বান্দরবানে সর্পভুক ও বন্যপ্রাণীর নেপথ্য কাহিনী

fec-image

একসময় গাছে বসবাস করত সর্পভুক জাতির মানুষেরা আজও ওদের মাচাং ঘর সেই স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। আরণ্যক মহানৈশব্দের মধ্যে বসবাসকারী মানুষগুলো কথাও বলে খুব কম। অন্য সম্প্রদায় থেকে অনেকটা দূরে পাহাড়চূড়ায় বসবাস করতে পছন্দ করে এরা। দুর্দান্ত শিকারি জাতি। আর সাপ এদের প্রিয় খাবার। বান্দরবানজুড়ে তাদের বাস।

সাজেক, শুভলং, কাশালং, মাইনি, থুংলুং, চেঙ্গি, তবলছড়ি, কালাপাহাড়, বন্দুকভাঙ্গা, হরিনা, গোবাইছড়ি, রাম পাহাড়, সীতা পাহাড়, রাইনখং, চিম্বুক, মৌদক, মিরেঞ্জা—উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত এসব সুউচ্চ পাহাড় আর উপত্যকার বুক চিরে বয়ে চলেছে কর্ণফুলী, চেঙ্গি, মাইনি, কাসালং, রাইংখ্যং, সাঙ্গু, মাতামুহুরী। সবুজ পাহাড় বেয়ে এগিয়ে চলা এসব নদ-নদীর পাশাপাশি এখানে রয়েছে শত শত মনোহর ঝরনা, হাজার হাজার ছড়া আর ঝিরি। আরও আছে রাইংখ্যং হ্রদ, পাহাড়ঘেরা বোগাকাইন বা বগা হ্রদ, বিশাল পাহাড়ি অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে আছে কৃত্রিম কাপ্তাই লেক। এরা শুধুই স্তম্ভিত জলরাশি নয়, ফুটে আছে পাহাড়ের উজ্জ্বল চাঁদ হয়ে। এ যেন এক অন্য জগৎ, সবুজ শোভিত, অরণ্যবেষ্টিত, উঁচু-নিচু বৈচিত্র্যময় ভূমির নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম। বাংলাদেশের এক রূপময় অংশ।

এই বিচিত্র ভূমিতে বিচিত্র সব মানুষের বাস। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, বোম, তঞ্চঙ্গ্যা, খিয়াং, পাংখো, উসাই, লুসাই, রিয়াং, খুমী, চাক, কুকি আর সেন্দূস। ভূবৈচিত্র্য আর নানা জাতের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর অবস্থান অঞ্চলটিকে অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। এই আরণ্য ভূস্বর্গ আমায় যতবার ডেকেছে, আমি ছুটে গেছি তার বুকে—কখনও কাজের সূত্র ধরে, কখনো নিছক ভ্রমণে।

অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করেন পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে কাদের জীবন সবচেয়ে বৈচিত্র্যময়। আমি এক কথায় বলে দেই, মুরংদের। নিজেদের ম্রো (মানুষ) বলে পরিচয় দিতে যারা ভালোবাসে।

তিন পার্বত্য জেলার বান্দরবানজুড়ে ম্রোদের বাস। সুদূর অতীতে খুমিদের সঙ্গে এক রক্তাক্ত যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তারা বার্মা থেকে এদিকের অঞ্চলে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। একসময় গাছে বসবাস করত, আজও ওদের মাচাং ঘর সেই স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। ওরা নিরাভরণ থাকতে পছন্দ করত। মেয়ে, পুরুষ সবারই লম্বা চুল, গলায় মালা, কানে ফুল। আরণ্যক মহানৈশব্দের মধ্যে বসবাসকারী মানুষগুলো কথাও বলে খুব কম। অন্য সম্প্রদায় থেকে অনেকটা দূরে পাহাড়চূড়ায় বসবাস করতে পছন্দ করে এরা। দুর্দান্ত শিকারি জাতি। তবে ইদানিং তথাকথিত সভ্যতার প্রভাবে ওদের অনেক কিছুতেই পরিবর্তন এসেছে।

এটা অবশ্য একান্তই আমার ব্যক্তিগত অভিমত, যা জন্ম নিয়েছে মুরংদের প্রতি বিশেষ ভালোবাসা থেকে। আসলে এখানে বসবাসকারী মানুষগুলোর দেহের গড়ন অনেকটা একই রকম হলেও ভাষা, সংস্কৃতি, পরিচ্ছেদ আর আনুষ্ঠানিকতার দিক দিয়ে প্রত্যেকেই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। বৈচিত্র্যের কমতি নেই কারও জীবনে। ওরা গাইতে ভালেবাাসে, নাচতে ভালোবাসে, সাজতে ভালোবাসে। ওদের জীবনে উৎসব আর অনুষ্ঠানের সংখ্যা কম নয়। জন্ম-মৃত্যু থেকে বিয়ে উদ্যাপিত হয় বিচিত্র অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।

এই পাহাড়ে অঞ্চলটা যেরকম নানা জাতের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের উপস্থিতিতে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে, তেমনি এখানে রয়েছে নানা জাতের দুর্লভ এবং বিরল বন্যপ্রাণীর বাস। এমনও বন্যপ্রাণী এখানে রয়েছে যারা সমতল এলাকা থেকে একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বন্যপ্রাণী বিশারদ, পর্যবেক্ষক এবং সংরক্ষণবাদী কিছু মানুষের কার্যক্রমে মাঝে মাঝে অবাক করা সব তথ্য বেরিয়ে আসে।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষক শাহরিয়ার সিজার রহমান দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণ করে আসছেন। দেশের প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়া নানা জাতের কচ্ছপদের আবার প্রকৃতির বুকে ফিরিয়ে আনার জন্য নানা ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন তিনি। এই বন্যপ্রাণী অন্তঃপ্রাণ নিভৃতচারী মানুষটি দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিকারীদের শিকারের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করতে নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। বাংলাদেশে অজগরের দেহে ট্রান্সমিটার বসিয়ে বন্যপ্রাণীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণের প্রথম নমুনাটি তিনি স্থাপন করেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীনে পেতে রাখা সিজারের ক্যামেরা ট্র্যাপে ধরা পড়ে গাউর বা ইন্ডিয়ান বাইসনের ছবি। ধারণা করা হয়েছিল গাউর পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সিজারের পেতে রাখা ক্যামেরার ফাঁদে আরও ধরা পড়েছে চিতাবাঘ, এশিয়ান কালো ভাল্লুক, সান বিয়ার, বনছাগল, রাম কুত্তা (বন্য কুকুর), মেঘলা চিতা, সোনালি বিড়াল (গোল্ডেন ক্যাট), মর্মর বিড়ালসহ (মার্বেল ক্যাট) নানা জাতের বন্যপ্রাণী।

এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চল জুড়ে রয়েছে নানা জাতের পাখি স্তন্যপায়ী আর সরীসৃপের বাস। একসময় এ অঞ্চলটাকে বলা হতো সাপের স্বর্গভূমি। সমতল থেকে বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন এখানে ছুটে আসত সাপ ক্রয় এবং সংগ্রহের জন্য। তাছাড়া ধারণা করা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি বিশেষ অঞ্চলে এখনও রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব রয়েছে, কোনো একদিন হয়তো সেই সুখবর মিলবে।

এই পার্বত্য চট্টগ্রামেই আজও পৃথিবীর বৃহত্তম বিষধর সাপ কিং কোবরার (রাজগোখরা/শঙ্খচূড়) বাস। খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান—এই তিন পার্বত্য জেলার বিভিন্ন স্থানে এদের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। এই বিশেষ সরীসৃপটি নানা কারণে সাপের জগতে কিংবদন্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। তার এক ছোবলে কয়েক টন ওজনের একটা হাতি পর্যন্ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে বাধ্য। তবে এরা কোণঠাসা বা আক্রমণের শিকার না হলে কাউকে ছোবল দেয় না। এমনকি দেশে কিং কোবরা দ্বারা মানুষের আক্রান্ত হওয়ার খবর কিংবা রেকর্ড তেমন একটা নেই। এরা বিশেষ খাদ্যাভাসসম্পন্ন সরীসৃপ, যাদের প্রধান খাদ্য হচ্ছে অন্য সাপ। তবে গুইসাপ খেতেও এরা পছন্দ করে।

সারা দুনিয়ার সাপের ভুবনে একমাত্র এরাই নিজেরা নিজেদের বাসা তৈরি করে ডিম পাড়ে। এদের আরও একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রজনন মৌসুমে কোনো এক রহস্যময় কারণে এক কিং কোবরা অন্য কিং কোবরাকে গিলে খায়। সত্যি এ এক আশ্চর্য সাপ। একটি পূর্ণবয়স্ক কিং কোবরা সর্বোচ্চ সাড়ে ১৮ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। সুন্দরবন, সিলেটসহ দেশের অন্য কিছু স্থানেও এদের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়।

বুনো মুরং আর কিংবদন্তির কিং কোবরা, পাহাড়ি অন্যের এই দুই মহামূল্যবান সম্পদের প্রতি আমার ব্যাপক আগ্রহ, কৌতূহল, আর ভালোবাসা রয়েছে। কিন্তু কিছুকাল আগের একটি ঘটনা আমাকে খুবই ভাবিয়ে তুলেছে। গত ৭ আগস্ট ২০২২ সকালে বান্দরবানের থানচি সড়ক ধরে নীলগিরির দিকে যাচ্ছিলাম। আমাদের গাড়িটি তখন থানচি রোডের চিম্বুক ও নীলগিরির মাঝামাঝি স্থান দিয়ে যাচ্ছিল। স্থানীয় একটি বাজার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ আমার দৃষ্টি আটকে যায় বামদিকের পাহাড়ি ঢালে। একদল মানুষ বিশাল আকারের একটি সাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে মনে হচ্ছিল অজগর। ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললাম, তারপর রাস্তা থেকে নেমে এগিয়ে গেলাম সেদিকে। তবে আমার উপস্থিতি ওদের মোটেও পছন্দ হলো না। আসলে না হওয়ারই কথা, ওরা যে মুরং। আর এদের বিষয়ে আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। আর ওদের সাথে কীভাবে মিলতে হয় সেটাও জানা আছে। তবে সদ্য শিকার করে আসা মানুষগুলো কেন যেন আমাকে মেনে নিতে পারছিল না। আসলে হঠাৎ অচেনা কোনো লোকের সঙ্গে ওরা এমনিতেও কথা বলতে চায় না।

পূর্বের অভিজ্ঞতা খাটিয়ে ওদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটালাম। আমার কিছু প্রশ্নের উত্তরও দিল তারা। জানাল, মৃত কিং কোবরাটাকে পাহাড় থেকে শিকার করে এনেছে। বুনো মুরংদের হাতে এই কিংবদন্তির মৃত্যু আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারলাম না। নানা রকম প্রশ্নে ওরা ক্রমেই আমার প্রতি সন্দিহান হয়ে উঠল। তাই দেরি না করে ধীর পায়ে হেঁটে গাড়ির দিকে রওনা দিলাম।

আসলে বন্যপ্রাণীরা পাহাড় কিংবা সমতল কোথাও ভালো নেই। আর এ জন্য নির্দিষ্ট কোনো গোত্র কিংবা কোনো সম্প্রদায় দায়ী নয়। দায়ী হচ্ছে মানুষ।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের অনেকেই কমবেশি বন্যপ্রাণী শিকারের সঙ্গে জড়িত। অনেকে বলতে পারেন, ওরা জঙ্গলের মানুষ, শিকার তো করবেই। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। শিকার নয়, বন্যপ্রাণীদের সংরক্ষণ এবং এদের সুরক্ষা এখন অনেক বেশি জরুরি। সূত্র: টিবিএস

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: বন্যপ্রাণী, বান্দরবান, সর্পভুক
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন