parbattanews

মিয়ানমারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও চাপ প্রয়োগের সাত ক্ষেত্র

 

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও চাপ প্রয়োগের ৭টি ক্ষেত্র নির্দিষ্ট করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সোমবার মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে সুনির্দিষ্ট এই ক্ষেত্রগুলোর কথা তুলে ধরা হয়। এতে রোহিঙ্গা নিপীড়নের প্রতিবাদে এরইমধ্যে নেওয়া কিছু পদক্ষেপ এবং তৎপরতার পাশাপাশি নতুন করে নেওয়া নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের ঘোষণা দেওয়া হয়। জানানো হয় সামরিক সম্পর্ক ছিন্নের সিদ্ধান্তের কথা। রাখাইনে রোহিঙ্গা নিপীড়নের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করা হয় ওই বিবৃতিতে। এতে নিষেধাজ্ঞা ও চাপ প্রয়োগ করতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সাতটি পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর।

জেড অ্যাক্টের আওতায় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা

২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান শীর্ষ কর্মকর্তাদের জেড অ্যাক্টের আওতায় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছেন মিয়ানমারের শীর্ষ সামরিক নেতৃত্ব।

জেড অ্যাক্টের আওতায় অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা

এবার একই আইনের আওতায় রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞে সংশ্লিষ্ট নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারির পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। এই নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলে সংশ্লিষ্টরা যুক্তরাষ্ট্রের কোনও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কে জড়াতে পারবে না।

জেড অ্যাক্ট মূলত মার্কিন কংগ্রেসে পাস হওয়া একটি আইন যা জান্তাস অ্যান্টি ডেমোক্রেটিক অ্যাক্ট অব ২০০৮ নামে পরিচিত। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের তখনকার তৃতীয় প্রধান অর্থনৈতিক আয়ের ক্ষেত্র পাথর আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে মার্কিন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয় (ব্যক্তিগত ব্যবহারের ক্ষেত্রে নয়)। সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাও আরোপিত হয় ওই আইনের মধ্য দিয়ে।

লেহি আইন অনুযায়ী সামরিক সহায়তা বন্ধ

রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে জড়িতদের লেহি আইন অনুযায়ী সব মার্কিন সুবিধা ভোগে অযোগ্য হিসেবে বিবেচনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। লেহি মানবাধিকার সম্পর্কিত এমন একটি আইন, যা প্রয়োগের মধ্য দিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে কোনও বিদেশি রাষ্ট্রকে সামরিক সহায়তা বন্ধ করতে পারে।

লেহি সংশোধনী নামে যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন অ্যাসিসটেন্স অ্যাক্ট-এর ৬২০এম সেকশনে আওতায় পড়েছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। এই আইন অনুযায়ী পররাষ্ট্র দফতর দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীকে দেওয়া সহায়তা কমিয়ে দেয়। প্রতিরক্ষা বিভাগের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিও বাতিল করা হয়। উদ্দেশ্য এই প্রশিক্ষণ ও সামরিক সুবিধা যেন মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজে ব্যবহৃত না হয়। লেহি আইনে সাধারণ বিদেশি সামরিক বাহিনী, পুলিশ, সীমান্তরক্ষী বাহিনী, কাস্টম পুলিশ, কারারক্ষীরা অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ যারা আইন প্রয়োগের ক্ষমতা রাখেন। নরেট বলেন, লেহি আইন অনুযায়ী রাখাইন প্রদেশে সামরিক কর্মকর্তাদের অভিযুক্ত করে চিহ্নিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা সবাই সামরিক সহায়তা পাওয়ার অধিকার হারিয়েছেন।

শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের ওপর আমন্ত্রণ নিষেধাজ্ঞা

যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত কোনও অনুষ্ঠানে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের আমন্ত্রণ বাতিল করা হয়েছে। আমন্ত্রণ বাতিলের এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশটির সেনাবাহিনীর আর কোনও সদস্য মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত কোনও অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার অধিকার হারিয়েছে।

গ্লোবাল ম্যাগনিতস্কি আইনের আওতায় নিষেধাজ্ঞা

গ্লোবাল ম্যাগনিতস্কি আইনের আওতায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে দায়ী যে কোনও সামরিক/বেসামরিক ব্যক্তির ওপর ভ্রমণ ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাসহ নানা ধরনের অবরোধ আরোপের সুযোগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। এছাড়া আর কোন আইনে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখছে ওয়াশিংটন।

২০০৯ সালে রুশ হিসাবরক্ষক ম্যাগনিতস্কি তার দেশের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের ট্যাক্স ফাঁকির বিষয়টি উন্মোচন করেন। ফলস্বরূপ মস্কোর কারাগারে অকথ্য নির্যাতনের শিকার হন তিনি। কিছুদিন পর ওই কারাগরেই তার মরদেহের সন্ধান পাওয়া যায়। স্নায়ুযুদ্ধের পুরনো রীতিতেই যেন বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার ম্যাগনিতস্কির নামানুসারে যুক্তরাষ্ট্রে গ্লোবাল ম্যাগনিতস্কি আইনের সূচনা। ২০১২ সালে আবির্ভাবের সময়ে আইনটির আওতায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত রুশ কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ২০১৬ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে এর প্রয়োগ শুরু হয়। গ্লোবাল ম্যাগনিতস্কি আইনের আওতায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বিশ্বের যে কোনও দেশের নাগরিককে ভিসা সুবিধা দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া নির্দিষ্ট ওই ব্যক্তির ওপর অন্যান্য নিষেধাজ্ঞাও জারি করতে পারে ওয়াশিংটন।

আন্তর্জাতিক প্রবেশাধিকার ও মানবিক বিপর্যয় রোধে দুই পদক্ষেপ

জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক তদন্ত দল, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে প্রবেশের অনুমতি দিতে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগী দেশগুলোকে নিয়ে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘ ও সংস্থাটির মানবাধিকার কাউন্সিলসহ অন্যান্য ভেন্যুতে বিষয়গুলো নিয়ে সহযোগী ও মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে ওয়াশিংটন।

চলমান সংঘাত শুরুর পর থেকেই রাখাইনে নিষিদ্ধ রয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো। জাতিসংঘসহ মানবিক সহায়তা দানকারী প্রায় ২০টি সংগঠন তাদের কার্যক্রম বন্ধে বাধ্য হয়। সরকারের বিরুদ্ধে স্পষ্টত ত্রাণ কার্যক্রমে অসহযোগিতা ও বাধাদানের অভিযোগ তোলে ওই সংস্থাগুলো। সেখানে প্রবেশাধিকার নেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অন্য অংশগুলোরও। সম্প্রতি ২০ জন কূটনীতিককে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে প্রবেশ করতে দিতে বাধ্য হয় মিয়ানমার। সরকারি তত্ত্বাবধানে সেখানে গিয়ে মানবিক বিপর্যয়ের ভয়াবহতা দেখে আসেন কূটনীতিকরা।

চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনযজ্ঞের শিকার রাখাইন প্রদেশে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রবেশাধিকার না দেওয়াকে মিয়ানমারের ‘অগ্রহণযোগ্য’ পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যা দেয় জাতিসংঘ। সংস্থাটির মানবিক সহায়তা বিষয়ক দফতরের প্রধান মার্ক লোকক জানিয়েছেন, কয়েকদিনের মধ্যে তাদের একজন প্রতিনিধি রাখাইন সফর করতে পারবেন বলে আশাবাদী তারা। তবে রাখাইনে প্রবেশ করতে পারলেও জাতিসংঘ স্বাধীনভাবে কর্মকাণ্ড চালাতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়ের কথা জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।

চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এএফপি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেফ্রে ফেল্টম্যান তাদের বিষয়ে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি ও সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেছেন, ‘পাঁচ দিনের সফরে জেফ্রে ফেল্টম্যান মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের কাছে মহাসচিব গুতেরেস-এর আহ্বান পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি আক্রান্ত এলাকায় মানবিক সাহায্যকর্মীদের অবাধ প্রবেশাধিকার এবং পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসন দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না যে, জেফ্রের ওই সফরে আমরা দ্রুততার সঙ্গে কোনও বিজয় অর্জন করেছি। এটা হচ্ছে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে চলমান আলোচনা।’

সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘকে দৃঢ় ও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে ট্রাম্পের এমন অবস্থান তুলে ধরেন দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স। পরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে রোহিঙ্গা ইস্যুতে উদ্বেগ জানায় যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন দূত নিকি হ্যালি সে সময় জানান, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান বন্ধ করতে মিয়ানমারের নেতা অং সান সু চি ও দেশটির সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের ‘চাপ’ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন তার সাম্প্রতিক মন্তব্যে বলেছেন, রাখাইনে নিপীড়নের হোতা জেনারেলরা। হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট সদস্যরা তাকে কয়েকদিন আগে লেখা এক চিঠিতে বলেছেন, মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এরপরই নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত এলো।

নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত বিবৃতিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর জানায়, ‘মিয়ানমার সরকার ও তাদের সশস্ত্র বাহিনীকে শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে ব্যবস্থা নিতে হবে। মানবিক সহায়তা দিতে সংস্থাগুলোকে অনুমোদন দিতে হবে। যারা পালিয়ে গেছে তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে।’ সংকট সমাধানে মিয়ানমারের যে কোনও কার্যকরী পদক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্র পাশে থাকবে।

মিয়ানমারের জঘন্য সামরিক শাসনের কারণে ১৯৮৯ সাল থেকে দেশটিতে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৫ সালের নভেম্বরের কথিত ঐতিহাসিক নির্বাচনে সু চি’’র দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) নিরঙ্কুশ জয় পায়। ২০১৬ সালের শুরুতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথতার ভিত্তিতে আঁতাতভিত্তিক একটি ডি-ফ্যাক্টো সরকার গঠন করেন সু চি। ওই ডি ফ্যাক্টো সরকার ক্ষমতা নেওয়ার কয়েক মাসের মাথায় ২০১৬ সালে তৎকালীন ওবামা প্রশাসন ১৯৮৯ সালে মিয়ানমারে জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত জানায়। ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম হোয়াইট হাউসের বরাত দিয়ে খবর দেয়, গণতন্ত্রের পথে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করায় নির্বাহী আদেশে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিয়ানমারের ওপর থেকে আংশিক বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের একদিন পর রোহিঙ্গা অধ্যুষিত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে শুরু হয় কথিত জঙ্গিবিরোধী ক্লিয়ারেন্স অপারেশন। জাতিসংঘের তরফে সেই অভিযানের সময় ‘এথনিক ক্লিনজিং’ ও দুই দফা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ তোলা হয় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সচিত্র প্রতিবেদনে উঠে আসে হত্যাযজ্ঞ-অগ্নিসংযোগসহ নিপীড়নের নানা চিত্র। তা সত্ত্বেও মিয়ানমারের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত চলমান থাকে। তবে এবারের সহিংসতায় সে অবস্থান থেকে কিছুটা হলেও সরে এসেছে হোয়াইট হাউস।

 

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউনে

Exit mobile version