parbattanews

মিয়ানমারের বিদ্রোহী আরাকান আর্মিতে বাড়ছে নারীর সংখ্যা

মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় কচিন রাজ্যে সামরিক পোশাকে কয়েক ডজন নারী রাইফেল নিয়ে সঙ্গীতের তালে তালে মার্চ করে যাচ্ছে। এসব নারী মিয়ানমারের জাতিগত সংখ্যালঘুদের অন্যতম সশস্ত্র গ্রুপ আরাকান আর্মির সদস্য হিসেবে যোগ দিতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।

মিয়ানমারের সশস্ত্র সংগঠনগুলোতে নারী সৈনিকেরা বিরল নয়। তবে আরাকান আর্মিতে তাদের সংখ্যা বাড়ছে। পশ্চিম মিয়ানমারে আরাকানি নামে পরিচিত জনগোষ্ঠীর সমর্থনপুষ্ট এই বিদ্রোহী গ্রুপটির তৎপরতার ফলে ২০১৮ সালের শেষ দিক থেকে দুই লাখ ৩০ হাজার লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো বলছে, গরিব রাখাইন এলাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি, সামরিক নিপীড়ন, চাকরির অভাবের কারণে নারীরা এ দিকে ঝুঁকছে।

রাখাইন ওমেন্স নেটওয়ার্কের মা নয়ও বলেন, যুদ্ধের কারণে নারী ও শিশুরাই সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছে। শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা ছাড়াই লাখ লাখ লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আর চাকরির অভাব ও চরম দারিদ্র্যতার কারণেও কম বয়সী মেয়েরা বিদ্রোহী গ্রুপে যোগ দিচ্ছে।

বিশ্লেষক ও কয়েকজন নারী সৈনিক বলেন, নারীরা প্রায়ই মিয়ানমার জাতিগত সশস্ত্র গ্রুপগুলোতে অধঃস্তন ভূমিকায় থাকে। অনেকে বলছে, সশস্ত্র গ্রুপটির শক্তিমত্তা বোঝাতে প্রপাগান্ডার অংশ হিসেবেও নারীদের নিয়োগ করা হয়ে থাকতে পারে।

অবশ্য, সঙ্ঘাতের কারণে ক্রমবর্ধমান হতাশা ও বছরের পর বছর ধরে প্রান্তিকীকরণের প্রমাণ হিসেবেও নারী সৈনিকদের সংখ্যা বাড়তে পারে। রাখাইনের অনেক বেসামরিক নাগরিক মনে করেন, সশস্ত্র গ্রুপগুলো মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বামার জনসংখ্যার আধিপত্যপূর্ণ রাজনৈতিকব্যবস্থা বদলে দিতে পারে। গত ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে রাখাইনের বেশির ভাগ এলাকায় ভোটাভুটি বাতিল করা হয়। রাইটস গ্রুপগুলো বলছে, এতে করে উত্তেজনা বাড়তে পারে, সঙ্ঘাত আরো ছড়িয়ে পড়তে পারে।

রাইটস গ্রুপ রাখাইন ওমেন্স ইনিশিয়েটিভ অর্গ্যানাইজেশনের চেয়ারপারসন স স্যান নিয়েন থু বলেন, নারীরা সঙ্ঘাতে তাদের পরিবারের সদস্যদের নিহত হতে দেখে বা উদ্বাস্তু ক্যাম্পগুলোতে বঞ্চনা দেখে আরাকান আর্মিতে যোগ দিয়ে থাকতে পারেন।

তিনি বলেন, অনেক নারী তাদের পরিবারের সদস্য, স্বজনদের সঙ্ঘাতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখেছেন। তারা সঙ্ঘাত-জর্জরিত এলাকায় নিজেদের নিরাপদ মনে করে না। তারা নিজেদের রক্ষা করতে ও তাদের অধিকার আদায় করতে যুদ্ধে যোগ দিয়েছে।

থাজিন হতউই নামের ২১ বছরের এক তরুণ আরাকান আর্মিতে যোগ দেয়ার কারণ হিসেবে জানিয়েছেন, সামরিক বাহিনী ভারী অস্ত্র নিয়ে নির্বিচারে গুলি করতে করতে গ্রামে প্রবেশ করে। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক লোকদের হত্যা করে, গ্রামবাসীদের ওপর নির্যাতন চালায়। তিনি বলেন, তিনি গ্রামে বসবাস করা নিরাপদ মনে না করায় এবং নিজেকে ও তার জনগোষ্ঠীকে রক্ষার জন্যই আরাকান আর্মিতে যোগ দিয়েছেন।

মানবিক ক্ষতি মারাত্মক : আরাকান আর্মির যুদ্ধক্ষেত্রগুলো চীন সীমান্তবর্তী কচিন রাজ্যের পাবর্ত্য এলাকার সদরদফতর থেকে কয়েক শ’ কিলোমিটার দূরে রাখাইন রাজ্যে অবস্থিত। তারা মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে নিয়োজিত আরেকটি সশস্ত্র গ্রুপ কচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মির সাথে জোটবদ্ধ।

গত বছর কয়েক শ’ নারী রাখাইন থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সদরদফতরে যোগ দিয়েছে। তারা নানা ধরনের সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে।

থাজিন হতউই বলেন, বেসামরিক লোকজনকে যখন হত্যা করা হচ্ছিল, তখন তাদের রক্ষায় আমি কিছুই করতে পারিনি। এখন যুদ্ধে নেমে আমি শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে পারি, রাখাইন লোকজনের নিরাপত্তা দিতে পারি।

এক দশক আগে গঠিত হয় রাখাইন আর্মি। তারা রাখাইন রাজ্যে স্বশাসন, সাম্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের দাবিতে সোচ্চার। উল্লেখ্য, মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্য সবচেয়ে গরিব।

গ্রুপটির কমান্ডার তুন মিয়াত নাইঙ বলেন, আমরা আমাদের রাজ্যের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের জন্য, আমাদের জনগণকে রক্ষা করার জন্য, রাখাইনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য লড়াই করছি।

তবে সঙ্ঘাতের মানবিক মূল্য অনেক বেশি। উভয়পক্ষের ক্রসফায়ারে পড়ছে বেসামরিক লোকজন। গোলাবর্ষণ ও বিমান হামলায় ২০১৮ সালের চেয়ে ২০১৯ সালে আরো বেশি লোক হতাহত হয়েছে।

মানবাধিকার কর্মীরা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনছেন। তারা বেসামরিক লোকজনকে বিপদে ফেলার জন্য আরাকান আর্মিকেও দায়ী করছেন।

রাখাইন ইথনিক কংগ্রেস জানিয়েছে, লাখ লাখ লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তাদের খাবার, পানি ও আশ্রয় নেই। সরকার তাদের কাছে ত্রাণ সহায়তা যেতে দিচ্ছে না। করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেই এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

নারীরা অবমূল্যায়িত : মিয়ানমারের বিদ্রোহী গ্রুপগুলো তাদের দলে নারীদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি ফলাও করে প্রচার করলেও নারীরা বেশ অবমূল্যায়নের শিকার হয়ে আসছে।

অল বার্মা স্টুডেন্টস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের সার্জেন্ট লিনলাত জিয়া জিন বলেন, নারীদের সাধারণত প্রশাসনিক দায়িত্বে রাখা হয়।

নরওয়েভিত্তিক পিস ইনস্টিটিউট অসলোও একই উপসংহারে এসেছে। অনেক নারী মুক্তির সন্ধানে যুদ্ধে যোগ দিলেও তাদের অধঃস্তন ভূমিকায় রাখা হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের উপস্থিতি বিরল ঘটনা।

সূত্র: সাউথএশিয়ানমনিটর

Exit mobile version