parbattanews

মায়াবী পাহাড়ে অশান্তি কেন

S5003642t

 

তারেক মোরতাজা:
 

পাহাড়ে সমস্যাটা নতুন নয়। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল হয়ে বাংলাদেশ উত্তরাধিকার সূত্রে এ সমস্যাটা মোকাবেলা করে যাচ্ছে। জাতি রাষ্ট্র হিসেবে এখানে বিভিন্ন সমস্যা থাকতেই পারে, কিন্তু পার্বত্য অঞ্চল বেশি সমস্যাপ্রবণ।

খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান নিয়ে বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রাম। এখানে সহিংসতার জন্য সবচেয়ে বেশি সময় ধরে আলোচিত খাগড়াছড়ি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে খাগড়াছড়ির আশপাশে রাঙ্গামাটির কিছু এলাকা। হামলার সর্বশেষ সংযোজন রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক। এটি রাঙ্গামাটির এলাকা হলেও সেখানে যাওয়ার রাস্তা খাগড়াছড়ি দিয়ে। রাঙ্গামাটির আলোচিত আরেকটি সঙ্কটাপন্ন এলাকা হলো লংগদু। সেখানেও খাগড়াছড়ি দিয়ে যাওয়াটা সহজ। দুর্গম পাহাড়ে সৌন্দর্যের অপার লীলার ভেতর বেড়ে ওঠা বর্তমান পাহাড়ি ও বাঙালি প্রজন্ম সমস্যার সমাধান চান। পুরনো ধ্যানধারণা নিয়ে যে পাহাড়ি ও বাঙালিরা আছেন সেখানে, তাদের মতে সমস্যা সমাধানের রাস্তা ভিন্ন। তাই সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হয় সময় সময়। আবার কারো কারো অভিযোগ এসব সমস্যার পেছনে বিদেশী এবং দেশী কিছু চক্র জড়িত।

যেমনটা মনে করেন জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা সুধা সিন্ধু খীসা। তার মতে, ‘সেটেলাররা’ এখানে দাবার ঘুঁটিমাত্র। আসল খেলাটা খেলছে সমতলের বিত্তবান ও প্রভাবশালীরা- যারা পাহাড়ে জমি লিজ নিয়েছেন। অন্য দিকে  সম-অধিকার আন্দোলনের নেতা মনিরুজ্জামান মনে করেন এখানে বিদেশী শক্তির ইন্ধন রয়েছে। সেই সাথে দেশী কিছু চক্রও পাহাড়কে অস্থিতিশীল করে ফায়দা লুটতে চায়। অভিযোগ এমনও করা হয় বাংলাদেশের এ অঞ্চল ঘিরে প্রতিবেশী কোনো কোনো রাষ্ট্রের ভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সরকার স্থানীয় সংগঠন জনসংহতি সমিতির সাথে একটি চুক্তি করে। শান্তিচুক্তি নামে এটি পরিচিত। ওই চুক্তিতে অসঙ্গতি রয়েছে বলে বাঙালিদের মধ্য থেকে অভিযোগ করা হয়। অন্য দিকে পাহাড়ি জেএসএস মনে করে এটি বাস্তবায়নই সমস্যার সমাধান। তবে বাঙালিদের মতো পাহাড়িদের একাংশ, যারা ইউনাইটেড পিপলস ড্যামোক্র্যাটিক ফ্রন্ট বা ইউপিডিএফের ব্যানারে কাজ করেন, তারা এটা মানতে চান না। নিজেদের চুক্তি বিরোধী বলে দাবি করেন তারা। তারা পার্বত্য অঞ্চলের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন চান; তবে সেখানে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও ভারী শিল্প তাদের আওতার বাইরে থাকবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সব সঙ্কটের মূল হিসেবে বিবেচনা করা হয় ভূমিকে। তবে দুর্গম এলাকা হওয়ার কারণে সেখানে সন্ত্রাসও একটা বড় সমস্যা। পাহাড় যার দখলে থাকে চাঁদা তিনি পান। চাঁদার শিকার হওয়া লোকেরা পাহাড়ি বাঙালি যেকোনো পক্ষেরই হতে পারেন।

পাহাড়ে সন্ত্রাসী হামলার কারণে অনেকের মৃত্যুর খবর রয়েছে। আহত হয়েছেন অনেকে। নিখোঁজ হওয়ার পর ফিরেননি কেউ কেউ। তবুও সেখানকার পরিস্থিতিকে স্থানীয়রা নিজেদের সুবিধামতো ব্যাখ্যা করেন। পাহাড়িরা সন্ত্রাস করলে বলা হয় এটা সমতলের আট-দশটা ঘটনার মতোই। কিন্তু বাঙালিরা করলে সেটি হয় উসকানি। আট-দশটা সাধারণ ঘটনার মতো সেটাকে দেখতে অভ্যস্ত নয় সেখানকার মানুষ। তাদের সাথে সমতলের অনেকেই মনে করেন এমনটা।

পাহাড়ের মানুষকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা রীতিমতো বাণিজ্য করে। পাহাড়িদের মাথা বিক্রি করে বিদেশী সাহায্য নিয়ে এসে ভাগ-বাটোয়ারার অভিযোগ আছে অনেকের বিরুদ্ধে। পাহাড়িদের জন্য কাজ করার নামে সমতলের অনেক গবেষক ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনের অভিযোগও করেছেন সেখানকার দায়িত্বশীল মানুষ।

পাহাড়িরা কী চায়? জবাবে প্রায় সবাই বলছেন, পাহাড়িরা চায় শান্তি। সে জন্য শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। সে কথা বলেছেন জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হলো জুম্ম জাতির মুক্তির সনদ। জুম্ম জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ ও দ্রুত বাস্তবায়ন চায়। অন্য দিকে চুক্তিবিরোধীদের সংগঠন ইউপিডিএফ চায় পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। ইউপিডিএফ নেতা উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা বলেন, আমরা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের জন্য নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। গেলো নির্বাচনে উজ্জ্বল চাকমা খাগড়াছড়ি থেকে অংশ নেন এবং প্রায় ৭০ হাজার ভোট পান। তবে তিনি নির্বাচিত হতে পারেননি।

জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র লারমার গত মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রকাশিত স্মরণিকার সম্পাদকীয়তে ইউপিডিএফকে উদ্দেশ করে লেখা হয়েছে ‘নিজেদের ভ্রান্তপথ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড পরিহার করে যদি ইউপিডিএফ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে না আসে তাহলে লড়াকু ও সংগঠিত জুম্ম জনগণ অচিরেই অতীতের বিভেদপন্থীদের মতো তাদেরকে উৎখাত করবে।’

ওই স্মারক গ্রন্থের সম্পাদকীয়র শেষাংশে জনসংহতি সমিতি বলেছে, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত আঞ্চলিক পরিষদকে কার্যকর করা হয়নি, ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন করা হয়নি, স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা হয়নি, অস্থায়ী সেনাক্যাম্পগুলো কবে নাগাদ প্রত্যাহার করা হবে তা ঘোষণা করা হয়নি। চুক্তির সাথে বিরোধাত্মক ভূমি কমিশন আইনের ১৯টি ধারা এখনো সংশোধন করা হয়নি। ’

তবে সাধারণ জুম্ম জনগণ চায় রাজনৈতিক সহিংসতার বদলে শান্তি। চাঁদা না দিয়ে তারা নির্বিঘেœ জীবন কাটাতে চায়। সেই সাথে চায় সামনে এগিয়ে যেতে।

বাঙালিরা কী চায়? জবাব একটু ভিন্ন। পাহাড়ে বাঙালিরা সম-অধিকার নিয়ে বসত করতে চায়। তাদের মধ্যে যে প্রজন্মের জন্ম পাহাড়ে যারা সেখানে বেড়ে উঠেছেন তারা মনে করেন তাদের এখানেই থাকতে হবে। তাই বিরোধ নয় দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে তারা এখানে বসবাস করতে চান। এ জন্য তারা চান তাদের ভূমি অধিকার এবং কাজের পরিবেশ। সরকার তাদের যে জমি বরাদ্দ দিয়েছে সে জমি তারা বুঝে পেতে চান। সেখানে বাংলাদেশী হিসেবে পাহাড়িদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে যেতে চান তারা। কোনো রক্ত ক্ষয় নয়, শান্তি হবে পাহাড়ে বসতের মূল মন্ত্র। সম-অধিকার আন্দোলনের নেতা মুনিরুজ্জামান বলেন, আমরা শান্তি চাই। সঙ্ঘাত চাই না। নিরাপদে কাজ করতে চাই। নিরাপদে ঘুমাতে চাই। কোনো সন্ত্রাসী দ্বারা আমরা আক্রান্ত হতে চাই না। আমাদের ভূমি আমাদের ফেরত দিতে হবে। আমরা সেখানে কাজকর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করতে চাই।

 সৌজন্যে –  দৈনিক নয়া দিগন্ত।

Exit mobile version