ভূমি সেবায় পার্বত্যাঞ্চলে ই-মিউটেশন কবে চালু হবে তা জানেন না কেউ
দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৬১ জেলায় চলতি বছরের গত ১ জুলাই থেকে ভূমিসেবায় ই-নামজারি বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ভূমিব্যবস্থাপনার এই অত্যাধুনিক ডিজিটাল পদ্ধতির সুবিধা পাওয়া থেকে বাদ পড়েছে দেশের তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের জনগণ। সমতলের ৬১ জেলায় বর্তমানে ৪৮৫টি উপজেলা ভূমি অফিস, সার্কেল অফিস এবং তিন হাজার ৬১৭টি ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ই-নামজারির কার্যক্রম চলছে। এরই মধ্যে সারা দেশে এক কোটি ৮ লাখ ১৫ হাজার ৯৩৯ জন সুবিধাভোগী ই-নামজারির কার্যক্রম থেকে সুবিধা পেয়েছে। এ সংক্রান্ত ৬ লাখ ৫৫ হাজারের বেশি মামলা অনলাইনে নিষ্পত্তি হয়েছে। কিন্তু তিন পার্বত্য জেলার ২৬টি উপজেলার অধিবাসীরা কবে থেকে ভূমিসেবায় এ ডিজিটাল সুবিধা গ্রহণের অধিকার পাবেন সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কেউ।
জানা গেছে, সারা দেশে ভূমি ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভুক্তভোগীদের অসন্তোষ দীর্ঘদিনের। এক জমি একাধিক ব্যক্তির নামে বিক্রি, রেজিস্ট্রেশন ও নামজারির ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাজনা পরিশোধ, দলিল উত্তোলনসহ ভূমি অফিসের যেকোনও কাজ ঘুষ ছাড়া হয় না। এমন পরিস্থিতিতে দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়াকে পুরোপুরি ডিজিটাইজড করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ প্রক্রিয়ারই অংশ হচ্ছে ই-মিউটেশন বা ই-নামজারি। ভূমি মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র সরকারের এ উদ্যোগের কথা জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ই-নামজারি প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর থেকে ৬১ জেলায় সামাজিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, ফৌজদারি মামলা, ভোগান্তি ও মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমছে। এর ফলে নথি হারিয়ে গেলে বা নষ্ট হলেও সমস্যা হবে না। এতে নাগরিকের সময়, খরচ ও যাতায়াত যেমন কমবে তেমনি খতিয়ানের স্থায়িত্ব বাড়বে। ডিজিটাল সেন্টারগুলোর আয় বাড়ছে। সরকারি ও ভিপি জমি (ভেস্টেট প্রোপার্টি) বা সম্পত্তি সুরক্ষা পাবে। বড় কথা হচ্ছে ই-নামজারির ফলে এক জমি একাধিকবার একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি, নামজারি ও রেজিস্ট্রেশন বন্ধ হবে।
সূত্র জানায়, আরএস খতিয়ান সিস্টেম (আরএস-কে) ডিজিটাইজড করার অংশ হিসেবে এ-টু-আই-এর সহযোগিতায় ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতর কর্তৃক প্রকাশিত আরএস খতিয়ান অনলাইনে প্রদর্শন ও বিতরণের লক্ষ্যে আরএস খতিয়ান সিস্টেম তৈরি করেছে। ইতোমধ্যে দেশের মোট ৫৩টি জেলার ৩২১টি উপজেলায় এক কোটি ১ লাখ ১১ হাজার ৭০১টি খতিয়ান এন্ট্রির কাজ শেষ এবং তা আরএস-কে সিস্টেমে প্রকাশিত হয়েছে। সমতলের বাকি ৮ জেলার জন্য প্রস্তুত করা প্রায় দুই কোটি আরএস রেকর্ডের উপাত্ত আরএস-কে সিস্টেমে মাইগ্রেশনের মাধ্যমে সংরক্ষণ ও অনলাইনে প্রদর্শনের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।
সরকার এরই মধ্যে ডিজিটাল রেকর্ডরুম চালু করেছে। এ-টু-আই-এর সহযোগিতায় ভূমি মন্ত্রণালয় দেশের সব ভূমি রেকর্ডকে (খতিয়ান) ডিজিটাল করার উদ্দেশ্যে ডিজিটাল ল্যান্ড রেকর্ড রুম সার্ভিস (ডিএলআরএস) নামে একটি পৃথক প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মাধ্যমে জেলা রেকর্ড রুমে সিএস, এসএসহ অন্যান্য খতিয়ান ডিজিটাইজড করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী।
এ বিষয়ে তিনিগণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম আধুনিক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর আওতায় পর্যায়ক্রমে ভূমি ব্যবস্থাপনার অন্য বিষয়গুলো ডিজিটাইজড করা হবে। ইতোমধ্যে ভূমি বিষয়ক ৬ লাখ ৫৫ হাজার ২২০টি মামলা অনলাইনে নিষ্পত্তি হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময় মোট মামলা হয়েছে ১০ লাখ।সরকারের অল্প সময়ে এক কোটি ৮ লাখ ১৫ হাজার ৯৯৩ জন সুবিধাভোগী ই-নামজারি থেকে সুবিধা পেতে শুরু করেছেন। ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৮১৫টি নামজারি আবেদন দাখিল হয়েছে অনলাইনে।’ মন্ত্রী আরো বলেন, ‘১ জুলাই থেকে সারা দেশে ই-নামজারি শুরু হয়েছে। তবে তিনটি পার্বত্য জেলা এই কর্মসূচির বাইরে রয়েছে। বর্তমানে ৪৮৫টি উপজেলা ভূমি অফিস ও সার্কেল অফিস এবং তিন হাজার ৬১৭টি ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ই-নামজারি বাস্তবায়িত হচ্ছে।’
পার্বত্যনিউজের পক্ষ থেকে তিন পার্বত্য জেলা কেন এই কর্মসূচির বাইরে রয়েছে এবং পার্বত্যবাসী কবে নাগাদ ডিজিটাইজড ভূমিসেবা পেতে পারেন জানতে চাইলে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী নিজে কোনো উত্তর দেননি। তিনি এ বিষয়ে ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলতে বলেন। ভূমিমন্ত্রীর রেফারেন্স দিয়ে ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান উম্মুল হাসনা’র কাছে একই প্রশ্ন করা হলে পার্বত্যনিউজকে তিনি জানান, পার্বত্য তিন জেলা পরিষদের সাথে সেখানকার ভূমির বিষয়টি সম্পৃক্ত। সে কারণেই ৬১ জেলার সাথে সেখানে ভূমিসেবায় ডিজিটাইজড কার্যক্রম শুরু করা হয়নি। এ বিষয়ে জেলা পরিষদগুলোর পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি আছে কিনা কিংবা জেলা পরিষদগুলোর সাথে সমন্বয় করে সহসাই তিন পার্বত্য জেলার ভূমিসেবায় অনলাইন পদ্ধতি চালু করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে এবিষয়ে তার কোনো কিছু জানা নেই বলে জানান ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান।
উল্লেখ্য, প্রচলিত পদ্ধতির কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলে মনে করে ভূমি মন্ত্রণালয়। যেমন প্রতিবছর দেশে প্রায় ৪২ লাখ জমি রেজিস্ট্রেশন হয় এবং উত্তরাধিকারমূলে আরও ২০ থেকে ২৫ লাখ নামজারির ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। কিন্তু মালিকানা হালনাগাদ হয় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ। প্রায় ৩০ লাখ জমির হস্তান্তর নামজারি ও রেকর্ড হালনাগাদের বাইরে থেকে যায়। ফলে নাগরিকের সময়, খরচ ও যাতায়াত বেশি হয়। এছাড়া নামজারি হওয়ার পর রেকর্ড হালনাগাদ না করায় একই জমি একাধিক ব্যক্তির নামে রেজিস্ট্রেশন ও নামজারি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এর ফলে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার সৃষ্টি হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ভূমি ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া পুরোপুরি ডিজিটাইজড হলে এসব সমস্যা দূর হবে।