parbattanews

মণিপুরে সহিংসতা কেন?

দুই মাসের বেশি সময় ধরে উত্তাল ভারতের ছোট্ট রাজ্য মণিপুর। চলছে জাতিগত সংঘাত, সহিংসতা-বিক্ষোভ। ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বলছে, গত মে মাস থেকে এ পর্যন্ত সহিংসতায় ১৩০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন, আহত হয়েছেন চার শতাধিক, ঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ। মণিপুরের রাস্তায় দুই নারীকে বিবস্ত্র করে হাঁটানোর একটি ভিডিও প্রকাশ্যে আসায় এবার ফুঁসে উঠেছে পুরো ভারত।

কোথা থেকে বিরোধের শুরু?
বলা হচ্ছে, স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর বিরোধ থেকেই এই অস্থিরতার শুরু। সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই এবং সংখ্যালঘু কুকিদের মধ্যে জমির মালিকানা ও প্রভাব বিস্তার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলমান বিরোধ এখন বলতে গেলে গৃহযুদ্ধে রূপ নিয়েছে।

মণিপুর কোথায়?
মিয়ানমার সীমান্তঘেঁষে অবস্থান মণিপুরের। এটি ভারতের ‘সেভেন সিস্টার’ হিসেবে পরিচিত রাজ্যগুলোর একটি। রাজ্যের প্রায় ৩৩ লাখ জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মানুষ মেইতেই গোষ্ঠীর। বাকি প্রায় ৪৩ শতাংশ কুকি ও নাগা গোষ্ঠীর মানুষ। এছাড়া ছোট ছোট আরও কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে। তবে এই তিনটিই প্রভাবশালী।

কী হচ্ছে সেখানে?
গত মে মাস থেকে সহিংসতা বড় আকার ধারণ করেছে মণিপুরে। খুন, জখম, লুটপাট, উচ্ছেদ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ, সেনাবাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী নামিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এমনকি পুলিশের সাঁজোয়া যানও লুটের শিকার হয়েছে।

কীভাবে শুরু এই সহিংসতার?
সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার পরও মেইতেইরা সরকারিভাবে সংখ্যালঘু তফসিলি জাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার দাবি তুলেছে। মে মাসে মণিপুরের হাইকোর্ট মেইতেইদের তফসিলি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি সরকারকে বিবেচনা করার নির্দেশ দেয়। এরপর কুকিরা প্রতিবাদ জানায়। তাদের বক্তব্য হলো, এমনিতেই মণিপুরের রাজ্য সরকার ও সমাজ ব্যবস্থায় মেইতেইরা প্রভাবশালী অবস্থানে আছে। এখন কেন্দ্রীয় সরকার তাদের তফসিলি মর্যাদা দিলে তাদের সুবিধা আরও বাড়বে। কুকি অধ্যুষিত এলাকায়ও মেইতেইরা আরও সহজে জমি-বাড়ি কিনতে পারবে। রাজ্যের মেইতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নাম করে আগে থেকেই কুকিদের উচ্ছেদ করছে বলেও দাবি করে তারা। ফলে বিক্ষোভে নামে কুকিরা।

মিয়ানমার থেকে মানুষের অনুপ্রবেশ নিয়েও বিরোধ ছিল রাজ্যে। এছাড়া বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোতে যোগ দিচ্ছিলো অনেকে। তারাও এই বিক্ষোভে জড়িয়ে পড়ে।

কে কার বিরুদ্ধে?
ধর্ম ও সাংস্কৃতিক বিভেদের সূত্র ধরে অনেক আগে থেকেই মেইতেই, কুকি ও নাগা গোষ্ঠীর সশস্ত্র বাহিনীগুলোর মধ্যে সংঘাতপূর্ণ অবস্থান ছিল। বসতি স্থাপন, সম্পদের মালিকানা এসব নিয়ে তারা কয়েক দশক ধরে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ছে। সব পক্ষই আবার ভারতের সেনাবাহিনীর সঙ্গেও লড়াই করে আসছে। তবে সর্বশেষ বিক্ষোভ নিয়ে মেইতেই ও কুকিরা একে অপরের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যায়।

‘দ্য ফ্রন্টিয়ার মণিপুর’ পত্রিকার সম্পাদক ধীরেন এ সাদোকপাম বলছিলেন, ‘এবারকার সংঘাত একেবারেই জাতিগত বিরোধ থেকে, এর সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই।’

কুকি ও মেইতেই কারা?
মেইতেই গোষ্ঠীর শেকড় মণিপুর, মিয়ানমার ও আশপাশের এলাকাজুড়ে। তারা মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তবে গোষ্ঠীর কেউ কেউ আবার স্থানীয়ভাবে প্রচলিত ‘সানামাহি’ ধর্মেরও অনুসারী। অপর দিকে কুকিরা মূলত খ্রিষ্টান। এই গোষ্ঠীর বিস্তার ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলজুড়ে। মিয়ানমারেও কুকি জনগোষ্ঠীর দেখা পাওয়া যায়।

পাহাড়-উপত্যকা বিভাজন
মেইতেইদের বসবাস মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল ঘিরে। আর কুকিদের প্রধান আবাস ইম্ফলের আশপাশের পাহাড়ি এলাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। চলমান সহিংসতা শুধু মেইতেইদের তফসিলি জাতিভুক্তি হওয়াতে সীমাবদ্ধ করা কঠিন। দুই জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলমান উত্তেজনার আরও বিভিন্ন কারণ রয়েছে। রাজ্যের ভৌগোলিক অঞ্চলের মাত্র ১০ শতাংশ উপত্যকায় হলেও অধিকাংশ জনগণ এখানেই বসবাস করে।

মণিপুরের অবস্থান
দীর্ঘদিন ধরে রাজ্যটিতে মেইতেইরা প্রভাব ও আধিপত্য বজায় রেখেছে। ৬০ আসনের বিধানসভায় ৪০ সদস্য নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা মেইতিদের। এদের বেশিরভাগ অগ্রসর অঞ্চল উপত্যকা বা ইম্ফলে বাস করে। বিপরীতে পাহাড়ে বসবাসকারী কুকিরা অনেকটাই অনগ্রসর। তাদের ভূমি সুরক্ষার জন্য নির্দিষ্ট আইন রয়েছে। বিদ্যমান আইন অনুসারে, মেইতেইসহ আদিবাসী নয় এমন কেউ পাহাড়ে ভূমি কিনতে পারে না।

মেইতেইরা কেন তফসিলি জাতি হতে চায়?
রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ ও অগ্রসর গোষ্ঠীর তফসিলিভুক্ত হতে চাওয়ার নেপথ্যে কর্মসংস্থান, কোটা বা অন্যান্য অর্থনৈতিক ইস্যু খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। রাজ্যে সমৃদ্ধি, শিক্ষা, অবকাঠামো, সংস্কৃতি ও ভাষাগত দিক থেকে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর চেয়ে এগিয়ে তারা। গুরুত্বপূর্ণ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি দফতর, হাসপাতাল ও সংস্থা উপত্যকায়। মেইতেই অধ্যুষিত জেলাগুলো কুকিদের জেলাগুলোর তুলনায় অবকাঠামো উন্নয়নে ভালো দক্ষতা দেখাচ্ছে। ইতোমধ্যে মেইতেইদের একাংশ কোটা সুবিধা পাচ্ছে বিভিন্ন সরকারি কর্মসূচির আওতায়। মেইতেই ভাষা ভারতের ২২টি সরকারি ভাষার একটি এবং সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত।

মেইতেই গোষ্ঠীর অভিযোগ, কুকি ও নাগারা উপত্যকায় জমি কিনতে পারছে। কিন্তু তারা আইনের কারণে পাহাড়ে জমি কিনতে পারছে না। তাদের উপত্যকায় আবদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে। তাদের দাবি, তারা তফসিলিভুক্ত হলে জমি কেনাবেচায় বাধা থাকবে না। ফলে উপত্যকা ও পাহাড়ের মধ্যে নতুন মেলবন্ধন তৈরি হবে।

এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে মেইতেইদের তফসিলিভুক্ত হওয়ার দাবি মূলত ভূমি সংশ্লিষ্ট। এই তালিকাভুক্ত হলে মেইতেইরা পাহাড়ে জমি কিনতে পারবে। আর এটাই কুকিদের প্রতিবাদের মূল কারণ। তাদের আশঙ্কা অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর মেইতেই গোষ্ঠীর লোকেরা তাদের ভূমি কিনবে বা তাদের ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে তাদের উচ্ছেদ করবে।

কেন নারীদের আক্রমণ?
দিল্লিতে নিযুক্ত বিবিসির সাংবাদিক গীতা পাণ্ডে বলছেন, ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নকে যেকোনও সংঘাতের অন্যতম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়, মণিপুরেও সেটা প্রমাণিত হলো।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, দুই নারীকে অসম্মানের যে ভিডিও এখন ভাইরাল হলো, সেই ঘটনাটি আসলে ঘটেছে গত মে মাসে। ওই সময় একটা ভুয়া খবর ছড়িয়েছিল যে কুকি মিলিশিয়ারা মেইতেই গোষ্ঠীর এক নারীকে ধর্ষণ করেছে। এর জের ধরেই হয়তো বিক্ষুব্ধ মেইতেই জনতা কুকি গোষ্ঠীর দুই নারীকে বর্বর কায়দায় নির্যাতন করে। দুই নারীর মধ্যে একজনকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগও উঠেছে।

কেন্দ্রীয় সরকার কী করছে?
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, দুই কুকি নারীর ওপর এমন নির্মম নির্যাতন পুরো ভারতের জন্য লজ্জার। ঘটনার সঙ্গে দায়ী কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। মণিপুরের কন্যাদের সঙ্গে এহেন আচরণ কোনোভাবেই ক্ষমা করা হবে না।

তবে এই মন্তব্যের পর প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে, নরেন্দ্র মোদি কেন এতদিন মণিপুর ইস্যুতে নীরব ছিলেন।

মণিপুরে প্রায় ৪০ হাজার সেনা, আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য, পুলিশ মোতায়েন করে রেখেছে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার। তবে তারা সংঘাত দমনে হিমশিম খাচ্ছে। স্থানীয় কিছু আদিবাসী নেতা মণিপুরে কেন্দ্রের শাসন জারির দাবি তুললেও কেন্দ্রীয় সরকার তা আমলে নিচ্ছে না।

মণিপুরে এখন ক্ষমতায় আছে নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি। রাজ্য সরকারের প্রধান এন বিরেন সিং মেইতেই গোষ্ঠীর সদস্য। বিধানসভার ৬০টি আসনের মধ্যে ৪০টিই মেইতেইদের দখলে। বীরেন সিং সরকারের অভিযোগ, কুকি মিলিশিয়ারাই এই সংঘাতে উসকানি দিয়ে যাচ্ছে।

তবে দুই নারীকে হয়রানির ঘটনায় অভিযোগের আঙুল উঠেছে স্থানীয় পুলিশের ওপরও। দুই নারীর একজন সাংবাদিকদের বলেছেন, ঘটনার দিন পুলিশ হামলাকারীদের সঙ্গেই ছিল। তারা দুই নারীকে বাঁচানোর কথা বলে প্রথমে গাড়িতে তুলে নিলেও পরে বিক্ষুব্ধ জনতার তুলে দেয়।

গত ৪ মে ওই ঘটনা ঘটে। ভিডিও ফুটেজে হামলাকারীদের চেহারাও স্পষ্ট শনাক্ত করা সম্ভব। তবে পুলিশ এই ঘটনায় সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মামলা দায়ের করেছে বৃহস্পতিবার (২০ জুলাই)। চার জনকে গ্রেফতারের পর তারা বলছে, শিগগিরই আরও গ্রেফতার করা হবে। তবে আড়াই মাস কেন কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হলো না সে প্রশ্নের উত্তর মেলেনি কোথাও।

গ্রন্থনা ও ভাষান্তর: ফৌজিয়া সুলতানা
তথ্য সূত্র: বিবিসি, হিন্দুস্তান টাইমস, টাইমস অব ইন্ডিয়া, আউটলুক ইন্ডিয়া, দ্য কুইন্ট, বাংলা ট্রিবিউন।

Exit mobile version