মো: আল আমিন:
রাঙামাটিতে বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন নিয়ে পক্ষ বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে দুটি গ্রুপ। সর্বদলীয় ছাত্র সমাজ এবং রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন কমিটি উচ্চ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার জন্য এর পক্ষে অবস্থান নিলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সমর্থিত নাগরিক আন্দোলন এর বিরোধীতা করে আন্দোলন কর্মসুচীর হুমকী দিয়েছে। এদিকে আজ ২ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার রাঙামাটিতে মেডিকেল কলেজ ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন কমিটি রাঙামাটিতে দ্রুত বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে। এ নিয়ে শুরুতে বাঙালী সংগঠনগুলোর মধ্যে কিছুটা বিভেদ থাকলেও বর্তমানে তা কেটে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই সমাবেশে কিছু পাহাড়ীও অংশ নেবে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সনে ক্ষমতা থাকাকালীন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে উচ্চ শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ৩ পার্বত্য জেলার মধ্যে রাঙামাটিতে বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। সে সময় কখনো পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, কখনো পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সরকারের কাছে প্রবল আপত্তি করলে এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ স্থাপনের কাজ ঝিমিয়ে পড়ে। পরবর্তিতে ২০০১ সনে বিএনপি জামাত জোট ক্ষমতায় আসলে তারা প্রকল্প দুটি অন্যত্র সরিয়ে নেয়। আওয়ামীলীগ পুনরায় ২০০৯ সনে ক্ষমতায় আসলে বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থানের সিদ্ধান্ত নেয়। দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রথমে ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গা দেখা হলেও পরে পার্বত্য জনসংহতি সমিতির আপত্তির কারণে এগুলোর জন্য সরকারী মালিকানাধীন জায়গায় দেখা হয়। এই সরকার আগের
মেয়াদে ক্ষমতা থাকাকালীন ২০১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা দেখার জন্য সরকারের মন্ত্রী ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রস্তাবিত জায়গা পরিদর্শন করেন।
সেপ্টেম্বর রাঙামাটি শহরের বনরুপা এলাকায় মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে।
পক্ষের ব্যাপার। চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল কলেজ করতে দেয়া হবে না এমন বক্তব্য আমরা সমর্থন করিনা। শিক্ষার সুফল চুক্তির পক্ষ বিপক্ষ সবাই পাবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সম অধিকার আন্দোলন একাংশের নেতা পেয়ার আহম্মদ খান বলেছেন, কেন সুশীল সমাজের একটি অংশ এর বিরোধীতা করছে আমরা জানি না। তবে আমার মনে হয় এলাকার লোকজন শিক্ষিত হলে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি কমে যাবে তাই তারা এর বিরোধীতাই নেমেছে। আমরা চাই দ্রুত দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করা হোক ।
এবং জুম্মদের অধিকার ও অস্তিত্বকে বিপন্ন করে ও পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে অনিশ্চিত রেখে রাঙামাটিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এটা সরকারের চরম অগণতান্ত্রিক, জনবিরোধী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরিপন্থী মানসিকতার প্রতিফলন। পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান ২১ আগষ্ট জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে নাগরিক পরিষদ আয়োজিত সমাবেশে বলেন, সরকার যদি পাহাড়ের বঞ্চিত গণ-মানুষের কথা উপেক্ষা করে একক কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চায় তাহলে পাহাড়ে আগুন জ্বলবে। তিনি বলেন, অতীতে আমাদের কোনো মতামত না নিয়ে সরকার কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে হাজার হাজার জুম্ম জনগণকে ভূমিচ্যুত করেছে। তাই পাহাড়ে যে কোনো উন্নয়নে সরকারকে পার্বত্য এলাকার অধিবাসীদের মতামত নেয়ার আহ্বান জানান গৌতম দেওয়ান। গৌতম দেওয়ান আরো বলেন, আমাদের শিক্ষা দরকার। উচ্চ শিক্ষা আরও বেশি প্রয়োজন। এদিক থেকে চিন্তা করলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা দরকার। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে যে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চলেছে- বিশেষ করে বর্তমান বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে তা পাহাড়ি জনগণের জন্য কতটুকু উপকারে আসবে- তা পর্যালোচনার দাবি রাখে। কারণ, আমাদের অভিজ্ঞতা হল- সরকারের অতীতের উন্নয়ন প্রকল্প বা বিভিন্ন ভাল ভাল উদ্যোগ পাহাড়িদের উপকারে আসেনি। সরকারের অতীতের কার্যকলাপ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য পরিলক্ষিত হয় না। দ্বিতীয় যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হল রাঙামাটিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হলে সেগুলোতে ভর্তির যোগ্যতা সম্পন্ন পাহাড়ি ছাত্রছাত্রী খুব বেশি পাওয়া যাবে না। বাস্তবে দেখা যায় যে, বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পাহাড়ি কোটা রয়েছে সেসব কোটার আসন এখনও খালি থেকে যায়। যোগ্যতার অভাবে অথবা প্রয়োজনীয় নম্বর না পাওয়ার কারণে পাহাড়ি ছাত্রছাত্রীদের পাহাড়ি কোটার আসনগুলো পূরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এর অন্যতম কারণ হল পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মানসম্মত শিক্ষার অভাব। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা না গেলে পাহাড়ি ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে না। সে কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠা না করে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হলে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুফল পাহাড়িরা পাবে না। উল্টো তা পাহাড়িদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এখানে বহিরাগতদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। বিষয়টি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সহ তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা বলেছেন,
তারা নীতিগতভাবে রাঙামাটিতে বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের বিপক্ষে নয়, তবে এর আগে চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। এরপর পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে আলোচনাক্রমে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পগুলো গ্রহণ করা হোক। তবে রাঙামাটির একাধিক সূত্র নাম প্রকাশ না করে পার্বত্যনিউজকে বলেন, দুইটি কারণে উপজাতি নেতাদের একাংশ এই উচ্চ শিক্ষার বিরোধিতা করছে। প্রথমত: তারা মনে করে এর ফলে পাহাড়ে সমতলের লোকদের অনুপ্রবেশ বাড়বে। দ্বিতীয়তঃ তারা চায় না পাহাড়ের সাধারণ উপজাতিরা শিক্ষিত হোক। কারণ শিক্ষিত উপজাতিদের একটি অংশ সাধারণ উপজাতিদের পশ্চাৎপদতার সুযোগ নিয়ে অস্ত্রের জোর দেখিয়ে তাদের শোষণ ও নির্যাতন করে, তাদের মত সাধারণ উপজাতিদের উপর চাপিয়ে দেয়। তাদের বিভ্রান্ত করে বিপথে পরিচালিত করে। কাজেই সাধারণ উপজাতিরা শিক্ষিত ও সচেতন হয়ে গেলে এই শ্রেণীর নেতাদের আসল চেহারা উন্মোচিত হয়ে যাবে। তাই তারা এই বিরোধিতা করছে। এদিকে মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে বিপক্ষে নানা কর্মসুচীতে রাঙামাটি এখন সরগরম হয়ে উঠছে। মঙ্গলবার রাঙামাটি বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ বাস্তবায়ন সংগ্রাম কমিটির মহাসমাবেশের আহবায়ক জাহাঙ্গীর আলম মুন্না জানিয়েছেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা বাসস্থান আমাদের মৌলিক অধিকার। আমরা এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে চাই না। তাই বিভিন্ন আঞ্চলিক দল ও রাজনৈতিক দল নিয়ে পাহাড়ী বাঙ্গালীর সমন্বয়ে আমরা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেছি আজ আমরা মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছি। যারা এর বিরোধীতা করছে আমরা তাদের চিহিৃত করতে চাই। তবে রাজনীতিতে যাই-ই ঘটুক না কেন পাহাড়ের মানুষ যেন উচ্চ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত না হয় এই এলাকার সন্তানেরা যেন উচ্চ শিক্ষা পায় সেদিকে লক্ষ্য করে সবাই কাজ করবে এমনটা প্রত্যাশা সাধারন মানুষের। এ বিষয়ক আরো প্রবন্ধ: