বাংলাদেশে ঘুর্ণিঝড়ের ইতিহাস

image_26199_0 

ডেস্ক নিউজ, ঢাকা:

ঘুর্ণিঝড়, হ্যারিকেন ও সাইক্লোনের দেশ বাংলাদেশ। আবহমান কাল থেকে বঙ্গোপসাগর থেকে উত্থিত ঝড় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন তছনছ করে আসছে। সব ঝড়ের তথ্য না থাকলেও ১৫৯৮ সাল থেকে বড় ঝড়গুলোর তথ্য সংরক্ষিত আছে। তা সত্ত্বেও ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ভোলাসহ উপকূল দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়টি সবচেয়ে বেশি আঘাত দিয়েছে বাংলাদেশের মানুষের জীবনে। এ ছাড়া ১৯৯১ সালে চট্টগ্রামের ঝড়, ২০০৭ সালের সিডর ও আইলার ভয়াবহতা মানুষ ভুলতে পারছে না। তবে সিডর ও আইলা প্রচণ্ড শক্তিশালী হওয়ার পরেও ক্ষতি ছিল অনেক কম। এটা সম্ভব হয়েছিল আগেই ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে যায় এলাকাবাসী ও মোকাবেলার যথেষ্ট প্রস্তুতি নেয়া হয় সরকারি ও বেসরকারিপর্যায় থেকে।

আইলা : ২০০৯ সালের ২৭ মে বাংলাদেশ ও ভারতে আঘাত হানে আইলা। এ ঝড়ে ৩৩০ জন মানুষ মারা গেলেও সাড়ে আট হাজারের বেশি নিখোঁজ হয়। বাড়িঘর থেকে স্থানচ্যুত হয় ১০ লাখের বেশি মানুষ। আইলা পরবর্তী দুর্যোগে সাত হাজারের বেশি মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। বিশুদ্ধ পানির ঘাটতি দেখা দেয়। সম্পদের ক্ষতি হয়েছিল ৫৫ কোটি ২৬ লাখ ডলারের। সম্পদের ক্ষতি থেকে দেশকে রক্ষা করা যায়নি।

সিডর : ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সংঘটিত ঝড়টির নামই সিডর। ২৬০ কিলোমিটার বেগে প্রবাহিত হওয়া এই ঝড়টি মধ্য বঙ্গোপসাগরে হঠাৎ উত্থিত হয়েই শক্তিশালী হয়ে পড়ে। প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ এ ঝড়ে মারা যান। সেভ দ্য চিলড্রেন ও বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পরিসংখ্যান মতে মৃতের সংখ্যা পাঁচ থেকে ১০ হাজারের মধ্যে ছিল। ২০০৭ সালের ৯ নভেম্বর আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছে একটি দুর্বল ঘূর্ণনের ফলে এটির সৃষ্টি হলেও পরে তা প্রবলশক্তি সঞ্চয় করে ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশের সুন্দরবন, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট এলাকায় প্রবল বেগে আঘাত হানে।

১৯৯১ সালের চট্টগ্রাম ঝড় : ১৯৯১ সালের ২৯ ও ৩০ এপ্রিলের চট্টগ্রামের ঝড়ে প্রায় দেড় লাখ মানুষ মারা যান এবং গবাদি পশু মারা যায় প্রায় ৭০ হাজার। সব মিলিয়ে এ ঝড়ে ৬০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতি হয়েছিল। ১৯৯১ সালের ২৯ ও ৩০ এপ্রিলের ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার। তবে এনওএএ-১১ নামক স্যাটেলাইটের রেকর্ড থেকে বলা হয়েছিল ঝড়টির গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৪০ কিলোমিটার। এটি ভারত মহাসাগর থেকে উত্থিত হয় এবং ২০ দিন পর বঙ্গোপসাগরে এসে পৌঁছায় এবং চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানে। ঝড়টি ৬০০ বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে ঘূর্ণন করে। উপকূলীয় এলাকায় পাঁচ থেকে আট মিটার উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হয়ে তলিয়ে গিয়েছিল ফসলের মাঠ, ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ঘর, গাছপালা ও পশুপাখি।

২৪-৩০ নভেম্বর ১৯৮৮ : যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল ও খুলনার উপকূলীয় দ্বীপাঞ্চলে ১৬২ কিলোমিটার বেগে সংঘটিত ঝড়ে পাঁচ হাজার ৭০৮ জন মারা গিয়েছিল। এ ঝড়ে সুন্দরবনের ১৫ হাজার হরিণ ও ৯টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার মারা গিয়েছিল। গবাদিপশু মারা যায় ৬৫ হাজার ও সম্পদের ক্ষতি হয় ৯৪১ কোটি টাকার।

৩১ মে থেকে ২ জুন ১৯৯১ : ১৯৯১ সালের ৩১ মে থেকে ২ জুন আরেকটি ঝড় পটুয়াখালী, বরিশাল, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম উপকূলীয় স্থলভাগে আঘাত করে ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার বেগে।

২৯ এপ্রিল থেকে ৩ মে ১৯৯৪ : এ বছরের ২৯ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত আরেকটি ঝড় কক্সবাজার উপকূলে আঘাত করে ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটার বেগে। এ ঝড়ে মারা গিয়েছিল ৪০০ মানুষ।

৮-৯ নভেম্বর ১৯৮৬ : উপকূলীয় দ্বীপাঞ্চল ও চর এবং চট্টগ্রাম, বরিশাল, পটুয়াখালী ও নোয়াখালী জেলার ওপর দিয়ে এ দুই দিনে ১১০ কিলোমিটার বেগে এবং খুলনায় ৯০ কিলোমিটার বেগে ঝড় বয়ে যায়। এ ঝড়ে ১৪ জন মারা গেলেও ৯৭২ বর্গকিলোমিটারের ধানেরক্ষেত ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

২৪-২৫ মে ১৯৮৫ : চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজারের সন্দ্বীপ, হাতিয়া, উড়িরচরে ঝড়টি হয়। চট্টগ্রামে ১৫৪ কিলোমিটার বেগে, সন্দ্বীপে ১৪০ কিলোমিটার, কক্সবাজারে ১০০ কিলোমিটার বেগে ঝড় হয়। ৩ থেকে ৬ মিটার উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাসে সম্পদের ক্ষতির সাথে মানুষ মারা যায় ১১ হাজার ৬৯ জন, এক লাখ ৩৬ হাজার গবাদিপশুও মারা যায়।

৫-৯ নভেম্বর ১৯৮৩ : চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, উখিয়া, মঈপুø সোনাদিয়া, বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী জেলার ওপর দিয়ে ১৩৬ কিলোমিটার বেগে ঝড়টি বয়ে যায়। মানুষ মারা যায় ৩০০।

ভোলা সাইক্লোন ১৯৭০ : এ বছরের ৭ থেকে ১৩ নভেম্বর ভোলা সাইক্লোনে প্রায় ১০ লাখের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। চট্টগ্রাম, ভোলা, চরফ্যাসন, মনপুরা, সন্দ্বীপ, বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, বোরহানুদ্দিন, চর তজুমদ্দিন, দক্ষিণ মাঈজদী, হারিয়াঘাটা এলাকার ওপর দিয়ে এ দিন ২২২ কিলোমিটার বেগে ঝড় হয়েছিল। ২০ হাজার জেলে নৌকা নিখোঁজ হয়েছিল। ১০ লক্ষাধিক গবাদিপশু মারা গিয়েছিল অথবা হারিয়ে গিয়েছিল জলোচ্ছ্বাসে। বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছিল চার লাখের বেশি। এ ঝড়পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবেলা, ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি সহায়তা অপ্রতুলতা ইত্যাদি নিয়ে তখন পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছিল।

১ অক্টোবর ১৯৬৬ : সন্দ্বীপ, বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা জেলার ওপর দিয়ে ১৪৬ কিলোমিটার বেগে ঝড়টি বয়ে যায়। জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল পাঁচ থেকে ৯ মিটার উচ্চতায়। মারা গিয়েছিল ৮৫০ এবং গবাদিপশু মারা যায় প্রায় ৬৫ হাজার।

১৪-১৫ ডিসেম্বর ১৯৬৫ : এ দিনে কক্সবাজার, পটুয়াখালী জেলার ওপর দিয়ে ২০১ কিলোমিটার বেগে বয়ে যাওয়া ঝড়ে মারা গিয়েছিল ৮৭৩ জন। পাঁচ থেকে ছয় মিটার উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হয় সে দিন।

২৮-২৯ মে ১৯৬৩ : চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার, সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, হাতিয়া, মহেশখালী ১৬৪ কিলোমিটার বেগে ঝড় হয়। মারা যায় ১১ হাজার ৬১৭ জন। ৩২ হাজারের বেশি গবাদিপশু মারা যায় তখন।

২৬-৩০ অক্টোবর ১৯৬২ : ফেনী জেলায় ১৬১ কিলোমিটার বেগে বয়ে যাওয়া ঝড়ে মারা যায় এক হাজার জন।

৯ মে ১৯৬১ : বাগেরহাট, খুলনা জেলায় ১৬১ কিলোমিটার বেগে ঝড় হয় এবং মারা যায় ১১ হাজার ৪৬৮ জন। নোয়াখালী ও হরিয়ানাপুর পর্যন্ত রেলওয়ে লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

৩০-৩১ অক্টোবর ১৯৬০ : ২১০ কিলোমিটার বেগে সংঘটিত ঝড়ে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর ও পটুয়াখালী জেলায় ১০ হাজার মানুষ মারা যান। গবাদিপশু মারা যায় ২৭ হাজার ৭৯৩, পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার বাড়িঘর ধ্বংস হয়, যার ৭০ শতাংশই হাতিয়ায়। দু’টি বড় সাগরগামী জাহাজ উপকূলে উঠে পড়ে ও পাঁচ-ছয়টি লাইটারেজ জাহাজ কর্ণফুলীতে ডুবে যায়।

৮-৯ অক্টোবর ১৯৬০ : প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ে মেঘনা নদীর খাড়ি অঞ্চল ও নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর, পটুয়াখালী অঞ্চলের তিন হাজার মানুষ মারা যান। ঝড়ের বেগ ছিল ২০১ কিলোমিটার ঘণ্টায়। ৬২ হাজার ৭২৫টি বাড়িঘরের ক্ষতি হয়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন