parbattanews

মেশিন গান দিয়ে বন্য হাতির পালের উপরে ফায়ার করতে আদেশ দিলাম

(১৩)

জামাইছড়ি থুমে ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত করার পরে উদ্ভুত চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে কেবল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছি এমন সময় সংবাদ এলো আর এক মহা দুর্যোগের। ইতোমধ্যেই পনের দিন পার করেছে জামাইছড়ি থুম ক্যাম্প।

তখন রাত দশ/ এগারোটা হবে । সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট রেজউর রহমান ওয়্যারলেস সেটে আমাকে অতি উদ্বিগ্নতার সাথে জানালো যে ক্যাম্পে বন্য হাতির আক্রমণ হয়েছে। তার কথায় জানতে পারলাম প্রায় বারো থেকে পনেরোটি বন্য হাতির একটি দল ক্যাম্পের সামনে দাপাদাপি করছে। ভয়ে সবাই সেঁটিয়ে আছে ক্যাম্পে। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট রেজউর রহমান আরো বললো সম্ভবতঃ নায়েক সিরাজ একটি মশাল জ্বালিয়ে হাতির দিকে যেতে চেষ্টা করাতে বন্য হাতির পাল আরো মারমুখী হয়ে তার দিকে তেড়ে এসে ক্যাম্পের প্রায় সম্মুখে এসে এখন দাঁড়িয়ে আছে। সবচেয়ে ভয়ের কারণ ছিলো নিশ্ছিদ্র অন্ধকার।

প্রবাদ আছে অন্ধকার ঘরে সবখানেই সাপের মতো অবস্থা। সৈনিকরা সবাই তাদের হাতিয়ার নিয়ে প্রস্তুত। আমার ভয় হচ্ছিল যদি কোনো সৈনিক পেনিকি হয়ে ফায়ার শুরু করে তবে সর্বনাশের এক শেষ হবে। আমি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট রেজউর রহমানকে বলছিলাম, তুমি টুআইসিকে বলো কোনো সৈনিক যেন ফায়ার ওপেন না করে। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট রেজউর রহমান আমার সিদ্ধান্ত চাচ্ছিলো। আমি চাচ্ছিলাম না বন্য হাতির কোনো ক্ষতি হোক।

আমি রেজাকে বললাম, প্রথমে মেশিন গান ( এমজি )দিয়ে ফাকা সর্ট বার্ষ্ট ফায়ার করতে যাতে বন্য হাতির পাল ভয়ে পালিয়ে যায়। এতে বন্য হাতিরও কোনো ক্ষতি হলোনা অন্যদিকে হাতির আক্রমণ থেকে ক্যাম্প রক্ষা পেলো। কিন্তু মেশিন গান কয়েকটি সর্ট বার্ষ্ট ফায়ার করার পরে বন্ধ হয়ে গেলো। আসলে এই চরম পেনিকি অবস্থায় মেশিন গান ডিটাচমেন্টের সৈনিক জিটারি হয়ে মেশিন গান ঠিকমতো হ্যান্ডের করতে না পারার ফলে এই অঘটন ঘটলো। এমন একটি ভয়াবহ অবস্থায় সবাইকে শান্ত থাকতে নির্দেশ দিলাম।

আমি সেটে টুআইসি মেজর কাদেরকে নিয়ে জানাতে চাইলাম মোট হাতির সংখ্যা কতো হবে? সে বললো অন্ধকারে ঠিক দেখা যাচ্ছে না তবে হাতির সংখ্যা বারো থেকে পনেরোটির মতো হবে। সে আমাকে একটি চমকপ্রদ সংবাদ দিলো। মেজর কাদের জানালো মেশিন গান থেকে সর্ট বার্ষ্ট ফায়ারের সময় ট্রেসার রাউন্ডের আলোতে দেখা গেছে যে হাতিটি বন্য হাতির পালের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার একটি মাত্র বড় দাঁত। বুঝতে পারলাম এই হাতিকে বলা হয় “গনেশ হাতি”।

” গনেশ হাতির” গজদন্ত হয় একটা। এই গনেশ হাতি সব সময় হাতির পালের সামনে থেকে হাতির পালকে পরিচালনা করে । গনেশ হাতি মায়ের পেটে জন্মের সময় মোট চব্বিশ মাস থাকে। অন্য হাতিরা থাকে মোট আঠারো মাস। গনেশ হাতির শক্তি অন্য হাতির চেয়ে অনেক বেশী। অন্য হাতি তার দুই গজদন্ত দিয়ে যা করে গনেশ হাতি এক দাঁত দিয়ে তার চেয়ে অনেক বেশী কাজ করতে পারে। কোনো উপায় না দেখে আমি মেজর কাদেরকে গ্রেনেড ফায়ারিং রাইফেল ( জিএফ রাইফেল ) দিয়ে হাতির ডানে ও বামে গ্রেনেড ফায়ার করতে বললাম। জিএফ রাইফেল থেকে গ্রেনেড ফায়ার করলে বিকট বুম আওয়াজ হয়। আমার ধারণা ছিলো, এই বিকট অওয়াজ শুনে বন্য হাতির দল পালিয়ে যাবে। কিন্তু অঘটন তখনি ঘটলো যখন জিএফ রাইফেল থেকে গ্গ্রনেড ফায়ার করা হলো। গ্রেনেড ফায়ারের শব্দে বন্য হাতির পালতো গেলইনা গ্রেনেডের একটি স্প্লিন্টার রিকোশে করে এসে লেফটেন্যান্ট কাজি হালিমুর রশীদের ডান চোখের নীচে আঘাত করে অনেকটা মাংস উঠিয়ে নিয়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করলো। ভাগ্য ভালো যে তার ডান চোখ অল্পের জন্য বেঁচে যায়। সেদিনের সেই ক্ষত সে এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে।

আমি দেখলাম বন্য হাতি নয় এখন ক্যাম্প এবং ক্যাম্পের সৈনিকদের জীবন বাঁচাতে হবে। ইতিমধ্যে মেশিন গান ঠিক হয়ে গেছে। আমি আদেশ দিলাম মেশিন গান দিয়ে বন্য হাতির পালের উপরে ফায়ার করতে । এতে কাজ হলো। বন্য হাতির পাল পিছন ফিরে চলে গেলো। পরদিন সকালে রিপোর্ট পেলাম চারিদিকে হাতির রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সবার ধারণা জামাইছড়ি থুম ছিলো একটি এলিফেন্ট ট্রেইল। এই পথে বন্য হাতি দলবেঁধে চলাচল করে। ওখানে ক্যাম্প করাতে হাতির চলাচলে বিঘ্ন হয় ফলে ক্যাম্পে বন্য হাতির আক্রমণ ঘটে। পরে অবশ্য ক্যাম্পে বন্য হাতির আক্রমণ আর হয়নাই। তবে মাঝে মাঝে বন্য হাতির পাল ক্যাম্প থেকে দুরে দাপাদাপি করতো।

…চলবে

মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান: প্রাক্তন মহাপরিচালক বিডিআর ।

Exit mobile version