parbattanews

মরণ নেশা ইয়াবার সাত সতেরো

ইয়াবা

মুহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান:
মরণনেশা ইয়াবা ট্যাবলেটের সবচেয়ে বড় চালানটি ধরা পড়লো টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ নাফ নদী থেকে। র‌্যাব-৭ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের যৌথ অভিযানে ৩ লাখ পিস ইয়াবাসহ ইয়াবা সিন্ডিকেটের মূল পাচারকারীসহ বারজন। আটক ইয়াবার মূল্য আনুমানিক দশ কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন র‌্যাব-৭ এর সিও। গত বছরের ১৩ মে চট্টগ্রামে তেঁতুল ও বরইয়ের একটি চালান থেকে পৌনে ৩ লাখ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করে। এবারে ৩ লাখ পিস ইয়াবা আটক হল দেশের সবচেয়ে বড় চালান। তিনদিন ধরে তীক্ষè নজরদারির পর ৩ ফ্রেব্রুয়ারী মঙ্গলবার সকালে র‌্যাবের অভিযানে ধরা পড়লো এ চালানটি।

যেভাবে ধরা পড়লো 

র‌্যাব সূত্রে জানা যায়, শাহপরীরদ্বীপের অদূরে মিয়ানমার থেকে নাফনদী দিয়ে ইয়াবা আসার গোপন সংবাদ চালানটি ধরা পড়ে। র‌্যাবের একটি বিশেষ টিম কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে টেকনাফে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে চালানটির আদ্যোপান্ত। মঙ্গলবার সকাল এগারটার দিকে র‌্যাবের কয়েকটি ট্রলার পাচারকারী ট্রলারটি ঘিরে ফেলে। এই মুহুর্তেই ট্রলারটি আটক করতে সক্ষম হয়। এ রির্পোট লেখা পর্যন্ত আটককৃতদের সনাক্ত যায়নি। এ যাবত কালের সর্ববৃহৎ চালান বলে জানিয়ে র‌্যাব-৭ কক্সবাজারেরর পুলিশ সুপার দেলোয়ার হোসেন জানান, ৩ লাখ পিস ইয়াবার একটি চালান মিয়ানমার নাফনদীর দিয়ে প্রবেশ করবে। আটককৃতরা জানায়, তারা মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে। ১০-১৫জন পাইকারি ব্যবসায়ীর নিয়মিত ইয়াবা বহন করত তারা।

ইয়াবা কী

বাংলাদেশের টেকনাফ বর্ডার দিয়ে মাদক হিসেবে ইয়াবা প্রথম প্রবেশ করে ১৯৯৭ সালে। ইয়াবা হলো মেথাফেটামাইন ও ক্যাফেইনের মিশ্রণ। মাদকটি একাধারে মস্তিষ্ক ও হূদ্যন্ত্র আক্রমণ করে। এর পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জার্মান প্রেসিডেন্ট এডলফ হিটলার তার মেডিকেল চিফকে আদেশ দিলেন দীর্ঘ সময় ব্যাপি যুদ্ধক্ষেত্রের সেনাদের যাতে ক্লান্তি না আসে এবং উদ্দীপনায় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে বা বিমানের পাইলটের নিদ্রাহীনতা, মনকে উৎফুল, চাঙ্গা রাখার জন্য একটা কিছু আবিস্কার করতে। ৫ মাস রসায়নবিদগণ চেষ্টা চালিয়ে মিথাইল অ্যামফিটামিন ও ক্যাফেইনের সংমিশ্রনে তৈরি করলেন ইয়াবা। ব্যাস! হিটলারের উদ্দেশ্য সফল। সেনারা মানসিক শক্তিতে বলিয়ান হল। ইয়াবা আসলে কী জিনিস এর মূল শব্দ থাই থেকে উত্পত্তি। সংক্ষিপ্ত অর্থ পাগলা ওষুধ। অনেকে একে বলে “ক্রেজি মেডিসিন”। মূল উপাদান মেথঅ্যামফিটামিন। আসলে  নেশা জাতীয় ওষুধ। এক ভয়াবহ মাদক যা মস্তিষ্ক, হূদযন্ত্র এবং শরীরের যে কোনো অঙ্গকেই আক্রান্ত করতে পারে। ধীরে ধীরে অকেজো করে দেয় একটি সুন্দর দেহ, মন ও মানসিকতার। ইয়াবা আসক্তির কারণে মস্তিষ্কের বিকৃতি হতে পারে। মাঝে মাঝে ইয়াবার সঙ্গে ক্যাফেইন বা হেরোইন মেশানো হয়, যা আরও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটি এক সময় সর্দি ও নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ার ওষুধ হিসেবে ব্যবহূত হতো কোনো কোনো দেশে। আরো ব্যবহার করা হতো ওজন কমানোর ওষুধ হিসাবে। পরবর্তী সময়ে সাধারণ মানুষ বিশেষত শিক্ষার্থী, দীর্ঘ যাত্রার গাড়ি চালক ও দৌড়বিদরা এটি ব্যবহার শুরু করেন। ধীরে ধীরে এর কুফল বা দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া উদঘাটিত হতে থাকায় বিশ্বব্যাপী এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির সেনাদের নিদ্রা, ক্ষুধা ও ক্লান্তিহীন করার জন্য ইয়াবা জাতীয় ওষুধ খাওয়ানো হতো। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ক্লন্তি দূর করতে ও সজাগ থাকতে সেনাদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল মেথঅ্যামফিটামিন। সেনারা হতো হিংশ্র, ক্লান্তিহীন ও আগ্রাসী। কিন্তু একবার আসক্ত হয়ে যুদ্ধ ফেরত সেনারা মানসিক অবসাদ গ্রস্ততায় ভুগত এবং আরও হিংস্র হয়ে উঠত। এক সেনা আরেক সেনাকে গুলি করে মারত, আবার কখনো নিজে আত্মহত্যা করত।

৭০ টাকায় কেনা 

র‌্যাবের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইয়াবার মূল কারখানা চীন ও মিয়ানমারের মধ্যবর্তী সীমান্ত এলাকায়। সেখান থেকে মিয়ানমারে পৌঁছাতে প্রতিটি ইয়াবা ট্যাবলেটে খরচ হয় চারশ কিয়াট বা ত্রিশ টাকা। মিয়ানমার থেকে টেকনাফ সীমান্তে পৌঁছাতে খরচ পড়ে পঞ্চাশ টাকা। মিয়ানমার থেকে প্রতি পিস বিশ টাকা লাভে অর্থাৎ ৭০ টাকায় কিনে নেন। পরিবহন খরচ হয় একশ টাকা। অন্যান্য খরচসহ পাইকারি হারে ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা থেকে আড়াইশ টাকায়। ঢাকায় পাইকারিভাবে বিক্রি হচ্ছে তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ টাকায়।

নানারকম ইয়াবা 

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, গত শতকের আশির দশকে দেশে হেরোইন ভয়াবহভাবে ছড়িয়েছিল। ওই দশকের শেষ দিকে আসে ফেনসিডিল। নব্বই দশকের শেষে মাদক হিসেবে ইয়াবা প্রথম ধরা পড়লেও তখন বিষয়টি অতটা গুরুত্ব পায়নি। এখন গোটা দেশ ইয়াবায় ভাসছে। জানা গেছে, আগে পাকিস্তান ও দুবাই থেকে ইয়াবা আসত। দাম পড়ত ৩ হাজার টাকা। পরবর্তীতে মিয়ানমারে উৎপাদন হলে ইয়াবা চলে আসে হাতের মুঠোয়। এখন দেশে ৮ থেকে ১০ ধরনের ইয়াবা পাওয়া যায়। এর মধ্যে চম্পার দাম ২৫০ টাকা, চম্পা সুপার দাম ৩০০ টাকা, আর-৭০, আর-৮০ ও আর-৯০ নামের ইয়াবার দাম ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকা পর্যন্ত। জিপি এবং এন সিরিজ নামের ইয়াবার দাম ৮০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে। থাইল্যান্ডের তৈরি ডব্লিউ ওয়াই নামের ইয়াবা প্রতিটি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ভৌগোলিক কারণে দেশে মাদক অনুপ্রবেশ করে। এর কিছু অংশ অন্য দেশে পাচার হয়। বাকিটা দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ছে।

জানা গেছে, টেকনাফ সীমান্তের পাশাপাশি এখন খাগড়াছড়ির গভীর অরণ্যের মধ্য দিয়েও বাংলাদেশে ইয়াবা আসছে। অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে টেকনাফ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় ইয়াবার ছোট-বড় অসংখ্য কারখানা স্থাপিত হয়েছে বলে জানা গেছে। গত ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সীমান্তের অদূরে মিয়ানমারে তিনটি ইয়াবা তৈরির কারখানার বিস্তারিত তথ্য উপাত্ত মিয়ানমারের বর্ডার ইমিগ্রেশনকে দিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কি?

রাত কাটে নির্ঘুম, ইয়াবা প্রতিক্রিয়ায় টানা সাত থেকে ১০ দিনও জেগে থাকতে বাধ্য হয় অনেকে। শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকে, মেজাজ হয় খিটখিটে, গলা-মুখ শুকিয়ে আসতে থাকে অনবরত। প্রচণ্ড ঘাম আর গরমের অসহ্য অনুভূতি বাড়তে থাকে। বাড়ে নাড়ির গতি, রক্তচাপ, দেহের তাপমাত্রা আর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি। দীর্ঘদিনের আসক্ত ব্যক্তিরা উচ্চরক্তচাপের রোগীই হয়ে পড়ে। মস্তিষ্কের ভেতরকার ছোট রক্তনালিগুলো ক্ষয় হতে থাকে, এগুলো ছিঁড়ে অনেকের রক্তক্ষরণ শুরু হয়। স্মৃতিশক্তি কমে যায়, মানসিক নানা রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, অহেতুক রাগারাগি, ভাঙচুরের প্রবণতা বাড়ে। পড়াশোনা, কর্মক্ষেত্র বা পারিবারিক জীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ে। সব ক্ষেত্রে ব্যর্থতা বা পিছিয়ে পড়তে থাকায় আসক্ত ব্যক্তিরা বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়।

কারও কারও মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়। দৃষ্টিবিভ্রম, শ্রুতিবিভ্রম আর অস্বাভাবিক সন্দেহ প্রভৃতি উপসর্গ থেকে একসময় সিজোফ্রেনিয়ার মতো জটিল মানসিক ব্যাধিও দেখা দেয়। বেশি পরিমাণে নেওয়া ইয়াবা শারীরবৃত্তীয় স্বাভাবিক কার্যক্রমের ব্যত্যয় ঘটিয়ে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে। আর যারা সিরিঞ্জের মাধ্যমে দেহে ইয়াবা প্রবেশ করায়, তারা হেপাটাইটিস বি, সি ও এইডসের মতো মারাত্মক রক্তবাহিত রোগের জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে।

তরুণ তরুণীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে মূল উপাদানের সঙ্গে মেশানো হয় আঙুর, কমলা বা ভ্যানিলার ফ্লেভার, সবুজ বা লাল কমলা রঙ। ফলে আসক্ত ব্যক্তিরা এর প্রচন্ড ক্ষতিকর প্রভাবটুকু প্রথমে বুঝতে পারে না। একই কারণে এটি পরিবহন করা ও লুকিয়ে রাখাও সহজ। ইয়াবার আনন্দ আর উত্তেজনা আসক্ত ব্যক্তিদের সাময়িকভাবে ভুলিয়ে দেয় জীবনের সব যন্ত্রণা। তারা বাস করে স্বপ্নের এক জগতে। এই ভয়ানক মাদক সেবন করলে মনে উত্ফুল্ল ভাব তৈরি হয়, মুড হাই হয়ে যায়। এমনকি ইয়াবার প্রচন্ড উত্তেজক ক্ষমতা আছে বলে যৌন উত্তেজক হিসেবে অনেকে ব্যবহার করে এটি। তাই অনেক যুবক যুবতীরা কৌতূহল বশত ইয়াবা সেবন করে থাকে। ক্ষুধা কমিয়ে দেয় বলে স্লিম হওয়ার ওষুধ হিসেবে অনেকে শুরু করে ইয়াবা সেবন। কিছুটা ওজন কমে। ঘুম কমিয়ে দেয়, সারা রাতের পার্টির আগে ক্লান্তিহীন উপভোগ নিশ্চিত করতে অনেকের পছন্দ ইয়াবা। তবে সবগুলোই সাময়িক। কিন্তু সাময়িক আনন্দের এই ভয়ানক ট্যাবলেটটি যে তাদের ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে, তা টের পাওয়ারও অবকাশ সে সময় তাদের আর থাকে না।

তাই এই মরণ নেশা ইয়াবার হাত থেকে দেশকে ও আমাদের যুব সমাজকে বাঁচাতে প্রয়োজন সচেতনতা ও কঠোর প্রতিরোধমূলক কর্মসূচী।

Exit mobile version