বাংলাদেশের মুরুং উপজাতির সামাজিক জীবনাচার

Caption-05

মমতাজ উদ্দিন আহমদ

‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একমাত্র মুরুংরাই এখনো একান্নভূক্ত পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষা করে চলেছে। বাইরের জনগোষ্ঠী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে জীবন যাপন করতে এরা অভ্যস্ত’।[1]  মুরুং সম্প্রদায়ের সমাজ ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক। গোত্রভিত্তিক মুরুংরা সমাজজীবনে পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা ও সম্প্রীতিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ব্রিটিশ সরকার প্রণীত ১৯০০ সালের পাবর্ত্য চট্টগ্রাম বিধি মতে, এলাকাভিত্তিক হেডম্যান, কার্বারী পদ সৃষ্টি হওয়ায় এখন কার্বারীর অধীনে পাড়া বা গ্রামগুলোর সামাজিক কাঠামো চলে আসছে।

মুরুংদের ঘর- ‘কিম্’

পাহাড়ের ঢালে বা চূড়ায় ছোট ছোট মাচাংঘর তৈরী করে বসবাস করে চলেছে মুরুংরা। তাদের ভাষায় ঘরকে ‘কিম’বলা হয়। একই পাহাড়ে বা স্থানে মুরুং জনগোষ্ঠীরা বেশিদিন থাকে না বা বসবাস করে না। তাদের বিশ্বাস একই স্থানে অনেকদিন বসবাস করলে তাদের অমঙ্গল হয়। তাই কয়েক বছর পর পর এরা স্থান পরিবর্তন করে। মুরুংরা গরুর শিং, হনুমানের মাথা, পাখির পালক প্রভৃতি বাড়িতে ঝুলিয়ে রাখে। এসব তারা শক্তি ও মঙ্গলের উৎস মনে করে। ‘সৃষ্টির আদি লগ্নে তাদের  আদি পিতামাতা পাহাড় শীর্ষে বসতি করতো; এই বিশ্বাসে তাদের এখনো পাহাড় চুড়ায় চুড়ায় বসতি স্থাপন করতে দেখা যায়।[2]  সাধারণত: মুরুং পাড়াগুলোতে ৮/১০টি থেকে ২০/২৫টি পর্যন্ত ঘর বা ‘কিম’ থাকে।

মুরুংদের তৈরী করা মাচাংঘরগুলো দেখতে পরিপাটি ও সুন্দর। দূর থেকে দেখে মনে হয় পাহাড়ের কোলে নির্মাণ করা হয়েছে কটেজ বা পর্যটন ছাউনি। মুরুংদের গৃহনির্মাণ শৈলী বেশ নান্দনিক। ঘর নির্মাণে তাদের মনোদৈহিক শিল্পস্বত্তাকে ফুটিয়ে তোলে। প্রকৃতির কোল বেড়ে ওঠা মুরুংরা প্রকৃতি থেকেই আহরণ করা গাঁছ, বাঁশ, শন, লতা, পাতাকে তাদের গৃহ নির্মাণের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেন।

বাড়িগুলো মাটি থেকে ৯ থেকে ১২ ফুট পর্যন্ত উঁচু খুঁটি দিয়ে তৈরী করা হয়। হিংস্র জীব-জন্তুদের কবল থেকে রক্ষার্থে এ ধরণের মাচাংঘর নিরাপদ মনে করা হয়। মাচাং ঘরের নিচে লাকড়ি রাখা ও শুকরের ঘর তৈরী করা হয়। মাচাং ঘরটিকে নিচে অসংখ্য বাঁশ ও গাছের খুঁটি দিয়ে শক্ত-মজবুত করে তোলা হয়। ঘরে উঠার জন্য মোটা একটি গাছকে ধাপে ধাপে কেটে সিঁড়ি দেয়া হয়।

মুরুংদের ঘরের সাইজ মোটামুটি বড় সাইজের হয়ে থাকে। তারা ঘর নির্মাণের জন্য একটির সাথে অন্য একটির নৈকট্য বজায় রাখে। এটি সামাজিক প্রীতিবন্ধনের অংশ মনে করা হয়। তাদের নির্মিত ঘরে পানি রাখার স্থান (তুই ক্রাক), স্বামী-স্ত্রীর ঘুমানোর স্থান (কিম্সা), নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল রাখার স্থান (চাফাম্গুলা), অতিথি কক্ষ, ছেলেদের ঘুমাবার ঘর (কিমতক্), যুবতীদের ঘুমাবার ঘর (তাগ্লা) সহ প্রভৃতি অংশ থাকে।

Caption--1

মুরুং পোষাক-পরিচ্ছদ

মুরুং নারীরা ‘ওয়াংক্লাই’ নামে এক ধরনের কাপড় পরিধেয় হিসেবে ব্যবহার করে। যা নাভীর নীচ থেকে হাঁটুর উপরিভাগ পর্যন্ত আবৃত থাকে। এটি ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত চওড়া হয়। জুমে উৎপন্ন কার্পাস তুলার সুতা দিয়ে নিজেদের কোমর তাঁতে বুনা হয় এই ‘ওয়াংক্লাই’। মেয়েরা তাদের গোপনাঙ্গ ঢাকতে শুধুমাত্র এই একটি কাপড় ব্যবহার করে থাকে। এটি বামপাশে খোলা থাকে। এই বস্ত্রখণ্ডটি কোমরে পরিধান করে রূপা কিংবা অন্য ধাতু দ্বারা তৈরী কোমর বন্ধনী (বিছা) বা পুঁতির বন্ধনী বেঁধে রাখে। ছোট মেয়ে শিশু থেকে শুরু করে কিশোরী, যুবতী, গৃহবধু ও বয়স্কা নারীদের এই ‘ওয়াংক্লাই’ই প্রিয় পোষাক। মেয়েরা অধিকন্তু সময় তাদের স্তন ঢেকে রাখেনা। কোমর থেকে উর্ধ্বাংশ তাদের অনাবৃত থাকে। বাজারে কিংবা লোকালয়ে গেলে মেয়েরা ‘ওয়ানচা’ নামের একটি কাপড় চাদর হিসেবে ব্যবহার করে। এটি গায়ে জড়িয়ে কাঁধের ওপর গিট্টা দেয়া হয়। তারা মাথার পেছনে বামপাশে চুল বাঁধে।

Caption--2

মুরুং পুরুষরা ‘ডং’ নামে ছোট লম্বাকৃতি বস্ত্র পরিধান করে (এটিকে লেংটি, বিদ্রিও বলা হয়)। এক টুকরা কাপড় দুই উরুর মাঝখান দিয়ে কোমরে জড়িয়ে দেয়।  পুরুষরা বাজার কিংবা লোকালয়ে যাবার সময় লুঙ্গি পড়ে নেয়। পুরুষরা লম্বা চুল রাখে এবং কপালের ওপর পেঁচিয়ে রাখে। তবে এখন অনেককে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উপযোগী বস্ত্র পরিধান করতেও দেখা যায়। তাছাড়া মাথায় সাদা কাপড়ের একটি পাগড়ি তারা পরে থাকে। এটিকে  ‘নাপাং’ বলা হয়। তাদের শরীরে বেশীরভাগ অংশই বস্ত্রহীন থাকে। তবে এখন অনেক মুরুং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উপযোগী বস্ত্র পরিধান করে আসছে।

 মুরুং অলংকার

মুরুং নারী পুরুষ বেশ অলংকারপ্রিয়। তাদের অধিকাংশ অলংকার বাজার থেকে বিশেষ কায়দায় তৈরী করা হয়। তারা অলংকারপ্রিয় হলেও নিজেরা এ ক্ষেত্রে এখনো অনেকটা পরনির্ভরশীল।

 Caption-03

মেয়েরা তাদের শরীর বিভিন্ন রং দিয়ে সাজাতে পছন্দ করে। ছেলে এবং মেয়ে উভয়েই তাদের ঠোঁটে রং লাগায়। অনেক সময় তারা তাদের গাল, ঠোঁট এবং কপাল লাল রঙে রঙিন করতে পছন্দ করে।

মেয়েরা মাথায় ও কানে ফুল পরে এবং গলায় পুঁতির মালা পরতে ভালবাসে। মেয়েদের মতো পুরুষরাও কান ফুটা করে এবং রিং ব্যবহার করে। মেয়েরা পায়ে “কক ক্যান” (নুপুর) কোমরে ‘‘রকম” (বিছা) পড়ে থাকে। চুলের খোপায় বিভিন্ন ধরণের “পাও” (পাহাড়ী ফুল) গুজে রাখে ’।[3]

‘যুবতীরা গলায় বিভিন্ন ধরনের পুঁতির মালা (কেংঙ অর), কানে রূপার অলংকার (রামছেং), বাহুতে রূপার বালা (জারকই), কব্জিতে হাতে বালাসহ বিচিত্র অলংকার পরে থাকে। পুরুষ ও রমণী উভয়েই মাথার খোপায় নিজেদের তৈরী কাঠের চিরুনী (চুরুত) গুঁজে রাখে। এছাড়াও চুলের কাঁটা (কেংপ্রলুচুকস), চুলের মালা (লেমেন কেং), রূপার তৈরী কোমবন্ধনী (রোয়াকম), গলার হার (কেংবুক) পরিধান করে। পাহাড়ি ফুল, লতাপাতা, বিশেষ ধরণের ফলের বিচি দিয়েও মুরুং মেয়েরা নানারূপী অলংকার তৈরী করে থাকে। মুরুং পুরুষরা হাতে ধাতুনির্মিত বালা পরে এবং কান ছিদ্র করে রূপার তৈরী  অলংকার/দুল পরে।[4]

 মুরুং সামাজিক উৎসব ও রীতিনীতি

‘গো হত্যা মুরুংদের প্রধান সামাজিক উৎসব। জুমের ফসলাদি উত্তোলনের পরিসমাপ্তিতে মুরুংরা ‘গো হত্যা’অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে’।[5]

মুরুংদের সমাজ ব্যবস্থায় বৈচিত্রময়। দেখা যায় যে, প্রত্যেক নারী পুরুষকে কানে ছিদ্র করতে হয়। মুরুং ভাষায় কান ছিদ্র করাকে বলা হয়- ‘রুইপারাম’। সাধারণত: তিন বছর বয়সে এই কান ছিদ্র করা হয়। কান ছিদ্র করার নির্দিষ্ট দিনে পাড়া প্রতিবেশীদের দাওয়াত খাওয়ানো হয়। এতে ১টি শুকর ও ১টি মোরগ কেটে ১ বোতল মদসহ নিমন্ত্রিতদের খাওয়ানো হয়। নিমন্ত্রিতদের সামনে বসে গ্রামের একজন বৈদ্য কান ছিদ্র করে। এর মাধ্যমে শিশুদের মুরুং সমাজে অন্তর্ভূক্ত করা হয়।

Caption-4

সাধারণত কোন পূজা ব্যতীত মুরুং সমাজে মাছ-মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ। সমাজের রীতি হিসাবে প্রত্যেক অবিবাহিত মুরুং ছেলেমেয়ে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে দাঁত কালো রাখে। তাদের ধারণা ওই পদ্ধতিতে দাঁত কালো করে রাখলে দাঁত শক্ত ও মজবুত হয়। যদিও বর্তমানে এই রীতি অনেকাংশে লোপ পেয়েছে।

 মুরুং সামাজিক বাধ্যবাধকতা ও জীবনাচার

মুরুং সমাজে জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহকে সামাজিক জীবনাচারে কতিপয় শর্তে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। মুরুং সমাজের কোন পরিবারে শিশু ভূমিষ্ট হবার পর তেমন কোন আনুষ্ঠানিকতা হয় না। সন্তান প্রসবের আলামত স্পষ্ট হলে প্রসূতিকে বাড়ির ‘কিম্মা’ কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রসূতিকে সন্তান প্রসবে ধাত্রীরা সাহায্য করেন। জন্মের পর শিশুকে কলাপাতার বিছানা কিংবা কম্বলে শোয়ানো হয়। প্রসূতিকে শুধুমাত্র লবণ দিয়েই ভাত খেতে হয়। প্রসবোত্তর প্রসূতিকে ইষৎ গরম পানিতে গোসল করানো হয়। সন্তান ও মা নয় দিন পর্যন্ত ঘর থেকে বের হতে পারে না। ৯ দিন অতিবাহিত হলে প্রসূতিকে পার্শ্ববর্তী ঝিরি কিংবা খালে স্নান করিয়ে আনা হয়। এরপর প্রসূতি সাংসারিক ও স্বাভাবিক কাজ-কর্মে যথারীতি অংশ নিতে পারেন।

 পুরুষের চেয়ে মুরুং নারীরাই বেশি পরিশ্রমী

কৃষিক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় মুরুং উপজাতি নারীরাই অনেক বেশি পরিশ্রমী। ঘর সামলে পাহাড়ে জুম চাষ, ফলের বাগান সৃজনসহ আর্থনৈতিক উন্নয়নে তারা নিরলসভাবে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে থাকে।

জীবিকা নির্বাহের জন্য এখনও পাহাড়ি মুরুং নারীরাই তাদের সংসারের হাল ধরে টিকিয়ে রেখেছেন। একজন পাহাড়ি নারী দিনের শুরুতে স্বামী-সন্তানকে সামলিয়ে জুম চাষ কিংবা বাগানে কাজের জন্য চলে যান উঁচু উঁচু পাহাড়ের জুম ক্ষেতে। সারাদিন কাজ করে পাহাড়ি সবজী নিয়ে বিকালে বাড়িতে পৌঁছে রান্নাবান্নার কাজ সারেন। এভাবেই প্রতিদিনকার জীবনকে মানিয়ে নিয়েছেন পাহাড়ে বসবাসরত মুরুং নারীরা।

Caption--05 (2)

মুরুং নারীরা পুরুষদের মতো জুম ক্ষেতে কাজ করে। জুমে বিভিন্ন সবজি ও ধান রোপণ থেকে শুরু করে ঘরে তোলা পর্যন্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে থাকে তারা। ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত চওড়া ‘ওয়াংক্লাই’ নামে এক ধরণের ছোট কাপড় পরে জুমে ফসল রোপন ও আহরণ করে। যদি শিশুসন্তান থাকে; তাহলে শিশুটিকে কাপড় মুড়িয়ে বুকের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে জুমের পরিচর্যা করে থাকেন। মুরুং নারীরা শুধু সন্তান প্রসবের কয়েক দিন বিশ্রামে থাকে। বাকি সব দিন তারা পরিশ্রম করে।

মুরুং নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা  যায়, কাজ করতে তাদের কোনো সমস্যা নেই, জুমে নেমে ধান কেটে আহরণ করতে দীর্ঘ সময় পাহাড়ের গায়ে থাকতে কষ্ট হলেও এতে তাদের আপত্তি নেই। সংসারের চাহিদা মেটাতে জুমে মা-বাবা, স্বামী-ছেলের কাজে সহযোগিতা করতে তারা কাজ করে। পুরুষরা যাতে সংসারের অন্যান্য কাজ করার সুযোগ পায়, সেজন্যই মুরুং নারীরা জুমে চাষাবাদের মতো কষ্টকর কাজ করছেন। বিশেষ করে জুম মৌসুমে কাজ করতে তাদের ভালো লাগে। নিজেদের বা বর্গা পাহাড়ে চাষাবাদ ও জুমের ধানসহ সবজি আহরণ করে তারা আনন্দ পায়। পাশাপাশি তাদের বাড়তি আয় হয় এবং তা সংসারের উপকারে আসে।

** তথ্যসূত্র : পার্বত্য চট্টগ্রামের মুরুং উপজাতি, লেখক ও সম্পাদক মমতাজ উদ্দিন আহমদ, প্রকাশকাল- একুশে বইমেলা- ২০১০। **

লেখক : বান্দরবান প্রতিনিধি, পার্বত্যনিউজ ডটকম ও সভাপতি, আলীকদম প্রেস ক্লাব।



[1] http://www.dcrangamati.gov.bd/

[2] প্রেক্ষণ : পার্বত্য চট্টগ্রাম গিরিনন্দিনী আলীকদম, লেখক: মমতাজ উদ্দিন আহমদ, একুশে বইমেলা- ২০০৮

[3] প্রেক্ষণ : পার্বত্য চট্টগ্রাম গিরিনন্দিনী আলীকদম, লেখক: মমতাজ উদ্দিন আহমদ, প্রকাশকাল- একুশে বইমেলা- ২০০৮

[4]   বাংলাদেশের ম্রো উপজাতির জীবনধারা, লেখক: মুহাম্মদ আব্দুল বাতেন, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারী, ২০০৩।

[5] http://www.dcbandarban.gov.bd/index.php

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন