parbattanews

বুকে আগলেও রক্ষা করতে পারিনি ৭ মাসের সন্তানকে

DSC04249
কক্সবাজার প্রতিনিধি :
‘সেই রাতের ঘটনা মনে পড়লে আজও চমকে উঠি। আমার প্রাণপ্রিয় সন্তানদের থাপড়ে নিয়ে গিয়েছিল ভয়ঙ্কর ঢেউ। বুকে আগলে ধরেও রক্ষা করতে পারিনি ৭ মাসের দুগ্ধ সন্তানকে। শুধু সন্তান নয়। আামর চোখের সামনেই ভেসে গেছে টগবগে দেবর-ননদ। ভেসে গেছে শ্বশুর-শাশুড়ি। ঢেউয়ের তোড়ে স্বামীর হাত কখন ছুটে গেছে মনে নেই। আজও ভয় লাগে সেই স্মৃতি মনে পড়লে। কষ্ট লাগে বুকে। এসব কথা বলছিলেন, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলে ঘূর্ণিঝড়ে স্বজনহারা আমেনা বেগম (৪৫)। তিনি কুতুবদিয়া’র কোজ্জার ডেইল এলাকার মো. ইদ্রিসের স্ত্রী। ঘূর্ণিঝড়ের ৪ বছর পর থেকে তারা অবস্থান করছেন শহরের কুতুবদিয়া পাড়ায়।

দীর্ঘ ২৫ বছর পরে সেই রাতের ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে আমেনা বলেন, ২৯ এপ্রিল বিকালে রেডিওতে শুনতে পাই ১০নং মহাবিপদ সংকেত। চারদিকে বয়ছিল প্রচন্ড বাতাস। সমুদ্র পাড়ের ঘর হওয়ায় ভয় লাগলেও ঘর ছেড়ে যেতে চাইছিলেন না পরিবারের লোকজন। ঘর ছেড়ে যাব কি যাব না এই সিন্ধান্ত নিতে রাত হয়ে যায়। ভেবেছিলাম হয়ত বড় কোন সমস্যা হবেনা। একটু পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। রাত ১১ টা কি ১২ টার দিকে। বাতাসের মাত্রা প্রচন্ডভাবে বেড়ে গেছে। লন্ড-ভন্ড হয়ে যাচ্ছিল সবকিছু। এসব দেখতে দেখতে ঘরের ভিতর ঢুকে যায় পানি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই পানি হাটু থেকে কোমর পর্যন্ত হয়ে গেল। সবাই যে-ই ঘর থেকে বেরিয়ে যাব তখনই অন্ধকারে থাকা অল্প আলোতে দেখা যাচ্ছিল উত্তাল ঢেউ ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। সবকিছু বাদ দিয়ে ২ সন্তান শাহেদুল্লা (৩) ও ৭ মাসের আসাদুল্লাকে বুকে আগলে রাখি।

প্রচন্ড ঢেউয়ের তোড়ে প্রথমে হাত থেকে ছুটে যায় বড় সন্তান শাহেদুল্লা। তাকে বাঁচাতে গিয়ে ভেসে যায় ১৫ বছরের ননদ। দূরে দেখতে পাই পরিবারের লোকজনের কাছে আসার চেষ্টার করা যুবক দেবরকে ভেসে যেতে। যতটুকু মনে আছে এর মধ্যে আমার হাত ধরেছিল স্বামী ইদ্রিস। তাকেও আর দেখছিলাম না। বুঝতে পারিনি কখন তার হাত থেকে বেরিয়ে গেছে। আর দেখছিলাম বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়িকে ভেসে যেতে। শক্তভাবে বুকে আগলে রেখেছিলাম ৭ মাসের সন্তানটাকে। পরের ঢেউয়ের প্রচন্ড আঘাতে পানির ভিতর তলিয়ে গেলাম আমি। আমার দুগ্ধ সন্তানটি আর বুকে নেই। তাকেও নিয়ে গেছে। পানির তোলপাড়ে কোথায় কি হচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না।এটুকু মনে আছে দম পাচ্ছিলাম না। আর শুধু এদিকে সেদিক ধাক্কা খাচ্ছিলাম। এরপর ওই রাতের আর কিছুই মনে নেই। হয়ত অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।

সকাল হল। বুঝতে পারলাম আমি গাছের ডালে। পরনের কাপড়-চোপড়ও ভাল অবস্থায় নেই। পরে একটি পলিথিন জড়াই গায়ে। চারপাশে দেখতে পেলাম লাশ আর লাশ। পানিতে লোকজন ছুটাছুটি করছে এদিক-ওদিক। কোনভাবে নিচে নামলাম। আর লোকজনের কাছে জানতে চাইলাম আমি কোন দেশে এসেছি। জানতে পারি আমি কুতুবদিয়ার বড়ঘোপ এলাকায় আছি। হাঁটতে থাকি উদ্দেশ্যহীনভাবে। ঠান্ডায় হাত-পা চলছিল না। আর যতটুকু পারি শিশুদের লাশ উল্টিয়ে উল্টিয়ে দেখতে থাকি আমার কলিজার টুকুরোগুলোকে পাই কিনা। সবাইকে হারিয়ে আল্লাহ কেন আমায় বাঁচিয়ে রাখল এমনই ভেবে নিজেকে খুবই অসহায় লাগছিল। আর অন্য দশজনের মতো আমিও পানিতে দিক-বেদিক হাঁটছিলাম। দীর্ঘ ৩ কিমিটারের পাড়ি দিয়ে দেখতে পাই আমার স্বামীকে। সেও আমার মতো মরিয়া হয়ে খুঁজছিল স্বজনদের। তাকে পেয়ে বুকে আগলে ধরি। ফিরে পাই নতুন এক জীবন। দুই জনেই খুঁজতে থাকি অন্যান্যদের। সবাইকে খুঁজে পাই, কিন্তু জীবিত নয় মতৃ অবস্থায়। সেই ঘটনা মনে পড়লে বুক ফেটে যায়। মন চায় চিৎকার করে কান্না করি।

এই ভয়ংকর ঘটনার ৪ বছর পর আমেনা ও তার স্বামী শহরের কুতুবদিয়া পাড়ায় চলে আসে আর ওখানে জায়গা কিনে ঘর বেঁধেছেন। তারা সুখে আছেন। তাদেও সংবারে আরো ৪ টি সন্তান জন্ম নিয়েছে। আজও সেই ভয়ংকর রাতটি তাদের কাপিয়ে তুলে।

Exit mobile version