মির্জা রাসেল::
বেশ কয়েকটা ঝর্না ঝিরি দেখে দুই দিন পার করে দিলাম। চাঁদ দেখা গেলে আগামীকাল ঈদ-উল ফিতর, তাই দলের বাকি সদস্যরা ফিরে যাবে। মনটা একটু খারাপ। কী আর করা। এবার পাহাড়েই ঈদ করতে হবে। নতুন একটা ক্যাসকেডের (cascade) সন্ধান পেলাম। ক্যাসকেডের সংজ্ঞায় যা বলা আছে তা মোটামোটি এরকম- a waterfall, typically one of several that fall in stages down a steep rocky slope. স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, এটা যেমন দুর্গম, তেমনি সুন্দর। আর তার চাইতেও বড় কথা এর আকার নাকি বিশাল। এসব শুনে দেখার ইচ্ছাটা আরও বেড়ে গেল। লোকে যা বলে অনেক সময় তা হয় না। পূর্ব অভিজ্ঞতা তাই বলে। তারপরও লোভ সামলাতে পারলাম না। স্বভাবটাই এমন হয়তো তাই।
দলের অন্যান্যদের বিদায় দেয়ার পর থেকে গেলাম দু’জন। চাঁন (চাঁদ) রাতটা পাড়াতে কাটিয়ে পর দিন ভোরে বের হয়ে পড়লাম সেই অচেনার খুঁজ করতে। রাস্তার একটা আনুমানিক মানচিত্র বলে দিল একজন। সেও কোনদিন ওই দিকটাতে যায় নাই। একটু হতাশা আর অনিশ্চয়তার সুর বাজতে লাগল মনের কোঠায়। তারপরও স্থানীয় এক মুরং যুবককে নিয়ে ছুটে চলা। ট্রেইলটি কেবল পাহাড়ের রিজ ধরেই চলতে থাকে। পানির কোন ব্যবস্থা নেই। দীর্ঘ একটা পথ, কেবল চড়াই-উৎরাই। এক সময় কাক্সিক্ষত পাড়ার অস্তিত্ব সমন্ধে সন্দিহান হয়ে পড়লাম। আমার মুরং সঙ্গীও রাস্তা জানে না। চলতি পথে কোন জুম বা কোন পাড়াও পেলাম না। যা দেখা যায় তা আমাদের গন্তব্য হবে না এটা নিশ্চিত ছিলাম। তারপরও পা চালিয়ে গেলাম। আরও অনেকটা পথ চলার পর পাহাড় থেকে দুই একটা পাড়া নজরে আসে। কিন্তু যাবার রাস্তা খোঁজ করতে আরও কিছুটা সময় চলে গেল। এর মাঝে বৃষ্টি ও রোদের আনন্দ যন্ত্রণা তো ছিল নিত্য সঙ্গী। অবশেষে পাহাড় থেকে নামার একটা সরু পথ পেয়ে যাই। ধারণার উপর আস্থা রেখে নেমে গেলাম সেই পথ ধরেই। বেশ কিছু দূর নামার পর একটা শীতল জলের ঝিরি পেয়ে আনন্দ আর ধরে না। এবার সেই ঝিরি ধরে চলা শুরু। অনেকটা পথ পার হয়ে তারপর গয়ালের পায়ের ছাপ দেখে বুঝতে পারলাম পাড়া খুব কাছেই হবে। তারপর ঝিরির পাড়ে আচমকা সেই পাড়ার দেখা। তখন দুপুর শেষ হয় হয়। ক্ষিদে পেটের ভেতর ভয়ঙ্কর আন্দোলন শুরু করে দিয়েছে। সকালে এক কাপ চা আর শুকনা একটা বিস্কুটই ছিল ভরসা। তাই সবার আগে খাবার ব্যবস্থা করতে হবে। পাড়া পুরুষ শূন্য, সবাই জুমের কাজে ব্যস্ত। তারপরও একটা ব্যবস্থা হয়ে গেল। জুমের লাল চাল পাওয়া গেল তবে খাবার মতো কোন তরকারি নেই। কী আর করা, আমাদের রেশন থেকে আলু ভর্তা আর স্থানীয় একটা সবজি পাওয়া গেল, অরসুক। দেখতে অনেকটা লেমন গাসের মতো। আলু ভর্তা আর পাহাড়িদের সেই সবজি রান্না করে দুপুরের খাবার শেষ করে আমাদের লক্ষ্য নিয়ে কথা বলা শুরু করি। আমার মুরং সঙ্গীর সহায়তায় কথা হলো ঠিকই কিন্তু তারা এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারলো না। তবে আমাদের টার্গেট পাড়া খুব কাছেই তা জানতে পারলাম। সেখানে গেলে ঐ ক্যাসকেডের ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যাবে। সময় কম তাই সন্ধ্যা হবার আগেই সেই পাড়ার উদ্দেশে পা বাড়াই।
রাতে ঘুম হলো ভালই। তবে অজানা একটা উত্তেজনা বিরাজ করছিল মনে। খুব ভোরেই আমার ঘুম ভেঙে গেল। হাতের কাজ শেষ করে রাতের বাঁচানো খাবার দিয়ে সকালের নাস্তা সেরে বের হলাম তীর্থের উদ্দেশে। প্রথম দিকের পথটা বেশ ভালই বলতে হবে। পাড়াটার চারদিকেই উঁচু পাহাড় ঘেরা তাই পাড়া থেকে যে দিকেই যাবেন আপনাকে প্রথমে খাড়া চড়াই উঠতেই হবে। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলো না। পথে পথে অসংখ্য বুনো ফুল আপনার সঙ্গী হবে। রামাপাউ, সিলংছি পাউ, রিয়ং পাউ, রুইহং পাউ, চিংরিংপাউ আর কত কি (মুরং ভাষায় পাউ অর্থ ফুল)। লাজুক হাওয়া কখনও কখনও বেয়াড়া হয়ে দুষ্টুমিতে মেতে উঠবে, হয়তো বলতে চায়, দাঁড়াও না পথিক কিছুটা সময়, চল না আমার দেশে মায়ার স্বপ্নপুরীতে। হাওয়ার আদরের মায়া কাটিয়ে আবার এগিয়ে যেতে হবে। আমি এ ফুল ওই লতা আর পাহাড়ের নাম জিজ্ঞাসা করে চলেছি আমার নতুন মুরং সঙ্গীর কাছে। মনে লাগার মতো কয়েকটা পাহাড়ের নাম জানতে পারলাম। একটার নাম নিমরুয়া বাংলায় আয়না পাহাড় আর একটা নাকংহু যার অর্থ হচ্ছে নাক পাহাড় (নাকের মতো একটা অংশ বের হয়েছে বলে এমন নাম)। আরও কিছু পাহাড়ের স্থানীয় নাম জানতে পারলাম তার ভেতর ত্যাংহু, প্রিহু বা বাক্কে পাহাড় উল্লেখযোগ্য। এভাবে চলতে চলতে তিনটি পাহাড় উঠানামা করে নেমে আসলাম একটা ঝিরিতে। তারপর আর কোন প্রমিনেন্ট রাস্তা নেই। কথায় কথায় আমি জিজ্ঞাসা করলাম এই ঝিরি ধরে আমরা কতদূর যেতে পারবো। আমাদের নতুন মুরং সঙ্গীটি বললো, অনেক দূর- তবে এটা ধরে তো কেউ যায় না। আমি বললাম চল আমরা যাই। সে প্রথমে আমতা আমতা করলো তারপর আমি বললাম দেখ, এই ঝিরিটি বেশ সুন্দর আর আমরা এখন পর্যন্ত বেশকটা ছোট ঝর্না ও ক্যাসকেড দেখে ফেলেছি, আমার মনে হয় এ পথে আরও আছে। সে এবার বুঝতে পারলো। বলল, চলেন, এই পথে আরও ‘রাক’ আছে। মুরং ভাষায় ঝর্না বা ক্যাসেকেডকে রাক বলে।
পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে কিছুটা নামলেই অসাধারণ একটা একাকি জুম ঘর। তাকে পাশে রেখে আমরা এগিয়ে চলি। কিছুটা চড়াই ভেঙে উপরে উঠে তারপর হঠাৎ করে থমকে দাঁড়ায় আমাদের নতুন মুরং সঙ্গীটি। এখান থেকে হাতের বামে জঙ্গল কেটে নামতে হবে। কী আর করা, যথা আজ্ঞা। ঝোপ-ঝাড়, কাঁটালতা কেটে-মাড়িয়ে নামতে লাগলাম। কেবল জলের একটা শব্দকে সঙ্গী করে। অবশেষে সেই বুনো মাকাং ঝিরির দেখা পেলাম। এটা ধরেই ডাউনস্ট্রিমে নেমে যেতে হবে। মাকাং অন্য আর দশটা ঝিরি মতো নয়। বড় বড় বোল্ডার আর হড়কা বানের জন্য জমে থাকা প্রমাণ সাইজের গাছের ডালপালার বাধাগুলো পার হওয়া বেশ কষ্টকর। আর ঝিরিটা চলতে চলতে হঠাৎ করেই খাড়া নিচে নেমে যায়। যার জন্য প্রতি পদক্ষেপেই নতুন নতুন বাধা আপনার সামনে এসে দাঁড়াবে। কখনও পাশের খাড়া দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে জঙ্গল কেটে আবার ঝিরিতে নামতে হবে। কখনও খাড়া পাথর বেয়ে ঝর্নার পাশ দিয়ে নামতে হবে। যেমন পিচ্ছিল সেই রকম জোঁক আর পাথর ও মাটিগুলোও পলকা। এভাবে অনেকটা পথ চলতে চলতে বেশ কয়েকটা বড় ক্যাসকেড কষ্ট করে পার হলাম। নতুন একটা চিন্তাও মনে নাড়া দিতে শুরু করল, আমরা যেভাবে যে পথে নামছি সেই পথেই তো আবার উঠতে হবে। কারণ অনেকটা পথ নেমে এসেছি সেই সাথে এমন কিছু খাড়া ও পিচ্ছিল ক্যাসকেড নেমেছি যা উঠার সময় বেশ বেগ পেতে হবে। তারপরও রাস্তা আর শেষ হয় না। মাথার উপর আকাশের দেখা পাওয়া বেশ কষ্টকর। দু পাশের ঘন জঙ্গল আর খাড়া পাহাড়। এভাবে চলতে চলতে একটা সময় এসে দাঁড়ালাম একটা ঝর্নার মুখে। নিচে নামার রাস্তা কই? কী করি! ডান পাশের কাঁটা ঝোপ কেটে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলাম। সেখানে একটা নাম না জানা বুনো গাছ পেলাম। গাছটা মাটি ধসের ধার এ (কিনারায়) দাঁড়িয়ে। তার অল্প নিচে আরও একটা গাছ। সেই গাছটার শিকড়গুলো অনেক দূর নেমে গেছে। আমার নতুন মুরং সঙ্গীটিকে বললাম এই পথে যাবো নাকি। সে বলল, এটাই হতে পারে একমাত্র নামার পথ। আশপাশে সব তো ৫০/৬০ ফিট হবে খাড়া এবং ধসে যাওয়া পাহাড়ের ধার। তবে একটা সমসা আছে, প্রথম গাছটা থেকে দ্বিতীয় গাছটার দূরত্বটা এমন যে যেতে হলে প্রথম গাছ হতে আপনাকে কিছুটা ঝুলে তারপর আলতো করে পা দিয়ে দ্বিতীয় গাছটা স্পর্শ করে শরীরটাকে শূন্যে ভাসিয়ে দ্বিতীয় গাছটা ধরতে হবে। আমার মুরং সঙ্গীটি এরই মাঝে নামতে শুরু করে দিয়েছে। আমার অন্য সঙ্গী এই রাস্তা দেখে থ বনে গেল। ভয় তো পাওয়ারই কথা। দ্বিতীয় গাছের গুড়ি থেকে শিকড়ের দিকে যেতে হলে কিছুটা বামে সরে যেতে হবে এরপর মোটা লতা ধরে কিছুটা ঝুলে আবার গাছের দিকে এসে শিকড়ে পা দিয়ে গাছটার ডান পাশে যেতে হবে। সরাসরি ডান দিকটা একদম খাড়া আর গাছের কা-টা প্রায় শূন্যে। এখান দিয়ে শিকড় পর্যন্ত যাওয়া অসম্ভব। আর একটা কারণ হচ্ছে বাম দিক দিয়ে নেমে ডানদিকেই যেতে হবে কেননা ডান পাশের শিকড়টাই নিচে নেমে গেছে। পিঠের উপর দশ কেজির বোঝাটা বেশ বিপত্তি ডেকে আনতে পারে। তাই ব্যাগগুলো আগে নামিয়ে দিয়ে আমার বন্ধু সঙ্গীকে বেশ কসরত করে নামাতে লাগলাম। সে যখন গাছটার বাম থেকে ডানে যাবার চেষ্টা করছে ঠিক তখনই গাছটার গুড়ি হতে অনেকটা মাটি ও পাথর ধসে গেল। সেই মুহূর্তে আমরা তিনজন সেই গাছটার বিভিন্ন অংশের সাথে ভর দিয়ে আছি। যা হউক ভয়কে জয় করে অবশেষে নিচে নেমে এসে পাথরের বোল্ডারের উপর দাঁড়ালাম। এখান থেকে আরও কিছুটা খাড়া নামতে হবে। এবার এতো কষ্টকর মনে হলো না। এতটুকু পথ নেমে বেশ ক্লান্ত হয়ে গেলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম ব্যাগগুলো এখানে ঝর্নার কাছে রেখে নিচের দিকে যাবো। কেননা বলা যায় না আর কি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। যেমন ভাবা তেমন কাজ। আবারও নিচে নামতে লাগলাম। আরও কিছুটা খাড়া নেমে পাশের ঝোপঝাড় কেটে বড় একটা ক্যাসকেডের দেখা পেলাম। বেশ বড়। আমি বললাম এটাই কি সেটা। মাথা নেড়ে নতুন মুরং সঙ্গীটি উত্তর দিল, না। ক্যাসকেডটির পাশ দিয়ে নেমে আরও কিছুটা পথ যাবার পর আবার হড়কা বানের ডালপালার বাধা শুরু হলো। এসব পার হয়ে আবার একটা ক্যাসকেড। না, এটাও না। এটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে ছোট একটা খুমের মতো তার নিচেই সেই আরাধ্য। ক্যাসকেড আর খুমটা পার হয়ে দাঁড়ালাম সেই তীর্থের মুখে।
মাকাং ক্যাসকেডের সাক্ষাৎ পাওয়া আর এর বিশালতার কাছে নিজেকে দাঁড় করাতে চাইলে এতটুকু ঝুঁকি তো নিতেই হবে। থাকুক সে অরণ্য গহিনে নিভৃতে বন্য রুদ্র রূপে আপন খেয়ালে।
লেখক: পরিব্রাজক
সূত্র: পাক্ষিক পার্বত্যনিউজ, বর্ষ ১, সংখ্যা ১০-১১