parbattanews

মিয়ানমার সীমান্তের অস্থিরতা থেকে নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়ছে

gen rashid

মেজর জেনারেল মো. আব্দুর রশীদ (অব)

অধুনা পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানের থানচি উপজেলার বড় মধক এলাকায় আরাকান আর্মি নামের মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আচমকা আক্রমণের মুখে পড়ে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বিজিবি’র এক সদস্য আহত হয়েছে। রাখাইন উপজাতির জন্য আলাদা সত্তা রাখাইন রাজ্য সৃষ্টির লক্ষ্যে সশস্ত্র লড়াইয়ে লিপ্ত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আরাকান আর্মি নামে পরিচিত।

আরাকান রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদের অস্তিত্ব অনেক আগে থেকেই। নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে মাঝে-মধ্যেই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। মিয়ানমারের সংখ্যালঘু উপজাতিরা প্রায় সবাই নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে টিকিয়ে রাখতে স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ধরে হেঁটেছিল। সামরিক অভিযান এবং রাজনৈতিক পদক্ষেপ দুই মিলে রাজ্যভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদ অনেকটাই অবদমিত হলেও কিছু সংখ্যক দল অস্ত্র পরিত্যাগ করেনি। মিয়ানমারের দ্বিতীয় সংখ্যালঘু কোচিন রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদ জিইয়ে থাকে। ২০০৮ সালে আরাকান আর্মি নাম নিয়ে রাখাইন রাজ্যে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য সংগঠিত হয়। নিজের শক্তি বেশি না থাকায় কাচিন রাজ্যের জঙ্গিদের সাথে জোট বেঁধে তাদের সক্রিয় সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় বাড়তে থাকে। মোটামুটি শ’ দুয়েক সশস্ত্র সদস্য নিয়ে রাখাইন রাজ্যে ফেরত আসে। হঠাৎ করে বিজিবি তাদের আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত হওয়াই নতুন শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। আরাকান আর্মির হামলার উদ্দেশ্য খোঁজার জন্য উত্সুক হয়ে পড়েছে অনেকেই। ইদানিংকালের কিছু সশস্ত্র হামলার ঘটনা উদ্বেগকে নিঃসন্দেহে বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের মাটি নিরাপদ আশ্রয় হিসাবে ব্যবহার করার নতুন প্রয়াসের ধারণাকে শক্ত করেছে রাঙ্গামাটির রাজস্থলিতে পাওয়া চিহ্ন থেকে। মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত ক্রমেই সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী, মানব পাচারকারী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠছে। দুর্গম ও পার্বত্য চরিত্রের এলাকাটি সংঘবদ্ধ অপরাধীরাও সহজেই ব্যবহার করে চলেছে।

মাদক চোরাচালান, অস্ত্র ব্যবসা, মানব পাচারের সংগঠিত অপরাধ চক্রের সাথে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গিদের সম্পৃক্ততা অনেক পুরনো হলেও হালে তাদের সত্ত্বাকে আলাদা করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জঙ্গি, বিদ্রোহী ও সন্ত্রাসী দলের অর্থের জোগান দেয় সংঘবদ্ধ অপরাধ ও বিভিন্ন বৈধ ও অবৈধ ব্যবসায় বিনিয়োগকৃত অর্থ থেকে প্রাপ্ত মুনাফা। উভয় দেশের প্রশাসনে কর্মরত কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশ অপরাধ সংগঠন বা অবৈধ ব্যবসার নিয়ামক হয়ে পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলছে। মিয়ানমার থেকে ভয়াবহ মাদক ইয়াবা ট্যাবলেট বাংলাদেশকে সয়লাব করে তারুণ্যকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অবৈধ মাদক উত্পাদন ও বিপণনে বিদ্রোহী গোষ্ঠী ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। সীমান্ত নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত বিজিবির সদস্যরা বারে বারে হামলার শিকার হয়ে জীবন হারাচ্ছে। সীমানার জটিলতাকে যেমন অপরাধ চক্র কাজে লাগাচ্ছে ঠিক একইভাবে এগুচ্ছে সন্ত্রাসী বা বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। মিয়ানমারের সীমানা রক্ষী পুলিশ (বিজিপি) মাঝে মাঝে কোন রকম যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া বিজিবি টহল দলকে হামলা করেছে, ইদানিং যোগ হয়েছে আরাকান আর্মি নামের বিচ্ছিন্নতাবাদী দল। সার্বিক নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়লেও তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি। এই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা অপরাধ ও সন্ত্রাসী মুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সামরিক চিরুনি অভিযানে সাময়িক ফল পাওয়া গেলেও টেকসই সমাধান পেতে বহু মাত্রিক নতুন কৌশল নিয়ে এগুতে হবে।

সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় প্রতিবেশী দেশ হিসাবে মিয়ানমারের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। যদিও অনেক প্রতিশ্রুতি মিলেছে কিন্তু আন্তরিকতার অভাব প্রকট ছিল। দুই দেশের মধ্যেকার সম্পর্কে আস্থা ও বিশ্বাসের সংকটকে সহজেই দায়ী করা যায় যদিও রোহিঙ্গা ইস্যু ছাড়া তেমন কোন বিবাদের উপস্থিতি নেই দুই দেশের মধ্যে।

বাহাত্তরের ১৩ জানুয়ারিতে তৎকালীন বার্মা বর্তমানের মিয়ানমার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ষষ্ঠ রাষ্ট্র হিসাবে। আমাদের স্বাধীনতার প্রতি তাদের সমর্থন ও অনুরক্ততা লক্ষণীয় হলেও সময়ের বিবর্তনে দুই দেশের সম্পর্ক উঁচু-নিচু পথ ধরেই চলেছে। সহযোগিতা ও সংঘাত দুটোই পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে চললেও সহযোগিতার সুযোগগুলো ঠিক মত ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। রোহিঙ্গা ইস্যু বন্ধুত্বের রাস্তার কাঁটা হয়ে টিকে থাকলেও সমুদ্র সীমার বিরোধ মিটে গেছে ইতিমধ্যেই। আস্থা ও অনাস্থার ভেতর দিয়ে চলা সম্পর্ক বিশ্বাসের শেকড় খুঁজে পেতে অনেক সময় ব্যয় করে ফেলছে।

সহযোগিতার অনেক পথ খোলা থাকলেও নিরাপত্তার শঙ্কা দুই দেশকে দুপাশে ঠেলে দিয়েছে। আরাকানের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র দলের বাংলাদেশের মাটিকে ব্যবহার এবং রোহিঙ্গা অধিকার স্থাপনে বাংলাদেশের অবস্থান এবং বাংলাদেশকে ভর করে রোহিঙ্গা জঙ্গিদলগুলোর বেড়ে ওঠার সম্ভাব্য নিরাপত্তার ঝুঁকির দেয়াল ভেঙ্গে ফেলার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা প্রত্যাশিত গতি পেতে সক্ষম হয়নি যদিও বাংলাদেশ বারে বারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দুই দেশের ১৯৩ কিঃ মিঃ সীমানার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল। গহীন অরণ্য সহজেই সশস্ত্র জঙ্গিদের লুকিয়ে থাকার প্রকৃতিগত সুবিধা করে দিয়েছে। সীমানার এপার-ওপার জুড়ে ক্ষীণ জনবসতি ও নৃ-গোষ্ঠীর মিল প্রকৃতপক্ষে সীমানা দেয়ালের ছিদ্রগুলোকে বন্ধ করতে পারেনি।

১৯৯১ সালে মিয়ানমার বাহিনীর রেজুপাড়া সীমান্ত চৌকি আচমকা আক্রমণের মধ্য দিয়ে সীমান্ত অস্থিরতা শুরু হয়। ঐ ঘটনায় তিনজন তত্কালীন বিডিআর সদস্য নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে দুই দেশ যুদ্ধাবস্থায় পৌঁছেছিল। ২০০৮ সালে মিয়ানমার নৌ-বাহিনীর সুরক্ষায় ৪টি কোরিয়ান জাহাজ সেন্ট মার্টিনের নিকটে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করলে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় দুই দেশের মধ্যে। শতাধিক বছর ধরে রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বসবাসকে উপেক্ষা করে নাগরিক হিসাবে অস্বীকার ও তাদের উপর অমানবিক নির্যাতন ও দমন পীড়ন চালানোর ফলে বাংলাদেশ উদ্বাস্তু সমস্যার মুখোমুখি হয়। রোহিঙ্গারা রাষ্ট্র বিহীন মানুষে পরিণত হয়। তাদের দুরবস্থাকে পুঁজি করে দেশি-বিদেশি চক্র ইসলামী জিহাদের মতাদর্শে উজ্জীবিত করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় নতুন ঝুঁকি সৃষ্টি করে। মিয়ানমার সরকার ঝুঁকির শিকার হলেও পর্যাপ্ত সহযোগিতা গড়ে তুলতে কোন ইতিবাচক ভূমিকা রাখেনি।

বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীর উপর মাঝে মাঝেই হামলা হতে থাকে। ২৮ মে ২০১৪ বান্দরবন সীমান্তের ৫২ নম্বর পিলারের কাছে বিজিবি টহলের উপর আচমকা গুলি করে মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষী পুলিশ এবং বিজিবি সদস্য কর্পোরাল মিজানুর রহমানের দেহ টেনে নিয়ে মিয়ানমারে নিয়ে যায়। দেহ সনাক্তের জন্য মিয়ানমারের দেয়া অঙ্গীকার অনুযায়ী বিজিবি দল দুইদিন পর আবার ৫২ নম্বর পিলারের কাছে গেলে তাদের উপর গুলি বর্ষণ করে। বিজিবির পালটা জবাবে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দুই অফিসারসহ তিন সদস্য নিহত হয় বলে বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়। অবশ্য পরের দিন মরদেহ ফেরত দেয়। জুলাই মাসের ১৬ তারিখে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষীরা নাফ নদীতে টহলরত বিজিবি’র একটি দলকে আক্রমণ করে একজন সৈনিককে আহত করে এবং নায়েক রাজ্জাককে অপহরণ করলে সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় পরে উভয়পক্ষের সমঝোতার ফলে অপহূত রাজ্জাককে ফেরত দেয়।

মিয়ানমার প্রাকৃতিক গ্যাস, বনজ ও খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ দেশ। দক্ষিণ পূর্ব, পূর্ব এশিয়া ও চীনের সাথে যোগাযোগের বহিঃদ্বার হিসাবে মিয়ানমারের গুরুত্ব অপরিসীম। দুই দেশের সুন্দর ও সফল সম্পর্ক পারস্পরিক সহযোগিতা তৈরি ও বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখবে। সমমর্যাদা ও পারস্পরিক সৌহার্দ্য দুই দেশকে অনেক কাছে টেনে আনতে পারবে। বর্তমানে মিয়ানমার আমাদের নিকট প্রতিবেশী হলেও মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব দুই দেশকে দূর প্রতিবেশীতে পরিণত করেছে। বাণিজ্য ও চলাচলের অপরিসীম সম্ভাবনা সত্ত্বেও এখনও কিছুটা সীমান্ত বাণিজ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে।

বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গি দলের সশস্ত্র গ্রুপের সীমান্ত এলাকায় উপস্থিতি ও সংঘটিত অপরাধীদের মুক্ত বিচরণ দুই দেশের নিরাপত্তার জন্য সমান ঝুঁকি তৈরি করেছে। দুই দেশের যৌথ প্রয়াস ও সহযোগিতা ছাড়া একপক্ষীয়ভাবে এই ঝুঁকি সাশ্রয়ী ও কার্যকরীভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। দুই দেশের রক্ষীদের মধ্যে যোগাযোগ আগের থেকে অনেক বেড়েছে। একে অপরের শঙ্কাগুলো চিহ্নিত করা ও শঙ্কা মুক্ত করতে যথাযথ যৌথ পদক্ষেপ বিশ্বাস ও আস্থা তৈরি করতে বেশি অবদান রাখবে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল যৌথ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা স্থাপন। আর একটু এগিয়ে নিরাপত্তা ও জঙ্গি বিরোধী সহযোগিতা চুক্তি করতে পারলে দুই দেশ সমান উপকৃত হবে। সাথে মানুষের মধ্যে যোগাযোগের মাত্রা বাড়ানোর পথগুলো উন্মুক্ত করতে হবে। দুই প্রতিবেশী দেশ ও জনগণের মধ্যে আন্তরিক ও টেকসই সম্পর্ক বাড়াতে হলে সীমানার সমস্যাগুলোকে দূর করে অনেক দূরদৃষ্টি নিয়ে এগুতে হবে। বিসিআইএম ও বিমসটেক এর উপর ভর করে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার পথগুলো খুলে অযাচিত সংঘাত এড়িয়ে যৌথভাবে সীমান্তে শান্তি ফেরত আনতে হবে।

♦ লেখক : স্ট্রাটেজি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। ইন্সটিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল’ এন্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (আই ক্ল্যডস) এর নির্বাহী পরিচালক

সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক।

Exit mobile version