parbattanews

বান্দরবানে পথিকের ক্লান্তি ফুরাতে “চেহ্ রাইঃ” ঘর

দুপুরে কাঠফাটা তীব্র রোদ। রাঙ্গামাটি থেকে বান্দরবান ফেরার পথের তৃষ্ণা মেটানো জন্য দাড়িয়েছিলাম ক্যমলং নামে একটি গ্রামের রাস্তার ধারে । হঠাৎ দেখা মিলে কয়েকজন শ্রমিক তৃষ্ণা মেটানোর জন্য পাহাড়িদের “চেহ্ রাইঃ” ঘর”থেকে পানি পান করছেন।

পাহাড়িদের “চেহ্ রাইঃ” ঘর” (বিশ্রাম নিবাস) নিয়ে কথা হয় ক্যামলং পাড়াবাসী খেই সাং উ মার্মা (৫৫) সাথে। তিনি জানান, এটি মারমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য সংস্কৃতি। মারমা ভাষায় বলা হয় “চেহ্ রাইঃ” ঘর। অর্থাৎ বিশ্রাম নিবাস। এই সংস্কৃতি বহুকাল থেকে প্রচলিত।

জানা গেছে, আদিকাল থেকে মারমা সম্প্রদায়ের এই বিশ্রাম নিবাসটি সংস্কৃতি হিসেবে রাখা হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের দুর্গম এলাকার গ্রামে এই ঘরটি গ্রামের মধ্যখানে কিংবা গ্রামে রাস্তা কিনারে দেখা মিলে। আবার সেই ঘরটিতে পঞ্চায়েত নালিশ কিংবা আড্ডায় বসেন। পাহাড়িদের এটি সংস্কৃতি একটি অংশ বলে জানা গেছে। তবে কখন থেকে এই সংস্কৃতি চালু হয়েছে নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারেন না।

মারমা জনগোষ্ঠির সাথে কথা বলে জানা যায়, পথিকরা যখন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার হয় তখন বিশ্রামের জন্য বটগাছের তলে এ ঘরটি তৈরী করা হয়েছে। আবার গ্রামের মাঝখানেও তৈরী করা হয়ে থাকে। সেই ঘরে একটু উঁচুতে ২-৩টি মাটি বানানো কলস। বিশ্রামের পাশাপাশি তৃষ্ণা নিবারণে এটি রাখা হয়। বলা হয়ে থাকে পূর্বে যখন যানবাহন প্রচলিত হয়নি কিংবা পায়ে হাটা ছাড়া কোন উপায় ছিলনা তখন মানুষ প্রয়োজনে এক জায়গা থেকে দুরবর্তী আরেক জায়গায় পায়ে হেটে যেতো। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত- শ্রান্ত পথিক তখন একটু বিশ্রাম ও তৃঞ্চার্ত শারীরিক মানসিক প্রাণ শক্তি সঞ্চয় করতে বিশ্রাম নিবাসে একটু বিশ্রাম নেন ।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বান্দরবান সদর উপজেলার অন্তর্গত শহর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ক্যামলং পাড়া। বান্দরবান – রাঙ্গামাটি সড়কের পাশে দুটি বড় অশ্বত্থগাছের মাঝখানে বসে আছে চেহ্ রাইঃ ঘর। পাশাপশি জয় মোহন পাড়া, জামছড়ি মূখ পাড়া, থোয়াইঙ্গ্যা পাড়া, ক্যামলং পাড়া সহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো এই মানবতার ঘর দৃশ্যমান। বিশেষ করে ফাল্গুন -চৈত্রমাসে, কিংবা বর্ষাকালে পথচারীদের অনেক উপকারে আসে বলে জানা যায়। সে ঘরে বিশ্রাম ও তৃষ্ণার মেটাতে মাটির তৈরীর দুইটি কলসির স্থান। শুধু একটি উপকার জন্য নয়, শত শত মানুষের তৃঞ্চা মেটায় এবং সাধারণ মানুষের চলাচলরত ঝড়বৃষ্টি থেকেও নিরাপদ রাখে।

ক্যমলং পাড়াবাসী মংছো মার্মা (৬৫) বলেন, আদিকালে থেকে বিশ্রাম নিবাসের ঘরটি সংস্কৃতির হিসেবে প্রচলিত রয়েছে। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা সেই ঘরে নালিশ, আড্ডায় ও রাত্রে গ্রামের পাহাড়া হিসেবে ব্যবহার করত। সেই ঘরে তৃষ্ণার নিবারণে জন্য মাটির কলসিতে পানি রাখা হতো।

জামছড়ি পাড়াবাসী মিথুই চিং মার্মা (৪৫) বলেন, সাধারণ মানুষ বিশ্রামের পর যাতে পানি খেতে পারে সে জন্য ২-৩দিন পর পর কলসিতে পানি ভরে দিতে হয়। যাতে পথিকরা তৃষ্ণার মেটাতে পারে। কেননা মানুষ মৃত্যুের পথযাত্রীকেও পানি দেয়। শুধু তাই নয় তৃঞ্চার্ত মানুষকে পানি খাওয়ালে অনেক পূণ্য হয়।

বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মতে, এই চেহ্ রাইঃ ঘর তৈরী করে ক্লান্ত পথিকের ঠান্ডা পানি দিয়ে পিপাসা মিটানো রোদ,ঝড় বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বৌদ্ধ সম্প্রাদায়ের মারমা জনগোষ্ঠিরা সমাজে প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রায় দেখা মেলে বিশ্রাম নিবাস অন্তরালে পানি ভর্তি কলসি সহ ছোট্ট ঘর। মারমাদের বিশ্বাস কোন ক্লান্ত,শ্রান্ত, তৃঞ্চার্ত পথিক এইঘর থেকে পানি পান করলে যেই ব্যক্তি এই মহৎ কাজটি করেছেন তার উদ্দেশ্যে করে তৃঞ্চার্ত ব্যক্তি পিপাসা মিটিয়ে ধর্ম, পূণ্য, আর্শীবাদ পাবেন এই আশায় মানবতার কাজটি করেন।কারন কলসির ভিতর শুধু ঠান্ডা পানি নয় গভীর মমতায় মানবতাও থাকে।

২নং কুহালং ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সানু প্রু মার্মা (৭৫) বলেন, এই চেহ্ রাইঃ ঘর তৈরী করে পথচারীদের সাময়িক বিশ্রাম ও তৃঞ্চা মেটানোর কাজটি কবে থেকে শুরু হয়েছে। তবে সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা না গেলেও অনুমান করা যায় এই সংস্কৃতি প্রচলন শত শত বছর আগে প্রচলিত।

হ্নারা মৌজার হেডম্যান ও বান্দরবান সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান রাজু মং মার্মা বলেন, লামা,আলিকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, রুমা,রোয়াংছড়ি,থানছিসহ ৭টি উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো এ ঘরগুলো প্রচলিত রয়েছে। পূণ্যের আশায় পাহাড়ের মানুষজন এই বিশ্রাম নিবাস ঘরগুলাও তৈরী করে পানীয় জল ও ক্ষণিকের বিশ্রামের ব্যবস্থা করে থাকেন।

বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউটে পরিচালক মংনুচিং জানান, চেরাই ঘর “এটি মারমাদের ঐতিহ্য সংস্কৃতি। সংস্কৃতির বিলুপ্তি হলেও কিছু কিছু সংস্কৃতি এখনো প্রচলিত রয়েছে। এটি পূর্ব পুরুষ থেকে তৈরীকৃত সংস্কৃতি ঘর । তবে কখন থেকে প্রচলিত সেটি জানা যায় নাই।

Exit mobile version