parbattanews

মাতামুহুরীর বুকে ধূ ধূ বালুচর, হারিয়ে ফেলেছে নাব্যতা

লামা প্রতিনিধি:

মারমা ভাষায় মামুরি। বাংলায় মাতামুহুরী। বান্দরবান পার্বত্য জেলার আলীকদম উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমটিার দক্ষিণে মায়ানমার সীমান্তবর্তী পাহাড়ের পাদদেশ থেকে এই নদীর উৎপত্তি। উৎপত্তিস্থল থেকে সর্পিল গতিতে একে বেঁকে মাতামুহুরী নদী আলীকদম, লামা ও চকরিয়া উপজেলার বুক চিরে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে।

নদীটির মোট দৈর্ঘ্য ২৮৭ কিলোমিটার। গড় প্রস্থ ১৫৪ মিটার, নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেকর্ড বইয়ে এই নদীটির নম্বর পূর্ব পাহাড়ী অঞ্চলের নদী নং- ১৩ (১)। এককালের প্রমত্ত্বা মাতামহুরী নদী আজ প্রচণ্ড পানি শূণ্যতায় ভূগছে। এক সময়কার খরস্রোতা মাতামুহুরী এখন অনেকটা মরা খাল। বর্ষা মৌসুমে কিছুটা প্রাণ ফিরে পায়।

আশির দশকের পর থেকে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, পাহাড় কেটে পাথর উত্তোলন, অপরিকল্পিত জুম চাষ, মাতামুহুরী রিজার্ভ ফরেষ্টের বৃক্ষ নিধন, পাহাড়ের গাছ-পালা কেটে আগুণে পুড়ে কয়লা তৈরি, আগুন লাগিয়ে পাহাড় পোড়ানো, নির্বিচারে বনজ সম্পদ ধ্বংস, পাহাড় কাটা, পাহাড় কেটে অপরিকল্পিতভাবে বাড়ি ঘর নির্মাণ, তামাক চাষ, ইত্যাদির কারণে চির যৌবনা এই মাতামুহুরী আজ নব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। স্থানীয় পরিবেশ সচেতন ব্যক্তিরা এটাকে পরিকল্পিতভাবে নদী হত্যা বলে দাবি করেছে।

আশির দশকে লামা ও আলীকদমবাসীর যাতায়াতের পথ ছিল এই মাতামুহুরী নদী। এই কারণে নদীর দুই ধারে গড়ে উঠেছে জনবসতি। তবে এখন জনবসতি রয়েছে, নেই নদীর সেই যৌবন।

একতা মহিলা সমিতির নির্বাহী পরিচালক ও পরিবেশ সচেতন কর্মী আনোয়ারা বেগম জানিয়েছেণ, মাতামুহুরী কালের বিবর্তে শীর্ণ নদীতে রূপ নিয়েছে। এই নদীর উৎপত্তিস্থল পর্যন্ত রয়েছে অসংখ্য পাহাড়ি ঝিরি ও খাল। প্রকৃতির বুক চিরে বয়ে চলা এসব ঝিরি ও খালের মিলনস্থল মাতামুহুরী নদীর কোন না কোন পয়েন্ট।

এককালের প্রমত্ত্বা মাতামুহুরী নদীর পানিতে প্রবাহ থাকলেও এখন দিন দিন কমে তা তলানীতে পৌচেছে। নদীর বুক চিড়ে জেগে উঠেছে ধু ধু বালির চর। হুমকির মুখে পড়েছে মৎস সম্পদ। গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্রের তাপে সামান্য চিকচিকে বয়ে চলা পানি উত্তপ্ত হয়ে যায়। যার কারণে এই নদী মাছের বসবাসের অনুপযোগি হয়ে গেছে।

প্রবীন ব্যক্তি ও রুপসীপাড়া ইউপি চেয়্যারম্যান চাহ্লাখইন মার্মা বলেছেন, আশির দশকে মাতামুহুরীর গভীরতা ছিল ৫০ থেকে ৬০ ফুট। প্রস্থ ছিল ১৫শত থেকে ১৬শ ফুট। সরকারি পরিসংখ্যান মতে নদীর আয়তন ছিল ১৮শ ৮০ একর। নদীর খুটি খ্যাত বড় বড় কুমগুলো এখন আর নেই। এই নদীর বাঁকে ভূমির কুম, মাছকুম, চেলার কুম, সতমল্লার কুম, দু:খ্যা-শুখ্যার কুম, তৈনি খালের কুম, গ্যাস কুমসহ আরো অনেকগুলো কুম ছিল। বর্তমানে কিছু কিছু কুম নামে থাকলেও হারিয়েগেছে অধিকাংশ কুম।

জেলে সমিতির সভাপতি বাবু সওদাগর জানিয়েছেন, এক সময় এই নদী থেকে মাছ ধরে সংসার চলতো দুই উপজেলা প্রায় পাঁচ‘শ জেলে পরিবারের। এখন নদীতে পানি নেই, মাছ নেই। সবই অতীত। কল্পনায় আছে শুধু মনকাড়া গল্পের মতোই সোনালী অতীত। কাজ-কর্মহীন এই জেলে পরিবারগুলোতে এখন চরম হতাশা। এখন আর আগের মত মাতামুহুরীর শৈল, বোয়াল, মৃগেল, পুটি, চিংড়ি, বাটাসহ মিষ্টি পানির ৮০ প্রকৃতির মাছের মধ্যে ৭০ প্রজাতির মাছের দেখা নেই।

লামা উপজেলা সাবেক চেয়্য্যারম্যান আলহাজ্ব মো. ইসমাইল বলেছেন, এখন এই নদীর নব্যতা পুনরুদ্ধার করতে হবে। নদীতে তার প্রাণ ফিরিয়ে দিতে হবে। আর এই জন্য ড্রেজিং করা খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। যার জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় আগামী এক দশক পর নাব্যতা সংকটে ভোগা মাতামুহুরী হারিয়ে ফেলবে তার আসল পরিচয়।

লামা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন জানিছেন, মাতামুহুরী রক্ষায় সরকার ও স্থানীয় জনসাধারনকে আন্তরিক হতে হবে।

Exit mobile version