম্পানির নেটওয়ার্ক পুরো ক্যাম্প গুলোতে বিস্তৃত।

অসমর্থিত সূত্রমতে, মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীদের সহযোগিতায় চোরাইপথে ‘এমপিটি’ সিম এনে ক্যাম্প গুলোতে বিক্রি করছে কিছু রোহিঙ্গা। ক্যাম্পে তারা মিয়ানমারের শৃঙ্খলা বাহিনীর ‘চর’ হিসেবে কাজ করে বলে অভিযোগ অনেকের। রেজিস্ট্রিশন ঝামেলাহীন এসব সিম হাত বাড়ালে পাওয়া যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশী আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য কিংবা অপরিচিত কারো কাছে এসব সিম বিক্রি করেন না চোরাকারবারিরা। সম্প্রতি টেকনাফ ও উখিয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে ‘এমপিটি’ সীমের কয়েকটি চালানসহ বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা ধরা পড়ে। টেকনাফ স্থল বন্দর ও ক্যাম্প এলাকা হতে তাদের আটক করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আটককৃতরা তখন জানিয়েছিল রাখাইনে এমপিটি সীমের দাম খুব সস্তা আর সীমান্তবর্তী ক্যাম্পে এর নেটওয়ার্ক ক্লিয়ার থাকায় এ কোম্পানির সীমের চাহিদা বাড়ছে। এজন্য চোরাইপথে এসব সিম আনা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, গত ২ সেপ্টেম্বরে অপারেটরদের সঙ্গে এক বৈঠকের পর বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন ‘বিটিআরসি’ বিকাল ৫টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকা গুলোতে থ্রিজি ও ফোরজি সেবা বন্ধ করে দেয়। একইভাবে দিনের বেলায়ও সারাদিন মোবাইল নেটওয়ার্ক অত্যান্ত দুর্বল অবস্থায় রাখা হয়। ফলে, স্থানীয় বাংলাদেশী গ্রাহকরা বেকায়দায় পড়লেও মিয়ানমারের মোবাইল অপারেটরের সিম ব্যবহারে রোহিঙ্গারা পূর্বের মত ফুরফুরে রয়েছে। এ সীমের সাহায্যে বিশ্বের সাথে যোগাযোগ রক্ষার পাশাপাশি অপরাধ কর্মকাণ্ডও অব্যহত রেখেছে রোহিঙ্গারা। এতে ক্ষোভ বাড়ছে স্থানীয়দের।

উখিয়ার কুতুপালং মধুরছরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এরশাদ উল্লাহ জানান, ওপারে যাতায়াত রয়েছে এমন রোহিঙ্গারা এমপিটি সিম নিয়ে আসছে ক্যাম্পে। শুনেছি বিজিপি এসব সিম আনতে সহযোগিতা দেয়। কুতুপালং, লম্বাশিয়া, এক্সটেনশনসহ পাহাড়ের ভেতরকার ক্যাম্পে এমপিটি মোবাইলের নেটওয়ার্ক দুর্বল হলেও বালুখালী ক্যাম্প থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সীমান্ত এলাকায় পূর্ণ স্পীডে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। ফলে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট ব্যবহারে কোন সমস্যা হচ্ছে না রোহিঙ্গাদের। বালুখালী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা ইউনুস মাঝি বলেন, হাত বাড়ালেই ক্যাম্পে ১০০টাকার মধ্যে এমপিটি সিম পাওয়া যাচ্ছে। ব্যবহারকারীদের বলতে শুনেছি বাংলাদেশী মোবাইল কোম্পানির সিম থেকেও সুবিধা রয়েছে এ সিমে। এটি চালু করলেই কয়েক জিবি এমবি ও মিনিট বোনাস আসে। ফ্রিকোয়েন্সি ভাল মেলায় মিয়ানমারের সীমের প্রতি ঝুঁকছে রোহিঙ্গারা।

উখিয়ার টিএন্ডটি টাওয়ার সংলগ্ন ৭নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মোহাম্মদ ইদ্রিস মাঝি বলেন, খবর পেয়েছি, বাংলাদেশের মোবাইল কোম্পানিগুলো সীমান্ত এলাকায় থ্রিজি ও ফোরজি বন্ধ করে দেয়ার খবরে রাখাইনে মোবাইল অপারেটর কোম্পানি তাদের নেটওয়ার্কের ফ্রিকোয়েন্সি বাড়িয়েছে । ফলে, উখিয়া-টেকনাফের অধিকাংশ এলাকায় এমপিটি সীমের নেটওয়ার্ক মিলছে আর যেখানে দূর্বল সেখানে বাড়াতে কাজ করছে এ কম্পানি। এতে অনেক রোহিঙ্গা এমপিটি সিম ব্যবহার করছে। টেকনাফ জাদিমোরা শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের রফিক উল্লাহ বলেন, কয়েকটি চালান ধরাপড়ার পর পুলিশের ভয়ে সপ্তাহ খানেক বন্ধ থাকলেও কিছু কিছু রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে এসব সিম সংগ্রহ করে ক্যাম্পে এনে বিক্রি করছে। প্রায় প্রতিদিন সীমান্ত দিয়ে এমপিটি সিম ঢুকছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।

কুতুপালংয়ের আ’লীগ নেতা ও সাংবাদিক নুরুল হক খান বলেন, উখিয়া স্টেশনে বাংলাদেশী মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া গেলেও কুতুপালং বাজারে কোন ধরণের নেটওয়ার্ক নেই। এ কারণে, স্থানীয়রা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যবসায়ী ও নেটওয়ার্ক নির্ভর মানুষেরা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। অথচ রোহিঙ্গারা ঠিকই মোবাইল ব্যবহার করছে। মিয়ানমারের এমপিটি সিম দিয়ে রাত-দিন ইন্টারনেট চালিয়ে যাচ্ছে।

উখিয়া কলেজের প্রভাষক তহিদুল আলম তহিদ বলেন, শুধু রোহিঙ্গারা নয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত বিভিন্ন এনজিও কর্মীও এমপিটি সিম ব্যবহার করছে। উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ও এনজিও কর্মীরা মিলে কয়েক লাখ লোক এমপিটি সিম ব্যবহার করছে। চাহিদার সুযোগে মিয়ানমারের উক্ত কোম্পানি কৌশলে উখিয়া-টেকনাফে অবস্থানরত বাংলাদেশী মোবাইল কোম্পানি গুলো টাওয়ার ব্যবহার করারও অভিযোগ রয়েছে। ক্যাম্পের অলিগলিতে পাওয়া যাচ্ছে এমপিটি সীম। প্রতিদিন সীমান্ত পার হয়ে প্রবেশ করছে উক্ত সীম গুলো। আইন শৃংখলাবাহিনীর হাতে দুয়েকটি চালান আটক হলেও বেশীরভাগ সীম এখন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রবেশ করছে।

উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আবুল মনসুর তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, মিয়ানমারের ২৩০টি এমপিটি সীমসহ মোহাম্মদ করিম নামের এক রোহিঙ্গা যুবককে আটক করা হয়েছে। একইভাবে টেকনাফ থানা পুলিশও ২২২টি এমপিটি সিমসহ তিন রোহিঙ্গাকে আটক করে। আটকদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী যতটুকু জেনেছি, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উক্ত মোবাইল কোম্পানির নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে। এজন্য চোরাইপথে রোহিঙ্গারা সিম নিয়ে আসছে বাংলাদেশে। কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করায় বেশি লাভের আশায় তারা এই কাজে আগ্রহী হয়ে উঠছে। অবশ্য, এ বিষয়ে পুলিশ সতর্ক এবং এমপিটি সিম ব্যবহার রোধে কাজ করছে।

উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এমপিটি সিম ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই এবং এটি সম্পূর্ণ অবৈধ। এই ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত আমরা তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি। মিয়ানমারের মোবাইলের নেটওয়ার্ক সীমান্তে পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু সেই নেটওয়ার্কের সিম এপারে ব্যবহার হওয়া আমাদের জন্য চরম ঝুঁকির। বিষয়টি জানার পর উর্ধ্বতন মহলের মাধ্যমে বিটিআরসিকে জানানো হয়েছে। তাদের নেটওয়ার্ক জ্যাম করে দেয়ার ব্যবস্থা নিতেও অনুরোধ করা হয়। কূটনৈতিক ভাবেও এটি বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানানো হয়েছে। পাশাপাশি চেষ্টা রয়েছে স্থানীয় ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরতদের যোগাযোগ সহজ করতে উখিয়া-টেকনাফে মোবাইল নেটওয়ার্ক শিথিল করার। সম্প্রতি ‘বিটিআরসি’র একটি প্রতিনিধিদল রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও সীমান্ত এলাকা ঘুরে গেছেন। শীঘ্রই হয়তো একটি সিদ্ধান্ত আসবে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: এমপিটি’ সিম, নেটওয়ার্ক ব্যবসা, মিয়ানমার
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন