ভূমি বিরোধই বড় বাধা বলছেন অনেকে
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৩তম বর্ষপূর্তি আজ। পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও তখনকার সশস্ত্র আন্দোলনকারীদের মধ্যে চুক্তি হলেও এখনো সেখানে অস্ত্রবাজি, সংঘাত, খুনাখুনি, চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকেরই মূল্যায়ন, ভূমি বিরোধই হচ্ছে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন, তথা ওই এলাকায় শান্তি স্থাপনের পথে বড় বাধা।
অবশ্য পাহাড়ে শান্তির জন্য সরকারের সঙ্গে ওই চুক্তি যারা করেছে তারা তা চায় কি না, সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, পাহাড়ে আবার ‘সশস্ত্র বিদ্রোহের’ পরিকল্পনা করছে কোনো কোনো পক্ষ। পাহাড়ি সশস্ত্র গ্রুপগুলোর কাছ থেকে সম্প্রতি যেসব অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে তাতে তাদের ভারী অস্ত্র সংগ্রহের প্রমাণই মিলছে।
গত শনিবার (২৮ নভেম্বর ২০২০) সকালে রাঙামাটি বাঘাইছড়ি উপজেলার বাঘাইহাটে একটি আঞ্চলিক দলের গোপন আস্তানা থেকে সেনাবাহিনী দুটি একে-৪৭ ও একটি এসএমসি উদ্ধার করে। এর আগে এলএমজি, ৭.৬২ মি.মি. রাইফেল, এম-১৭ রাইফেল, জি-৩ রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, মর্টার, হ্যান্ড গ্রেনেড ও রকেট লঞ্চার উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। মূল ধারার রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়ায় সম্প্রতি পাহাড়ি ছয় নেতাকে হত্যা করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ২০১৪ সাল থেকে গত অক্টোবর পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দলগুলোর সন্ত্রাসী কার্যকলাপে সেখানে জীবন হারিয়েছে ৩৭৬ জন। এর মধ্যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ২৫৬ জন এবং বাঙালি ১২০ জন। অপহরণের শিকার হয়েছে ৫৩৮ জন, যাদের মধ্যে আছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৩৬৯ জন এবং বাঙালি ১৬৯ জন। চাঁদাবাজির পরিমাণ পৌঁছে গেছে বছরে ৩৭৫ কোটি টাকায়।
চুক্তির বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নানা বিতর্কিত পোস্ট দেখা যায়।
এমন পরিস্থিতিতে পাহাড়িদের সংগঠন ও নেতাদের দাবি, সরকারের সদিচ্ছার অভাব মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের পথে প্রধান অন্তরায়। তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, চুক্তির অনেক কিছুই বাস্তবায়ন হয়েছে।
এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং বলেন, ‘চুক্তি বাস্তবায়নের দায়িত্ব একা সরকারের নয়। চুক্তি স্বাক্ষরকারী অন্য পক্ষেরও দায়িত্ব আছে। কিন্তু আপনারাই বিবেচনা করে দেখুন, আমরা অন্য পক্ষের কতটা সহযোগিতা পাচ্ছি। উপরন্তু অধিকার আদায়ের নামে নানা সশস্ত্র গ্রুপ সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণের মাধ্যমে জনজীবনকে বিষিয়ে তুলছে।’
চুক্তির সফলতা সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, ‘ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তির আলোকে আমরা এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন, মানবিক বিকাশ ও শিক্ষার উন্নয়নে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছি। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি পাহাড়ি জনগণের ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি এবং প্রথাগত ও ধর্মীয় রীতিনীতি সংরক্ষণ, চর্চা ও বিকাশের জন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। তারা এরই মধ্যে অনেক কাজ করেছে।’ তিনি জানান, বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট এরই মধ্যে ১১টি পাহাড়ি জাতিসত্তার মধ্যে খেয়াং ছাড়া ১০টির বর্ণমালা নিয়ে প্রশিক্ষণ ও নিজ নিজ ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আয়োজনের মধ্য দিয়ে নিজ নিজ মাতৃভাষা চর্চায় কাজ করে যাচ্ছে। এ ছাড়া সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক, বিদ্যুৎ সংযোগ এবং দুর্গম এলাকাগুলোতে সোলার সিস্টেমের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আশা করছি, মুজিববর্ষের মধ্যে শতভাগ ঘরে বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করা যাবে।’
অন্যদিকে পাহাড়ি নেতা সন্তোষিত চাকমা বলেন, ‘চুক্তির শর্তগুলোর মধ্যে প্রধানতম হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করা হলেও এখন পর্যন্ত একটি ভূমি বিরোধেরও নিষ্পত্তি করা হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে পুলিশ নিয়োগ ও ভূমি ব্যবস্থাপনাকে জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তরের মতো কিছু কিছু বিষয় এখনো নিষ্পত্তি না হওয়ায় প্রত্যাশিতভাবে চুক্তির সুফল আসছে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা এবং সেই তালিকার ভিত্তিতে অবিলম্বে আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদগুলোর নির্বাচন দিয়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী ও কার্যকর করার মতো কাজগুলো আজও হয়নি।’
ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি বিষয়ে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বলছেন, ‘এ সমস্যা সমাধানে আগে ভূমি জরিপ দরকার। কিন্তু জরিপে একপক্ষের আপত্তি আছে। মালিকানা নির্ধারণ না করে জরিপের প্রস্তাবে রাজি হলেও পরে সে অবস্থান থেকে ওরা ফিরে আসে।’
ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী নেতা সুকৃতি জীবন চাকমা বলেন, ‘যে ২০ দফা চুক্তির ভিত্তিতে পাহাড়ি শরণার্থীরা দেশে ফিরে এসেছিল, তার মধ্যে প্রথমটাই ছিল জানমালের নিরাপত্তা ও বসতভিটা ফিরিয়ে দেওয়া। কিন্তু চুক্তির এত বছরেও সব ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীকে পুনর্বাসন করা হয়নি।’
কিন্তু খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী সরকার বেশির ভাগ ধারা উপধারাই বাস্তবায়ন করেছে। শর্তের অন্যতম মন্ত্রণালয়ে পূর্ণ মন্ত্রী নিয়োগ, আঞ্চলিক পরিষদ গঠন ও কার্যকর করা, শরণার্থীবিষয়ক টাস্কফোর্স গঠন এবং ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (ল্যান্ড কমিশন) গঠন করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পর্কিত বিষয়গুলো সমাধান ও নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তিনি আরো জানান, চুক্তির মূল উদ্দেশ্য অনুযায়ী সরকারের ৩৪টি বিভাগকে এরই মধ্যে পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। চুক্তির আরো বেশ কিছু ধারা ও উপধারা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ’-এর চেয়ারম্যান আলকাছ আল মামুন ভূঁইয়া বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমেই পাহাড় থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্বার করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে অস্ত্র ও চাঁদাবাজি চলছে।’
মামুন ভূঁইয়া সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি ও প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ করারও দাবি জানান। এ ছাড়া আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ, ভূমি কমিশনসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে জনসংখ্যা অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়।
সূত্র: কালেরকণ্ঠ