parbattanews

বৃটিশ শাসনামলে নলখাগড়া ও সিমেন্টের প্রলেপে নির্মিত ১০ শয্যার দীঘিনালা হাসপাতাল এখন নিজেই রোগী

Khagrachari Pic 01 (6) copy

নিজস্ব প্রতিবেদক, খাগড়াছড়ি:

শত বছর আগে বৃটিশ শাসনামলে নলখাগড়া ও সিমেন্টের প্রলেপে টিন সেটে নির্মিত ১০শয্যার দীঘিনালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি চিকিৎসক সংকট এবং রোগী ও চিকিৎসকদের আবাসন সংকটসহ নানা সমস্যায় এখন নিজেই অসুস্থ। হাসপাতালে পর্যাপ্ত ডাক্তার না থাকায় রোগীরা চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক্স-রে মেশিন কক্ষবন্দি হয়ে আছে এক যুগের বেশি সময় ধরে।

হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা তেমন কোন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। ফলে চিকিৎসার অনুকূল পরিবেশ না থাকায় পেট ব্যথার রোগীকেও ছুটতে হয় খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে। জরাজীর্ণ ভবনে নেই টয়লেটের ব্যবস্থা। রোগীদের হাসপাতালের বাইরে গিয়ে টয়লেটের কাজ সারতে হয়। অথচ এ হাসপাতালের উপর নির্ভর করতে হয়  প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষাধিক মানুষকে।

বাংলাদেশ স্বাধীনের পর বিভিন্ন সরকারের মেয়াদে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির আধুনিকায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করলেও ভূমি অধিগ্রহণ সমস্যার বেঁড়া জালে আটকে আছে এর কার্যক্রম। ফলে চরম দুর্ভোগে দীঘিনালা উপজেলাসহ রাঙামাটির বাঘাইছড়ি-সাজেক ও লংগদু উপজেলার তিন লক্ষাধিক বাসিন্দা।

১০শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক থেকে শুরু করে সবকয়টি পদে শুন্য পদ বিদ্যমান। ১৪জন চিকিৎসকের অনুকূলে বর্তমানে কর্মরত আছেন ৪জন। আবাসিক চিকিৎসকের পদটিও শুন্য দীর্ঘ সময় ধরে। তত্ত্বাবধায়ক না থাকায় অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিস করেন যে যার ইচ্ছে মাফিক এমন অভিযোগ রয়েছে।

সরেজমিনে, শনিবার  সকাল ১০টায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাক্তার নুরুল আনোয়ার দায়িত্ব পালন করছেন। তার সাথে কাজ করছেন কয়েকজন সহকারী স্টাফ।  বাকী চিকিৎসকরা অনুপস্থিত। হাসপাতালে রোগীর চাপ থাকায় তিনি একা হিমশিম খাচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীঘিনালা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রেজাউর রহমান খান ছুটিতে আছেন। অন্যরা কোথায় গেছেন, বলতে পারছেন না কেউ। হাসপাতালের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সকাল ৮টার মধ্যে কর্মস্থলে উপস্থিত হওয়ার কথা।

হাসপাতালে একটি উন্নতমানের এক্স-রে মেশিনসহ অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি দেয়া হলেও দীঘিনালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সে সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। বিদ্যুৎ নেই ও লো ভোল্টেজ এমন অজুহাতে এক্সে-রে মেশিনটি প্রায় এক যুগ ধরে কক্ষ ও বক্সবন্দি হয়ে আছে। ফলে রোগিদের বেসরকারি ডায়াগনেস্টিক সেন্টারে গিয়ে এক্স-রে ও অন্যান্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হচ্ছে। এক্স-রে মেশিনের সন্ধান করতে গিয়ে দেখাগেল কক্ষে তালা ঝুলছে। কক্ষের দরজাও নষ্ট হয়ে গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৪ সালে দীঘিনালা হাসপাতালে একটি উন্নতমানের এক্স-রে মেশিন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে দীঘিনালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু যন্ত্রটি বসানোর জায়গা না থাকার অজুহাতে প্রায় ৮ বছর বক্সবন্দি করে ফেলে রাখা হয়।

অবশেষে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নতুন কক্ষ নির্মিত হলে ২০১২ বক্সবন্দি দশা থেকে মুক্ত হয়েছে এক্স-রে যন্ত্রটিও। তবে বক্সবন্দি দশা থেকে এক্স-রে যন্ত্রটি এখন কক্ষবন্দি হয়ে আছে। ফলে ১৩ বছরেও এক্স-রে যন্ত্রটি একবারের জন্যও রোগ নির্ণয়ের কাজে লাগেনি। এটি কবে নাগাদ চালু করা হবে, তাও বলতে পারেননি স্বাস্থ্য দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা।

দীঘিনালা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান  নব কমল চাকমা জানান, ১৯২৪ সালে বৃটিশ শাসনামলে নলখাগড়া ও সিমেন্টের প্রলেপে ১০ শয্যার  দীঘিনালা কমপ্লেক্সেটি নির্মিত হয়। এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের  উপর শুধু এ উপজেলার বাসিন্দারা নায়, পার্শ্ববর্তী রাঙামাটি জেলার সাজেক, বাঘাইহাট ও লংগদু উপজেলার মানুষও চিকিৎসা নিতে আসে।

তিনি আরো জানান, দীঘিনালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৫০ শয্যায় উন্নতিকরণ ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের দাবিতে মিছিল, মানববন্ধন ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্বারকলিপি প্রদান থেকে বহুমহলে দেন-দরবার করেছি। কিন্ত কোন ফল না পেয়ে দীঘিনালা বাসির মতো আমিও হতাশ। তিনি জানান, অবকাঠামোর পাশাপাশি দীঘিনালা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সংকট ও চিকিৎসকদের আবাসন সংকট রয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে হাসপাতলের এক্স-রে মেশিনটি কক্ষবন্দি হয়ে আছে।

দীঘিনালা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রেজাউর রহমান খান মুঠোফোনে বলেন, এলাকার বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান না হলে এক্স-রে মেশিনটি কোনোভাবেই চালানো সম্ভব হবে না। যেখানে লো ভোল্টেজের কারণে বৈদ্যুতিক পাখাই ঘোরে না। সেখানে এক্স-রে মেশিন চলবে কি করে।

এক্স-রে কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত রেডিওলজিস্ট সোহেল চাকমা বলেন, এক্স-রে যন্ত্রটি এখন চালানোর মতো অবস্থায় রয়েছে কি না বলা মুশকিল। কারণ, যন্ত্রটি স্থাপনের পর গত একযুগে একবারের জন্য এটি চালু করা হয়নি। গত চার বছরে এক্স-রে কক্ষের দরজাও নষ্ট হয়ে গেছে। যেকোনো সময় দরজাটি ভেঙে পড়তে পারে।

দীঘিনালা প্রেস ক্লাবের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম জানান, দীঘিনালা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৫০ শয্যায় উন্নতিকরণের জন্য ১৯৯৬ সালে ভূমি অধিগ্রহণ হয়েছিল। কিন্তু ক্ষতিপূরুণ না দেওয়া সহ নানা সমস্যার বেঁড়াজালে আটকে আছে এর কার্যক্রম। তাছাড়া গত প্রায় ২১ বছরে জমির মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে।

দীঘিনালা হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট প্রকট। রয়েছে চিকিৎসকদের আবাসন সংকট। পাশাপাশি বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে চিকিৎসকরা ও মানসিকভাবে বিপর্যস্থ হচ্ছে।  হাসপাতলে জুনিয়র কন্সালটেন্ট(মেডিসিন), জুনিয়র কন্সালটেন্ট(সার্জিকেল), জুনিয়র কন্সালটেন্ট(এ্যানেস) পদগুলো দীর্ঘ দিন ধরে শূন্য রয়েছে। হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারী পদগুলো প্রায় খালি বললে চলে।

দীঘিনালা হাসপাতালে ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাক্তার নুরুল আনোয়ার জানান, হাসপাতালে ১৪জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও মাত্র ৪জন কর্মরত আছেন। ফলে জনবহুল এলাকায় চিকিৎসা সেবা দেয়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। তিনি জানান, চিকিৎসকদের আবাসনের ব্যবস্থা নেই। আবাসিক মেডিকেল অফিসারের জন্য একটি কোয়াটার থাকলেও তা ব্যবহারের অনুপোযোগী। এটি বৃষ্টি হলে ভিতরে পানি পড়ে।

খাগড়াছড়ি আসনের সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক ইচ্ছা, প্রতিটি উপজেলায় একটি করে ৫০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণে। আমি এমপি হওয়ার পর থেকে দীঘিনালা হাসপাতালকে ৫০ শয্যায় উন্নতি করার জন্য বহু জায়গায় দেন-দরবার করেছি, কথা বলেছি।

কিন্তু কোথায় আটকে আছে জানা নেই। তিনি মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা ও ইচ্ছা বাস্তবায়নে অবিলম্বে ৫০শয্যা দীঘিনালা হাসপাতালের নির্মাণ কাজ শুরু করার দাবি জানান।খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলাবাসীর চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এমনি প্রত্যাশা এলাকাবাসীর।

Exit mobile version