বিটিআরসি’র পরিদর্শনে স্টারলিংকের কার্যক্রমে নানা অসংগতি


বাংলাদেশে স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান স্টারলিংকের কার্যক্রমে একাধিক অসংগতি, কারিগরি ত্রুটি ও তথ্য ঘাটতি চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।
কমিশনের পরিদর্শনে প্রতিষ্ঠানের অফিসে কোনো দাপ্তরিক কার্যক্রমের অস্তিত্ব মেলেনি। মনিটরিং টুল সঠিকভাবে কাজ করছে না এবং বিদেশি গ্রাহকদের সেবা প্রদানে গাইডলাইন অনুসরণ না করার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিটিআরসির কমিশন সভা সূত্রে এসব তথ্য তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দৈনিক কালবেলা।
২ নভেম্বর রোববার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে প্রতিবেদক শেখ হারুন উল্লেখ করেন যে, গত ২৭ অক্টোবর বিটিআরসির ৩০০তম কমিশন সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় স্টারলিংকের অপারেশনাল কার্যক্রম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ওই সভায় স্টারলিংকের অফিস কার্যক্রম, গ্রাহক সংখ্যা, ডেটা ট্রাফিক ও মনিটরিং ব্যবস্থা এবং দেশি-বিদেশি গ্রাহকদের সেবা প্রদানে অস্পষ্টতা ও অসংগতির বিষয় উঠে আসে।
অফিসে নেই কার্যক্রম, গেটওয়ে সীমিত
বাংলাদেশে স্টারলিংকের নিবন্ধিত অফিস কার্যত অচল পেয়েছে বিটিআরসি। গত ৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ইউটিসি ভবনে প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধিত অফিস সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে কোনো দাপ্তরিক কার্যক্রম দেখতে পায়নি বিটিআরসি। প্রতিনিধিদলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্টারলিংকের অফিসে দাপ্তরিক, প্রশাসনিক বা অপারেশনাল কোনো কার্যক্রম কিংবা কোনো ধরনের কারিগরি স্থাপনা পরিলক্ষিত হয়নি। অর্থাৎ অফিস থাকলেও সেখানে কোনো কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে না।
এদিকে, কাঙ্ক্ষিত গেটওয়েও স্থাপন করতে পারেনি স্টারলিংক। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে গেটওয়ে স্থাপন ও কার্যক্রমের বিষয়ে বিটিআরসিকে জানিয়েছে, তারা গত ৮ আগস্ট থেকে প্রাথমিকভাবে অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত গাজীপুরের কালিয়াকৈর (দুটি) এবং যশোর ও রাজশাহীতে গেটওয়ে স্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি সৈয়দপুর, কক্সবাজার, সিলেট ও কুমিল্লায় নতুন গেটওয়ে স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
অবশ্য গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন হলেও এর কার্যকারিতা নিশ্চিত নয় নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসি। গত ১৩ ও ১৬ আগস্ট স্টারলিংকের অবকাঠামো যাচাইয়ের জন্য পরিদর্শনে যায় বিটিআরসির প্রতিনিধিদল। পরিদর্শনের সময় স্টারলিংকের কোনো প্রতিনিধি না থাকায় গেটওয়েগুলো পুরোপুরি কার্যকর কি না, তা নিশ্চিত হতে পারেনি বিটিআরসি। এ ছাড়া স্টারলিংক বাংলাদেশে স্থাপিত গেটওয়ে কিংবা অন্য দেশের গেটওয়ে ব্যবহার করে তাদের ট্রাফিক সঞ্চালন করছে কি না তাও স্পষ্ট নয়, আইন মেনে তথ্য আদান-প্রদানের বিষয়টিও নিশ্চিত হতে পারেনি বিটিআরসি।
গ্রাহক সংখ্যা ১ হাজার ৮৬২
গত ২০ মে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করলেও গ্রাহকদের কাছে খুব বেশি সাড়া ফেলতে পারেনি স্টারলিংক। বিটিআরসিতে জমা দেওয়া স্টারলিংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্টারলিংকের মোট গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮৬২। এর মধ্যে ১ হাজার ২৫১ রেসিডেনশিয়াল, ৪৯৫টি রেসিডেনশিয়াল লাইট, ৫৮টি মোবাইল (রেসিডেনশিয়াল), ১১টি প্রিমিয়াম বিজনেস মোবাইল, ২০টি প্রিমিয়াম বিজনেস, ১টি প্রিমিয়াম রেসিডেনশিয়াল, ২০টি এন্টারপ্রাইজ এবং ৬টি টেস্টার গ্রাহক রয়েছে।
বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি তাদের ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার জন্য আইআইজি অপারেটরদের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত ৮০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ নিয়েছে। এর মধ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে মাত্র ৩০ জিবিপিএস। এ ছাড়া তাদের পপের ব্যাকবোন ক্যাপাসিটি ২০০ জিবিপিএস এবং গেটওয়ে ও পপের ব্যাকবোন বা ব্যাকহল ক্যাপাসিটি ৪০০ জিবিপিএস।
কাজ করছে না মনিটরিং টুল
লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী স্টারলিংক জাতীয় টেলিযোগাযোগ মনিটরিং সেন্টারকে (এনটিএমসি) একটি ‘কমপ্লায়েন্স এপিআই টুল’ সরবরাহ করেছে। তবে এই টুল আশানুরূপভাবে কাজ করছে না। ফলে এনটিএমসি তাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারছে না। এনটিএমসি ও বিটিআরসি এ বিষয়ে যৌথভাবে বৈঠক করেছে। তবে এখনো মনিটরিং টুলটি কার্যকরভাবে কাজ করছে না।
কমিশন সভা সূত্রে জানা গেছে, গত ৭ অক্টোবর স্টারলিংককে ল’ফুল ইন্টারসেপশন কমপ্লায়েন্স (এলআই কমপ্লায়েন্স) সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য জানতে চিঠি দেয় বিটিআরসি। জবাবে স্টারলিংক জানায়, লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি এনটিএমসিকে কমপ্লায়েন্স এপিআই সংক্রান্ত টুল সরবরাহ করেছে, যদিও এনটিএমসি ওই টুল পেলেও আশানুরূপভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। তবে উভয়পক্ষ এ বিষয়ে নিয়মিত আলোচনা অব্যাহত রেখেছে মর্মে অবহিত করেছে।
ইন্টারনেট খাতে এলআই কমপ্লায়েন্স বলতে বোঝায়—এমন একটি প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা আইনগত অনুমতি নিয়ে কোনো ব্যবহারকারীর ইন্টারনেট যোগাযোগ বা ডেটা পর্যবেক্ষণ করতে পারে। এ ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হলো জাতীয় নিরাপত্তা, অপরাধ তদন্ত ও সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে আইনসম্মত উপায়ে তথ্য সংগ্রহের সুযোগ নিশ্চিত করা। লাইসেন্স প্রদানের সময়ে এলআই কমপ্লায়েন্সকে বাধ্যতামূলক শর্ত হিসেবে বিবেচনা করে বিটিআরসি।
এদিকে, একই তারিখে লাইসেন্সের ক্লজ-৫ অনুযায়ী বাংলাদেশে অবস্থিত সব গ্রাহককে স্টারলিংক স্থাপিত আর্থ স্টেশন এবং দেশীয় আইআইজি অপারেটরের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করা ও মনিটরিংয়ের জন্য যথোপযুক্ত টুলস সরবরাহের জন্য অনুরোধ করা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে স্টারলিংকের পক্ষ থেকে অবহিত করা হয়, তারা বিটিআরসিকে এনটিএমসির মতো একই ‘কমপ্লায়েন্স এপিআই টুলস’ সরবরাহ করতে পারে। এনটিএমসি জানায়, ‘কমপ্লায়েন্স এপিআই টুলস’ থেকে তারা তাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারছে না।
স্টারলিংকের উত্তর এবং এনটিএমসি কর্তৃক ‘কমপ্লায়েন্স এপিআই টুলস’-এর কারিগরি জটিলতা সম্পর্কে পর্যালোচনার জন্য গত ২১ অক্টোবর বিটিআরসি এবং এনটিএমসির মধ্যে মতবিনিময় সভা হয়। স্টারলিংক কর্তৃক প্রদত্ত এপিআই থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এনটিএমসি এবং কমিশন যে উদ্দেশ্যে মনিটরিং টুলস চেয়েছে, তা পূরণ হচ্ছে না মর্মে প্রতীয়মান হয়। এনটিএমসি প্রতিনিধি জানান, ‘কমপ্লায়েন্স এপিআই টুল’ থেকে তারা তাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারছে না।
একই সঙ্গে আরও একটি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কমিশনের সভা সূত্রে জানা গেছে, স্টারলিংকের বিদেশি (রোমিং) গ্রাহকরা যখন বাংলাদেশে অবস্থান করেন, তখন তাদের ইন্টারনেট সেবা দেশের ভেতরে স্থাপিত গ্রাউন্ড স্টেশন ও পপের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে কি না—তা নিশ্চিত নয়। স্টারলিংক এ বিষয়ে এখনো স্পষ্ট তথ্য দেয়নি। তবে এ বিষয়ে স্টারলিংক থেকে স্পষ্ট উত্তর জানতে চায় বিটিআরসি।
আইপিএলসি ও আনফিল্টারড ট্রানজিট নিয়ে অনিশ্চয়তা
স্টারলিংক বাণিজ্যিকভাবে আইপিএলসি (আন্তর্জাতিক প্রাইভেট লিজ সার্কিট) ব্যবহার এবং বিদেশি গ্রাহককে সেবা প্রদানের জন্য আনফিল্টারড আইপি ট্রানজিট সংযোগের অনুমতি চেয়েছে। তবে বিটিআরসি বলেছে, এই সেবা তাদের লাইসেন্স ও গাইডলাইনে অন্তর্ভুক্ত নয়। প্রতিষ্ঠানটি গত ১৪ অক্টোবর বিটিআরসিকে একটি কারিগরি পরিকল্পনা জমা দেয়, যেখানে দেশীয় ও বিদেশি গ্রাহকদের ডেটা ট্রাফিক পৃথক্করণের প্রক্রিয়া দেখানো হয়েছে।
তবে কমিশন মনে করছে, বিষয়টি নিয়ে আরও বিশদ কারিগরি ও নিয়ন্ত্রক পর্যায়ে পর্যালোচনার প্রয়োজন। কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এসব আইপিএলসি এবং আনফিল্টারড আইপি ব্যবহারের মাধ্যমে কোনো বাংলাদেশি গ্রাহককে সরাসরি সেবা দেওয়া হবে না। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানকে কারিগরিভাবে দেখাতে হবে, কীভাবে তারা বিদেশি ও দেশীয় গ্রাহকের ডেটা আলাদা রাখবে এবং পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করবে।
কমিশন সভার সিদ্ধান্ত
বিটিআরসির কমিশন সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, স্টারলিংককে তাদের সব গ্রাউন্ড স্টেশনের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কমিশনকে জানাতে হবে, বিদেশি রোমিং গ্রাহকদের সেবা দেওয়ার পদ্ধতি স্পষ্ট করতে হবে এবং বাংলাদেশি ও বিদেশি গ্রাহকের ডেটা আলাদা রাখার জন্য মনিটরিং টুলসের মাধ্যমে ট্রাফিক পৃথক্করণ যাচাইয়ের ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে বিটিআরসির সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবং সংস্থাটির চেয়ারম্যানের সরকারি ফোন নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগ করেও সাড়া মেলেনি। তবে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা প্রতিবেদককে বলেন, স্টারলিংকের সেবা এবং কার্যক্রমে বেশ কিছু অসংগতি এবং অস্পষ্টতা রয়েছে। এসব বিষয়ে কমিশন সভায় আলোচনা হয়েছে এবং সেগুলোর বিষয়ে স্টারলিংকের কাছ থেকে স্পষ্টীকরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লাইসেন্সপ্রাপ্ত একটি প্রতিষ্ঠানের দপ্তরে কার্যক্রম না থাকলে যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং করা সম্ভব হয় না। স্যাটেলাইট ইন্টারনেট বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তবে তা যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায়। স্টারলিংক দেশের প্রযুক্তি খাতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তাদেরও স্থানীয় আইন, সাইবার নিরাপত্তা এবং তথ্য-সার্বভৌমত্বের শর্ত মেনে চলতে হবে। আর বিটিআরসির দায়িত্ব হবে—প্রযুক্তি ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে জনগণের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া।
ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি মোহাম্মদ আমিনুল হাকিম বলেন, বিটিআরসি স্টারলিংকের ক্ষেত্রে যেসব অসামঞ্জস্য পেয়েছে, তার সব কিন্তু দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো মেনে চলে। সরকার যেহেতু তাদের ব্যবসা করার লাইসেন্স দিয়েছে, লাইসেন্সের শর্ত মেনেই তাদের ব্যবসা করতে হবে। তিনি বলেন, দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর কমপ্লায়েন্স না মানলে জরিমানা করা হয়, সুতরাং বিটিআরসির উচিত কমপ্লায়েন্স না মানলে স্টারলিংকের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া, কারণ এখানে জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু রয়েছে।
















