বাংলা না জানায় রোগীকে চিকিৎসকের অপমান!

শৈবাল আচার্য্য:

৪৮ বছর বয়সী তরুণ কান্তি চাকমার বাড়ি রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে। বেশ কিছুদিন ধরে শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছেন। এ অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) তাকে চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদ মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান ছেলে এলিন চাকমা।

তবে চিকিৎসা নিতে গিয়ে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন তারা। বাংলা ভাষায় রোগের বিস্তারিত বলতে না পারায় তরুণ কান্তিকে অপমান করে কথা বলেন হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোলজি বিশেষজ্ঞ ডা. মোসলেহ উদ্দিন শাহেদ।

একপর্যায়ে বাবাকে অপমানের বিষয়ে কথা বলায় কক্ষ থেকে ছেলেকে বের করে দেন তিনি। ছেলেকে বের করে দেওয়ার পর অসহায় হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে বাবাও বের হয়ে যান। চিকিৎসকের এমন রূঢ় আচরণে হতভম্ভ বাবা-ছেলে পরে চিকিৎসা না নিয়েই হাসপাতাল থেকে চলে যান।

পরে ঘটনাটি নিয়ে ফেসবুকে ‘বাবাকে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে এত বড় লাঞ্ছিত, অপমানিত হতে হবে, স্বপ্নেও ভাবিনি’ শিরোনামে একটি স্ট্যাটাস দেন এলিন চাকমা। তার স্ট্যাটাসটি ভাইরাল হয়ে যায়। চিকিৎসা নিতে গিয়ে চিকিৎসকের কাছ থেকে এমন আচরণ পাওয়ার ঘটনায় নিন্দার ঝড় ওঠে ফেসবুকে। দোষী চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতেও দাবি তুলেছেন অনেকে।

এলিন চাকমা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বাবা থাকেন রাঙামাটিতে। পড়াশোনার সূত্রে আমি হালিশহরে বোনের সঙ্গে থাকি। এখানে বাবা বেড়াতে এসেছিলেন। বেশ কিছুদিন ধরে পেটে ব্যথাসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগতে থাকায় বাবাকে গত বৃহস্পতিবার সকালে আগ্রাবাদ মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাই। টিকিট কাটার প্রায় এক ঘণ্টা পর চিকিৎসকের কক্ষে প্রবেশের সুযোগ পাই। কক্ষে ঢোকার পর ডা. মোসলেহ উদ্দিন শাহেদ সমস্যার কথা জানতে চান বাবার কাছে। বাবাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কী করেন? তবে বাবা বাংলা ভাষা না জানায় চিকিৎসকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছিলেন না। তখন আমি চিকিৎসককে বলি, বাবা বাংলা বলতে পারেন না, তেমন বুঝতেও পারেন না। আমাদের এলাকায় কোনো বাঙালি পরিবারও নেই। তাই বাবার সঙ্গে আমি এসেছি।

তিনি বলেন, এরপর চিকিৎসককে বললাম, বাবার পেটে সমস্যা। ঠিকমতো প্রস্রাব হয় না। তখন চিকিৎসক উঁচু স্বরে বাবাকে বলেন, আপনি বাংলা বোঝেন না? বাংলা বলতে পারেন না? বাড়ি কোথায়? তখন বাবা একদম চুপচাপ হয়ে থাকেন। বাবা যখন হতভম্ব হয়ে কিছুই বলতে পারছেন না, তখন আমি বললাম, আমাদের বাড়ি রাঙামাটি।

এলিন চাকমা আরও বলেন, এরপর চিকিৎসক বাবাকে বললেন, বাংলাদেশে থাকেন, বাংলা বলতে পারেন না। এদেশে থাকলে অবশ্যই বাংলা পারতে হবে। তখন চিকিৎসককে বললাম, বাবা একদম পড়াশোনা করেননি। তাই বাংলা বলতে পারেন না। এ সময় চিকিৎসক আমাকে ধমক দিয়ে বলেন, আপনি চুপ করুন। তিনি বাবাকে বলতে থাকেন- বাংলা পারেন না কেন? বাংলা শেখেননি কেন?

এলিন চাকমা বলেন, একপর্যায়ে বাবার সঙ্গে এমন আচরণ করছেন কেন, জানতে চাইলে চিকিৎসক উচ্চ স্বরে বলে ওঠেন- আপনি আমার সঙ্গে তর্ক করছেন? আপনার স্পর্ধা তো কম নয়। গেট আউট। বাংলা পারে না, আবার আসছে তর্ক করতে। এসব মানুষ কোত্থেকে যে আসে। এরপর এলিন চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বের হয়ে যান। পরে ছেলের কক্ষত্যাগ দেখে বাবাও তার পিছু নেন। পরে বাবাকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যান ছেলে।

এলিন জানান, ঘটনার সময় চিকিৎসকের কক্ষে আরও কয়েকজন চিকিৎসক, নার্স ও রোগী ছিলেন। চিকিৎসক মোসলেহ উদ্দিন শাহেদের উচ্চ স্বরে কথা বলা শুনে সবাই তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। কেউ একটু প্রতিবাদও করেননি।

তিনি বলেন, উপায় না দেখে আমি বার বার চিকিৎসকের কাছে দু:খ প্রকাশ করেছি। এর পরও তিনি বাবাকে অপমান করে কথা বলতেই থাকেন। তখন বাবার অসুস্থতার কথা চিন্তা করে একবুক কষ্ট নিয়ে ওই কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য হই।

অভিযোগ প্রসঙ্গে কথা বলতে শনিবার (৬ এপ্রিল) দুপুরে বেশ কয়েকবার ডা. মোসলেহ উদ্দিন শাহেদের মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হয়। একপর্যায়ে ফোন ধরে জানতে চাওয়া হয়, কে বলছেন? তখন সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ওপাশ থেকে বলেন, ডা. একটু দূরে আছেন। আমি তার কাজিন। তবে কাজিন পরিচয় দেওয়া সেই ব্যক্তি তার নাম বলতে পারবেন না বলে জানান। উল্টো তিনি এই প্রতিবেদকের নাম জানতে চান এবং ডাক্তারের সঙ্গে কিসের কথা, তাও জানতে চান। এরপর ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে ৫ থেকে ১০ মিনিট পর কল দিতে বলে ফোন রেখে দেন। পরে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ওই নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।

বিষয়টি হাসপাতালের কার্যনির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক ডা. আঞ্জুমান আরার নজরে আনলে তিনি বলেন, একজন চিকিৎসক কখনও এমন কাজ করতে পারেন না। রোগী সব ভাষা জানবেন এমন নয়। বরং চিকিৎসকদের পেশাগত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার জন্য অন্য সব ভাষা সম্পর্কে জানা উচিত। বিষয়টি আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখব।

এ ঘটনায় দু:খ প্রকাশ করে হাসপাতালের পরিচালক ডা. নূরুল হক বলেন, বার বার চিকিৎসকদের বলি, আপনারা কখনও কোনো রোগীর সঙ্গে খারাপ আচরণ করবেন না। এর পরও এমন ঘটনা সত্যি কষ্টের। অভিযুক্ত চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন চট্টগ্রাম বিভাগের ডেপুটি গভর্নর আমিনুল হক বাবু বলেন, বাংলা ভাষায় কথা বলতে না পারায় কক্ষ থেকে বের করে দিয়ে চিকিৎসক মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন। চিকিৎসকের কাজ রোগীকে সেবা দেওয়া, ভাষা শেখানো নয়।

তিনি আরও বলেন, চিকিৎসকের বিরুদ্ধে রোগীকে লাঞ্ছনা করার মৌখিক অভিযোগ পেয়েছি। হাসপাতালে গিয়ে ওই চিকিৎসকের কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাইব আমরা। প্রাথমিক তদন্তে আমরা মনে করছি, চিকিৎসক রোগীর সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করেছেন। তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সূত্র: দৈনিক সমকাল

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: বাংলা না জানায় রোগীকে চিকিৎসকের অপমান!
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন