parbattanews

মাতারবাড়িতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পে উচ্ছেদকৃতদের ক্ষতিপূরণের দাবি 

কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে জাইকা ও সিঙ্গাপুর কর্তৃক দুটি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করার জন্য মাতারবাড়ি ও ধলঘাট ইউনিয়নের প্রায় ৫ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। যার ফলে লবণ ও চিংড়ি চাষে যুক্ত হাজার হাজার মানুষ কর্ম হারিয়ে বেকার জীবন যাপন করছে। যে সামান্য জমিতে চাষাবাদ করা যেত, তাও আজ কয়লা বিদ্যূৎ প্রকল্পের কারণে পানির নিচে চলে গেছে।

জমি অধিগ্রহণের আগে নানারকম প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল- জমির ন্যায্যমূল্য দেয়া হবে, ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি মানুষকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে, পূণর্বাসন করা হবে, মাতারবাড়ির কেউ বেকার থাকবে না, সবাইকে প্রকল্পে কাজ দেয়া হবে, নানারকম প্রশিক্ষণ দিয়ে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া হবে।

এই সব প্রতিশ্রুতির কোন বাস্তবরূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। মাতারবাড়ির মানুষ আজ মানবেতরভাবে কোন রকমে বেঁচে আছে। তাই মাতারবাড়ির মানুষ আজ অসহায় ও ক্ষুব্ধ। এর আগেও আমাদের ন্যায্য দাবিগুলো নানানভাবে কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরেছি। জানানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও আজো তা বাস্তবায়ন হয়নি।

শনিবার (২৯ জুন) কক্সবাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছেন মাতারবাড়ির ক্ষতিগ্রস্ত বাস্তুুহারা লোকজন। জেলা জনসুরক্ষা মঞ্চ কক্সবাজারের সভাপতি অ্যাডভোকেট সাকী -এ কাউছারের সভাপতিত্ব ও ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ইমাম খাইরের সঞ্চালনায় এতে উপস্থিত ছিলেন -সহ-সভাপতি মো. শাহাব উদ্দিন, আদহাম বিন ইব্রাহিম, যুগ্ম সম্পাদক মু. হামেদ হোছাইন মেম্বার, সহ দপ্তর সম্পাদক এম. বশির উল্লাহ। ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন- নূর মোহাম্মদ, আব্দুল জব্বার, মুন্নি দাশ, তসমিনা সোলতানা নিশু প্রমুখ।

সংবাদ সম্মেলনে মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশার কথা তোলেন। একই সাথে তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের আকুতি জানান। তাদের পেশ করা দাবিসমূহ—

১. কয়লাবিদ্যূৎ প্রকল্পের মাটি ভরাটের কারণে ৮টি স্লুইচগেট ও ৬টি কালভার্টসহ পানি নিষ্কাশণের সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। পানি নিষ্কাশনের একমাত্র খাল রাঙ্গাখালীর মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গত তিনবছর ধরে
মাতারবাড়ি বছরের ৬ মাস পানির নিচে থাকে। যে কারণে প্রচুর ঘরবাড়ি নষ্ট হচ্ছে, শিশুরা পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে, রোগশোক ছড়িয়ে পড়ছে, মানুষের চলাফেরায় বিঘ্ন হচ্ছে। বিশেষ করে বয়স্ক নারী-পুরুষ, শিশু ও স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের ভোগান্তির কোন শেষ নেই। তাদের লেখাপড়ার ক্ষতি হচ্ছে। যে সামান্য জমিতে চিংড়ী, ধান ও লবণ চাষ করা যেত তাও ব্যাহত হচ্ছে। সুতরাং জরুরী ভিত্তিতে পানি নিঃষ্কাশনের স্থায়ী সমাধান করতে হবে। জলাবদ্ধতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ক্ষতিপূরণ ও সাহায্য করতে হবে।  জলাবদ্ধতার কারণে যারা পানিতে ডুবে মারা গেছে তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।  প্রকল্পের বাইরে চিংড়ি, ধান ও লবণ চাষ করতে না পারার কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও হচ্ছে, তাদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

২. বর্তমানে প্রকল্প এলাকায় আনুমানিক ১২০০ শ্রমিক কাজ করছে। এর মধ্যে মাসিকভিত্তিতে ৪০০ জনের মত ও দৈনিক ভিত্তিতে ৮০০ জনের মত। এর বাইরে বর্তমানে প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এছাড়াও কর্মরত শ্রমিকরা শ্রমের ন্যায্য মুল্য পাচ্ছে না। দালালরা
বেশিরভাগ টাকা কেটে রাখছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ক্ষতিগ্রস্তদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে চাকরি দেওয়ার কথা থাকলেও স্থানীয় শ্রমিকের পরিবর্তে বাইর থেকে হাজার হাজার শ্রমিক এনে কাজ করাচ্ছে।
মাতারবাড়ি ধলঘাটের সক্ষম সব শ্রমিকদের ব্যক্তিদের প্রকল্পের ভিতরে কাজ দিয়ে দ্রুত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি, বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যথাযথ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।

৩. উচ্ছেদকৃত ৪৫ পরিবারের পূনর্বাসন ও রোয়েদাদভুক্ত ক্ষতিপুরণের টাকা পায়নি। এমনকি ৮/১০ ছাড়া বাকীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করা হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো বিগত তিন বছর ধরে ভাড়া বাসায় বসবাস করছে। ইদানিং বাইরে থেকে আসা শ্রমিকদের কারণে এলাকায় বাসা ভাড়া অনেক বেড়ে গেছে। যা
এইসব দরিদ্র মানুষের পক্ষে বহন করা দুঃসাধ্য। এমতাবস্থায়, নির্মাণাধীন পুনর্বাসন প্রকল্প দ্রুত শেষ করে ৪৫ পরিবারের কাছে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করতে হবে। কবে তাদের কাছে হস্তান্তর করা হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে হবে। বাসা ভাড়া হিসাবে প্রদত্ত অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসাবে প্রদান করতে হবে।

৪. অধিগ্রহণকৃত জমির কিছু ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলেও এখনো অধিকাংশ জমির মালিক ক্ষতিপূরণ পায়নি।
অধিগ্রহণকৃত জমির ক্ষতিপূরণের (একর প্রতি ৯-১৩লাখ) টাকা দেওয়া এখনো শেষ হয়নি, বর্ধিত (একর প্রতি ২৭-৩০ লাখ টাকা) পেয়েছে মাত্র ৫% ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার। বিলম্বিত ও হয়রানি ছাড়া দ্রুত সকল প্রকার মামলা ও অংশিদারিত্ব ঝামেলা নিস্পত্তি করে ক্ষতিপুরণ প্রদান করতে হবে।কেন ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে না? তা স্পষ্ট করে জানাতে হবে। কতজন ক্ষতিপূরণের অর্থ পেয়েছে এবং কতজন পাইনি এবং কি কারণে পাচ্ছে না? তার একটি তালিকা প্রকাশ করতে হবে, যাতে সবাই জানতে পারে।বিলম্ব ও হয়রানি ছাড়া দ্রুত সকল প্রকার মামলা ও অংশিদারিত্ব ঝামেলা নিস্পত্তি করে ক্ষতিপুরণ প্রদান করতে হবে।

৫. মাতারবাড়ীর সাধারণ মানুষের চলাচলের জন্য নির্মিত সরু সড়কটি দিয়ে বর্তমানে প্রকল্পের ভারি মালামাল বহনের জন্য প্রতিদিন হাজারও ট্রাক, লরি, ডাম্পার গাড়ি চলাচল করছে। ফলে অহরহ দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটছে। গত ১৯ মার্চ ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় ফুলজান মুরা গ্রামের আব্দুল করিমের ছেলে শেফায়েত উদ্দীন (২৭) ও মাঝের ডেইল এলাকার নাছির মোহাম্মদের পুত্র মামুন নিহত হয়। আহত হয় আরো ৬ জন। এ ঘটনার জের ধরে গত ৬ এপ্রিল নিরাপদ সড়কের দাবীতে মাতারবাড়ী সিএনজি স্টেশনে বিশাল মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ইতিপূর্বে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় আরও ৬ জন। অতিরিক্ত গাড়ি চলাচলের কারণে এলাকায় বায়ু দূষণ ও শব্দ দূষণের মাত্রা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে।
এমতাবস্থায়, সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের দায়িত্ব কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে এবং নিহতদের জন্য যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। অবিলম্বে এই রাস্তা দিয়ে প্রকল্পের মালামাল বহনকারী গাড়ি চলাচল সর্ম্পণরূপে বন্ধ করতে হবে।

৬. কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকায় ড্রেজার দিয়ে মাটি উত্তোলনের ফলে বর্জ্য পলিমাটি নির্গত হয়ে কোহেলীয়া নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। মাতারবাড়ি ও ধলঘাটের মানুষের কাছে এই নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। এই নদীটি মরে গেলে এই এলাকার মানুষের জীবনজীবিকা ও পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় ট্রলার চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে স্থানীয় শতাধিক ফিশিং ও কার্গো ট্রলার মালিকরা ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে। এছাড়া নদী মাছশুণ্য হয়ে গেছে। নদীটি বাঁচিয়ে রাখার জন্য অনতিবিলম্বে সবরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৭. হালনাগাদ তথ্য পাওয়ার জন্য প্রকল্প এলাকায় তথ্যকেন্দ্র বা ডেস্ক রাখতে হবে। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ও সংবাদকর্মীরা প্রয়োজনীয় তথ্য সহায়তা পায়।

Exit mobile version