মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ যুক্তরাষ্ট্রের

নিউ ইয়র্ক:

মিয়ানমার থেকে ভিটেমাটিছাড়া করে রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পাঠানোর ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে বলেও জানিয়েছে হোয়াইট হাউস।

স্থানীয় সময় বুধবার মিয়ানমার প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কথা জানতে চাওয়া হলে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি সারাহ স্যান্ডার্স সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।

মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে চলমান সহিংসতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে। পাশাপাশি এ বিষয়ে মিয়ানমারসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে বলে জানিয়েছেন ওই মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা।

সারাহ স্যান্ডার্স বলেন, “আমার জানামতে এটি এমন একটি বিষয় যা আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। ” তবে এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানাননি স্যান্ডার্স।

অন্যদিকে, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, তারা চলমান পরিস্থিতিতে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং বিষয়টি মিয়ানমারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উত্থাপন করা হবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, “গত ২৫ আগস্ট একটি নিরাপত্তা চৌকিতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (এআরএসএ) হামলার পর পরিপ্রেক্ষিতে রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার খবর এবং ওই রাজ্যের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়সহ বেসামরিক জনগণের ওপর এর প্রভাব নিয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।

এ খবরগুলোর মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী ও বেসামরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সৃষ্টির অভিযোগ, পাশাপাশি এআরএসএ’র হামলা। ”

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, “মার্কিন দূতাবাস নিবিড়ভাবে চলমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।

তবে বর্তমান নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও রাখাইন রাজ্যে গণমাধ্যম ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর প্রবেশে কড়াকড়ি থাকায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে যেসব খবর উঠে আসছে, সেগুলো যাচাই করাটাও কঠিন।

” এক প্রশ্নের জবাবে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, “রাখাইন রাজ্যের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রেখে চলেছি।

এ ছাড়া দেশটির সর্বোচ্চ পর্যায়েও আমরা প্রকাশ্যে ও ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলো ও সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গেও আমরা যোগাযোগ রেখে চলেছি। “

রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে গিয়ে আইনের যেন ব্যত্যয় না ঘটে, সেদিকে নজর রাখার জন্য  মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা এই বিচারকাজ এমনভাবে পরিচালনার আহ্বান জানিয়েছে যেন এটি স্বচ্ছ হয় এবং মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার সুরক্ষা দেয়।

এ ছাড়া, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নির্যাতনের যে অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো তদন্তেরও আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, “আমরা মিয়ানমার সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানাই, তারা যেন বেসামরিক ব্যক্তিদের সংঘাতে জড়ানোকে প্রতিরোধ করে। মিয়ানমারের সব সম্প্রদায়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ও তাদের সহায়তা করতে মিয়ানমার সরকারকে যেকোনও ধরনের সমর্থন দিতে মার্কিন দূতাবাস প্রস্তুত। ”

তিনি বলেন, “অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টে এর ২৪ আগস্টের চূড়ান্ত প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই প্রতিবেদনে উঠে আসা সুপারিশ পর্যালোচনা ও বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তাকেও স্বাগত জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

সহিংসতা অব্যাহত থাকার পরিস্থিতিতে ওই প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হওয়া গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা।

জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী, মিয়ানমারের অন্তত এক লাখ ২৫ হাজার বাসিন্দা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে এবং আরও এক লাখ বাংলাদেশে ঢোকার অপেক্ষায় রয়েছে। অতীতে বিভিন্ন সময় সামরিক অভিযান ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সময় থেকে মিয়ানমারের প্রায় চার লাখ বাসিন্দাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের জন্য নতুন করে আসা মিয়ানমারের বাসিন্দাদের অতিরিক্ত চাপ বহন করা অসহনীয় হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ জোর দিয়ে বলেছে, কোনওভাবেই বাংলাদেশের রাখাইন রাজ্যের ধারাবাহিক সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতার শিকার হওয়া উচিত হবে না।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একটি উপগ্রহ চিত্র তুলে ধরে বলেছে, রোহিঙ্গা মুসলমান অধ্যুষিত একটি গ্রামেই সাত শ’রও বেশি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে ধ্বংসলীলার মাত্রা আগে যা ভাবা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নিপীড়নকে বিশ্বের বিশ্লেষকদের অনেকে গণহত্যার মতো অপরাধ হিসেবেই দেখছেন। দাবি উঠেছে সু চির নোবেল পদ প্রত্যাহারেরও।

সু চির বর্তমান ভূমিকার নিন্দায় ওয়াশিংটন পোস্ট সম্পাদকীয় ছেপেছে। প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিকটি বলেছে, ‘সু চি নোবেল পুরস্কার গ্রহণের সময় যে বক্তব্য রেখেছিলেন তা পুনর্বার পাঠ করে দেখতে পারেন।

তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন এক বিশ্ব গড়ে তোলা যেখানে থাকবে না কোনো বাস্তুহীন, ঘরহীন, আশাহীন মানুষ। সে বিশ্ব হবে সত্যিকারের এক অভয়ারণ্য, যার বাসিন্দাদের থাকবে শান্তিতে বসবাসের স্বাধীনতা ও সক্ষমতা। ‘ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিশ্বটা আজ মোটেই এ রকম নয়’।

প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানে কলামিস্ট জর্জ মনবিয়ট নিবন্ধ লিখেছেন, ‘অং সান সু চির নোবেল পদক ছিনিয়ে নাও, তিনি এর যোগ্য নন’ শিরোনামে।

তিনি লেখেন, ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘে গৃহীত ‘জেনোসাইড কনভেনশন’-এ পাঁচটি অপরাধের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এর যেকোনও একটি যখন ‘কোনো জাতীয়, নৃতাত্ত্বিক, সম্প্রদায়বিশেষ বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে পুরোপুরি বা আংশিক ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে করা হয়, তখন তা গণহত্যা বলে বিবেচিত হবে।

অং সান সু চি দেশটির সাম্প্রতিক রাজনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণের পর রোহিঙ্গাদের ধ্বংস করার সুস্পষ্ট এবং প্রায়শ প্রকাশ্য উদ্দেশ্য নিয়েই পাঁচ অপরাধের অন্তত চারটি কমবেশি নিরবচ্ছিন্নভাবে করে যাচ্ছে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী’।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন