parbattanews

যেভাবে স্বাধীনতার পতাকা উড়েছিল রাঙামাটিতে

লে. কর্নেল মনীষ দেওয়ান (অব.)

১৯৭১ সাল, আমার বয়স তখন ১৯ বছর, রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে এইচএসসি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হয়। ২৭ মার্চ, আমি বাড়িতে, রেডিওতে একটি ঘোষণা শুনতে পেলাম। একজন মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। একবার নয়, সারা দিনরাত অনেকবার এই সম্প্রচার শুনেছি। তিনি সকল রাষ্ট্রকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং সবাইকে যুদ্ধে যোগ দিতে এবং পাক সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমার মাতৃভূমি বাংলাদেশের একজন প্রখর দেশপ্রেমিক হিসেবে এই ঘোষণা আমাকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করেছিল।

আমার মুক্তিযোদ্ধা জীবন শুরু হলো। মেজর জিয়াউর রহমানের আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের অনুপ্রেরণা ও নৈতিক উৎসাহ ছিল। ফলে অন্য কিছু ভাবার অবকাশ ছিলো না। আমি যুদ্ধে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং এপ্রিলে আমি বাড়ি ছেড়ে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে ভারতে পাড়ি জমাই। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন উপ-বিভাগীয় শহর রামগড়ে ছিলাম, যা তখনো মুক্ত ছিল। আমাদের রামগড়ে থাকাকালেই, একাত্তরের মে মাসের গোড়ার দিকে এক প্রচণ্ড লড়াইয়ের পরে রামগড় শহরটি আমাদের চোখের সামনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখলে চলে যায়।

আগস্টের মাঝামাঝি নাগাদ, আমি ভারতের দেরাদুনের কাছে তান্ডওয়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে ফিরে এলাম। এ প্রশিক্ষণ আমাকে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অভিযান পরিচালনা করার জন্য অভাবনীয় শারীরিক শক্তি এবং সীমাহীন সাহসের এক আত্মবিশ্বাসী গেরিলা সৈনিকে রূপান্তরিত করে।

একদিন আমাকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঠিক উল্টোদিকে তৎকালীন আসামের প্রত্যন্ত স্থান মিজোরামে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। শুরুর দিকে আমি এমন জায়গায় থাকতে পছন্দ করি নি, যা আমার কাছে এত প্রত্যন্ত এবং এত বিস্ময়কর ছিলো। তবে এটির প্রয়োজন ছিল, কারণ, আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর একজন প্রতিনিধি এবং এ জায়গাটির জন্য অন্য সবার চেয়ে উপযুক্ত। আমি এ অঞ্চলটি সম্পর্কে জানি, এখানকার মানুষ, ভাষা, অঞ্চল, কার্যত সবকিছু। তদুপরি আমার মতো এক যুবকের কাছে অজানা জায়গায় অপরারেশন পরিচালনা করা জীবনের সাহসী অভিযানের মতো ছিল।

আগস্টের একটি নির্ধারিত তারিখে, আমাকে একটি সামরিক হেলিকপ্টার দিয়ে মিজোরাম প্রদেশের রাজধানী আইজলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। একটি সংক্ষিপ্ত বিরতির পরে আমাকে সোজা বাংলাদেশের বরকল থানার অন্তর্গত থেগামুখের বিপরীতে মিজোরাম সীমান্তের একটি ছোট গ্রাম দেমাগ্রীতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। আকাশ পথে ভ্রমণের সময় আমি নিচে আসামের বিশাল এবং গভীর জঙ্গল দেখতে পেতাম, যা এর আগে আমি পাঠ্য বইয়ে পড়েছিলাম। আমার আগের শিবির আগরতলা ছেড়ে চলে যেতে কষ্ট পেয়েছিলাম, তবে আমি এমন জায়গায় যেতে পেরে শিহরিতও হয়েছি, যা আমার কাছে বিস্ময়কর ও অজানা ছিলো।

দেমাগ্রীতে আমাকে মুক্তিবাহিনী শিবিরে স্থান দেওয়া হয়েছিল। ক্যাম্প ইনচার্জ ছিলেন জনাব আবু সালেহ, সাতকানিয়া, চট্টগ্রামের তৎকালীন সংসদ সদস্য। ধীরে ধীরে আমি সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পরিচিত হয়েছি এবং আমার প্রথম মিশন নিয়ে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে  প্রবেশের জন্য আমার দিনগুলি গণনা করতাম।

মিজোরামের পরিস্থিতি পুরো ভারতের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। ১৯৬০ এর দশকের শেষভাগ থেকে ভারতের বিরুদ্ধে লাল ডেঙ্গার নেতৃত্বে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী মিশন ভারতের বিপক্ষে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল, ফলে পুরো মিজোরাম সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ থাকত। পার্বত্য চট্টগ্রাম মিজো বিদ্রোহীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতীয় বাহিনী ও আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও পৃষ্ঠপোষকতা দিতো। তদুপরি, চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য এবং পাক সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় উপজাতি সশস্ত্র বাহিনী এবং মিজো বিদ্রোহীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে আমাদের বড় বিপদের কারণ ছিল। দেমাগ্রী শিবিরে খুব বেশি উপজাতি মুক্তিযোদ্ধা ছিল না, তবে যারা ছিল, তারা ভালো যোদ্ধা ছিল এবং আমরা পাক সেনাবাহিনী এবং তাদের মিজো এবং উপজাতি সশস্ত্র সহযোগীদের হত্যা করে ব্যাপক ধংসযজ্ঞ চালিয়েছি।

একদিন আমাকে আমার প্রথম মিশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, এটি ছিল আমার সহযোদ্ধা শুভলংয়ের উপজাতি মুক্তিযোদ্ধা অশোক মিত্র কারবারীর সাথে একটি পর্যবেক্ষণ মিশন। আমাদের মিশনটি ছিল বরকলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান ও সমরসজ্জা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। প্রথমে আমি উপজাতিদের মতো করে চুল কাটালাম- একটাকে রাউন্ড কাট বা বাটি ছাঁট বলা যায়। এতে আমাকে দেখতে অদ্ভুত লাগছিল। কিন্তু এটা আমাকে সহজেই উপজাতীয় ব্যবসায়ীদের সাথে মিশে যেতে সাহায্য করেছিল। একটি লুঙ্গী ও ময়লা শার্ট পরে কলা ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশ ধারণ করে সকালেই আমার সীমান্ত পেরুলাম। আমার সাথে একটি ৯ এমএম চাইনিজ পিস্তল ছিলো। আমরা বরকলের সাপ্তাহিক হাটের দিন শনিবারকে মিশনের জন্য নির্বাচন করেছিলাম। অশোক সেই অঞ্চলের হওয়ায় আমাদের জন্য কাজটি খুব সহজ হয়েছিল। আমরা বেশ কয়েকদিন তার আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে প্রচুর গোয়েন্দা তথ্য নিয়ে ফিরে যাই দেমাগ্রীতে।

নভেম্বর পর্যন্ত আমি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বেশ কয়েকবার অনুপ্রবেশ করি একইভাবে কয়েকটি মিশনে অংশ নিয়েছিলাম। এর মধ্যে একটি ছিল লাল ডেঙ্গার হত্যার মিশন, যা রাঙামাটিতে পরিবারসহ বসবাসকারী বিদ্রোহী মিজো নেতাকে বিস্মিত করেছিল। তার একটি সুন্দরী মেয়ে ছিল এবং সেই সময়ে আমি তাকে খুব পছন্দ করতাম। আমিসহ তিনজন অসম সাহসী গেরিলার এটি একটি বিপজ্জনক মিশন ছিল। তবে মিশনটি ব্যর্থ হয়েছিল এবং আমরা সেই রাতেই প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিলাম।

নভেম্বরের প্রথম দিকে, আমরা সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর একটি বিশাল অবস্থান দেখতে পেলাম। আমরা জানতাম, ভারত-পাক যুদ্ধ আসন্ন। দেমাগ্রীতে মেজর জেনারেল সুজন সিং উবান স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সেস (এসএফএফ)’র হাজার হাজার সৈন্য নিয়ে হাজির হলেন। চট্টগ্রাম দখল ও কৌশল নির্ধারণের দায়িত্ব জেনারেল উবান ও এসএফএফ এর উপর ন্যস্ত হয়েছিল। এই সৈন্যদলটি ভারতে জন্মগ্রহণ ও বেড়ে ওঠা তিব্বতি উদ্বাস্তুদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। সকলেই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও মঙ্গোলয়েড বৈশিষ্ট্যযুক্ত। তারা জঙ্গল এবং পর্বত যুদ্ধে পারদর্শী ছিল।

নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত, আমি একটি এসএফএফ ব্যাটালিয়নের সাথে সংযুক্ত ছিলাম এবং ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর আমরা অনুপ্রবেশ করি। প্রথম অভিযানটি ছিলো পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর একটি ছোট সেনা ক্যাম্পে, যা আমরা দখল করতে সক্ষম হই। এরপর ছোট হরিনায় পৌঁছাই। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে থাকায় এবং আমরা বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও কর্ণফুলী নদী পার হতে পারিনি। ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি কোম্পানির একটি কলাম ডিফেন্সকে অবরোধ করে, আর আমরা ওই ডিফেন্সকে বাইপাস করে বরকলের দিকে যাত্রা শুরু করি।

ডিসেম্বরে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং তখন ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি অবস্থানের বিরুদ্ধে পুরোমাত্রায় আক্রমণ শুরু করে। আমি ডিসেম্বরে পুরো যুদ্ধে ছিলাম এবং আমার ১৯তম জন্মদিনটি ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর বরকালের নিকটে একটি পর্বতের চূড়ায় উদযাপন করি। এটি একটি চকচকে জোছনা রাত ছিল এবং আমি আমার জন্মদিনে একটি ট্রিপল এক্স রাম বোতল সাবাড় করে উদযাপন করেছি। আমার কাছে এটি একটি আনন্দ উদযাপন ছিল এবং আমি অবশ্যই স্বীকার করব, আমি সে রাতে পুরো মাতাল হয়েছিলাম!

১২ ডিসেম্বর আমাকে যুদ্ধের সম্মুখ অবস্থান থেকে পেছনে দেমাগ্রীতে হেড কোয়ার্টারে ডাকা হয়। আমি হেড কোয়ার্টারে ফিরে রিপোর্ট করি। ১৪ ডিসেম্বর আমাকে অপারেশনস রুমে ডাকা হয়, সেখানে মেজর জেনারেল সুজন সিং উবান তার সমস্ত স্টাফ অফিসারদের সাথে উপস্থিত ছিলেন। তিনি Phantoms of Chittagong  নামে একটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইয়ের জন্য সুপরিচিত। অপারেশন রুমে আমার সহযোদ্ধা শামসুদ্দিন আহমেদ (একজন অবসরপ্রাপ্ত সাংবাদিক এবং ঢাকা কুরিয়ারের সাবেক সম্পাদক) উপস্থিত ছিলেন। তিনি আমার থেকে তিন বছর সিনিয়র ছিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তিনিও রাঙ্গামাটি থেকে এসেছিলেন এবং আমরা একে অপরকে চিনতাম।

এটি ছিল একটি আসন্ন বিশেষ অপারেশন পরিকল্পনার মিটিং। আমাকে এবং শামসুদ্দিনকে জেনারেল উবানের অধীন স্পেশাল কোম্পানির সাথে যোগ দিতে পাঠানো হয়েছিল, দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল রাঙ্গামাটি দখলের। কোম্পানি কমান্ডার মেজর সুরিও উপস্থিত ছিলেন এবং আমাদের অপারেশন সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়েছিল। এই বিশেষ কোম্পানিতে দুইজন মুক্তিযোদ্ধাসহ ১৫০ লোকবল ছিলো। এটি একটি বিশেষ কোম্পানি ছিলো যাদের শক্তিশালী অস্ত্র ও মোবিলিট ছিল। আমার খুব প্রিয় এসএলআর (সেল্ফ লোডিং রাইফেল) ছিল। শামসুদ্দিনের কাছে একটি স্বয়ংক্রিয় শর্ট রেঞ্জের অস্ত্র সাব মেশিন কার্বাইন (এসএমসি) ছিলো। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত গোলাবারুদ ছিলো। চূড়ান্ত হয়েছিল যে, আমরা ১৫ ডিসেম্বর রওনা হবো। আমাদের একটিই লক্ষ্য, রাঙামাটি পুনরুদ্ধার করা। আমি এই মিশনটি নিয়ে খুব উচ্ছসিত ছিলাম। রাঙ্গামাটিকে পুনরুদ্ধার করার লড়াইয়ের চিন্তাভাবনা এতটাই তীব্র এবং উত্তেজনাপূর্ণ ছিল যে, আমি সে রাতে ঘুমাতে পারিনি।

পরের দিন ১৫ ডিসেম্বর আমাদের হলিকপ্টারে রাঙামাটির উপকণ্ঠে নামিয়ে দেয়া হয়। জেনারেল উবান আমাদের চূড়ান্ত ব্রিফিং দিতে এবং বিদায় জানাতে হেলিপ্যাডে উপস্থিত ছিলেন। দুটি চপ্পার (এমআই -৮) আমাদের নেয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি এবং শামসুদ্দিন কোম্পানির কমান্ডার মেজর সুরির সাথে একই চপারে ছিলাম, অন্যটা আমাদের অনুসরণ করে। সকাল ৮টায় আমরা যখন যাত্রা শুরু করলাম কাচালং রেঞ্জ এবং কাপ্তাই হ্রদের উপর দিয়ে প্রায় আধা ঘণ্টা চলার পরে রাঙ্গামাটির প্রায় ১৮ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে কুতুকছড়ি নামক একটি জায়গায় নামলাম। আমরা রাঙামাটির পশ্চিমে অবস্থিত এ অঞ্চলের বৃহত্তম পর্বত ফুরোমোনের পাদদেশে নামি। ফ্লাইট চলাকালীন আমরা মাটি থেকে শত্রুদের গোলার মুখে পড়ি। আমাদের একজন যোদ্ধা হেলিকপ্টারের পেছনের দরোজার সাথে নিজেকে আটকে এলএমজি দিয়ে শত্রুর অবস্থানের উপর গুলি বর্ষণ করতে থাকে। আমাদের হেলিকপ্টার শত্রুদের ফায়ারিং রেঞ্জের আওতার উপরে উঠে যায়। এটি ছিল হেলিকপ্টারে চড়া আমার সর্বোচ্চ উচ্চতা অতিক্রম করার ঘটনা। শত্রু অঞ্চলে এটি আমার প্রথম হেলি-রাইড ছিল না। শত্রুদের ভূমিতে এর আগে আমি বহুবার উড়ে এসেছি কিন্তু এমন অবস্থায় কখনো পড়িনি। আমি উপর থেকে দেখতে পেলাম, অন্য হেলিকপ্টারটি মাটিতে সৈন্যদের মাটিতে অবতরণ করাচ্ছে। এরপর আমাদের পালা এলো। আমরা আমাদের ভারী অস্ত্র এবং গোলাবারুদসহ প্রায় খাড়াভাবে নামলাম।

এই সময় পুরোপুরি বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কোম্পানির অর্ধেক শক্তি অবতরণ করে। আমাদের দেখে পাকিস্তান সেনাবাহিনীও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। তারা রাঙ্গামাটি থেকে চলে এসেছিল এবং সমস্ত শক্তি দিয়ে আমাদের অবতরণস্থলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আমরাও এই সময়ের মধ্যে পূর্ব দিকে প্রতিরক্ষামূলক প্রাচীর তৈরি করে আমাদের অবস্থান সুরক্ষিত করেছিলাম। তারা এক ঘণ্টার মধ্যে অবতরণ অঞ্চলের কাছাকাছি পৌঁছে রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কে অবস্থান নেয়। এটি সম্পূর্ণ দিনের আলোয় ঘটছিলো। ফলে খুব দ্রæতই তীব্র লড়াই শুরু হয়ে যায়।

সরাসরি যুদ্ধ চলছিলো। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কে এবং আমরা ফুরোমোন পাহাড়ের পাদদেশে, পরস্পরের মুখোমুখি। মাঝখানে মাত্র ৫০০ থেকে ১০০০ গজের ব্যবধান। ঠা-ঠা-ঠা মেশিনগানের অবিশ্রান্ত গুলি ও ৩ ইঞ্চি মর্টারের ধ্রাম ধ্রাম ধ্রাম কান ফাটানো আওয়াজে অঞ্চলটি কিছুক্ষণের মধ্যেই জলন্ত নরকে পরিণত হলো। বাকী সৈন্যদের নামানোর জন্য আসা আমাদের হেলিকপ্টারের পাখার বাতাসে উড়ন্ত ধুলা অবস্থা আরো খারাপ করে দিলো। মর্টার বিষ্ফোরণের আগুন ও গান পাউডারের ঘ্রাণ যুদ্ধক্ষেত্রের বাতাস বারুদ্ধের গন্ধে ভরিয়ে দিলো। তবে এই গন্ধ আমার কাছে সুঘ্রাণের মতো অনুভূত হতো। যুদ্ধের পুরো সময় আমি বারুদের এই সুঘ্রাণ নিতে খুব পছন্দ করতাম।

আমি এর আগে কখনই শত্রু এতো কাছাকাছি হয়ে মুখোমুখি যুদ্ধ করিনি। আমি প্রতি মুহূর্তে এই ধংসলীলা উপভোগ করেছি। এই সময়ের মধ্যে আমি শত্রু দিকে গুলি বর্ষণ করে আমার ৫টি ম্যাগজিন খালি করে ফেলেছি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমাদের ও শত্রুদের গোলাবারুদের ধোঁয়ায় পুরো এলাকায় মোটা আস্তর তৈরি করে, যা আমাদের দৃষ্টিশক্তিকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে।

বিকেল নাগাদ গুলির তীব্রতা কিছুটা কমে এলো। ডিসেম্বর মাসে ৫-৬ টার মধ্যে সূর্য পাহাড়ের আড়ালে চলে যায় এবং অন্ধকার নেমে আসে। এর মধ্যেই থেমে থেমে মুখোমুখি দুই শত্রু দলের মর্টারের, গুলির আগুন দেখা যাচ্ছিল।

এক পর্যায়ে আমাদের কোম্পানি কমান্ডার আদেশ দিলেন যে, পরের দিন অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বরের জন্য একটি শক্তিশালী পারিখা খনন করার জন্য। আমি এবং শামসুদ্দীন একটি আই টাইপ পারিখা খনন শুরু করি। কিন্তু সেখানের মাটি খুব শক্ত ছিল এবং খনন করা আরো শক্ত কাজ ছিলো। মধ্যরাতের মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে আমাদের অবস্থানের ভিতরে পারিখা খনন সম্পন্ন করা হলো।

১৬ ডিসেম্বর সকালে পাকিস্তানি বাহিনী পুনরায় মর্টার সেলিং শুরু করে। মিনিটখানেকের মধ্যেই ২-৩টি সেল আমাদের অবস্থানের ডানে বামে পড়ে বিষ্ফোরিত হয়, ধ্রাম, ধ্রাম, ধ্রাম। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলি বর্ষণ এবং থেমে থেমে মেশিন গানের গুলির মধ্যে আবার নতুন করে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তবে লক্ষ্যণীয় ছিলো যে, পাক বাহিনীর দিক থেকে গুলি বর্ষণের তীব্রতা আগের দিনের চেয়ে কম ছিলো এবং এভাবে বিকেল পর্যন্ত চলে।

এখন, আমি বুঝতে পারি যে এটি ছিলো ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এদিন বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, যা সম্পর্কে আমি এবং শামসুদ্দিন একেবারেই বেখবর ছিলাম। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মাঝে মধ্যে গুলি করে আমাদের যুদ্ধে ব্যস্ত রাখতে চেয়েছিল, যাতে তারা চট্টগ্রামে পালাতে পারে।

মধ্যরাতের মধ্যে, সবকিছু চুপ হয়ে গেল এবং আমরা রাঙামাটির দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলাম। এটা ছিলো শুনশান রাত্রি। গভীর রাতে আমরা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলাম, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঘাগড়া ব্রিজকে বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। উড়িয়ে দেওয়া সেতুটি আজও পাকিস্তানের পরাজয়ের সাক্ষ্য হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে!

দিনের প্রথম আলোয় আমাদের কোম্পানি বিনা বাধায় রাঙ্গামাটিতে প্রবেশ করে এবং যখন ভারতীয় সৈন্যরা শহরে সর্বশেষ অভিযান চালাচ্ছিল, আমি এবং শামসুদ্দিন তখন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে তাদেরকে ডেকে আনি। সমস্ত কর্মকর্তা অফিসে জড়ো হয়। আমরা তাদের কাছে একটি বাংলাদেশের পতাকা চাইলাম। তারা একটি পতাকা তৈরি করে আনলো। লাল এবং সবুজ পতাকার বাংলাদেশের মানচিত্রের সাথে একটি লাল বৃত্ত কেন্দ্রে প্রতীক হিসাবে খচিত। এই পতাকাটি অর্জন করতে আমরা ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ করেছি। সেটি তখন উজ্জ্বল এবং চকচক করছিল।

সকাল ৯টা নাগাদ, কাছাকাছি ও দূর থেকে কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন দু’জন মুক্তিযোদ্ধা মণীষ দেওয়ান এবং শামসুদ্দিনকে এক ঝলক দেখতে। রাঙ্গামাটি ডিসি অফিসের সামনে উপজাতি, বাঙালি, পুরুষ, মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ এবং যুবকরা ভীড় করেছিল। হাজার হাজার উল্লাসিত জনসমাগম এবং জয় বাংলা শ্লোগানের মাঝে আমি এবং শামসুদ্দিন জাতীয় পতাকাটি উত্তোলন করি। তারপরে জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, অমি তোমায় ভালোবাসি’ গাওয়া হয়। এভাবেই একটি দেশের জন্ম হলো এবং আমি আমার দায়িত্ব সমাপ্ত করলাম। সেটা ছিলো ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর সকাল ১০ ঘটিকা।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মনীষ দেওয়ান: ১৯৭১ সালে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের ছাত্র থাকাবস্থায় মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা প্রথম ওড়ান তিনিই। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। বর্তমানে তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির উপজাতি বিষয়ক সহ-সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

Exit mobile version